ক্ষমতার সঙ্গে সখ্য শিল্পীর জন্য ক্ষতিকর: সায়ান

দেড় যুগের বেশি সময় ধরে গান করছেন সংগীতশিল্পী ফারজানা ওয়াহিদ সায়ান; কথা–সুরে প্রতিবাদ করে পরিচিত পেয়েছেন তিনি। গত ৭ ডিসেম্বর ধানমন্ডির বাসায় তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মকফুল হোসেন

প্রথম আলো :

‘আবরার ফাহাদ’ থেকে ‘আমার নাম প্যালেস্টাইন’ কিংবা ‘কালো মানুষ’; বাংলাদেশ ছাপিয়ে বিশ্বজুড়ে চলা অন্যায়ের প্রতিবাদে গান করেছেন। প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে গানকেই কেন বেছে নিলেন?

প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে আমি গান বেছে নিইনি। বুঝতে শেখার আগে থেকেই গান আমার অস্তিত্বের অংশ। আমি সচেতনভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে শিল্পী হয়েছি, ব্যাপারটা তা নয়। এর সঙ্গে জৈবিক সূত্র রয়েছে। এই স্বভাবটাকে বহন করে পৃথিবীতে বাঁচতে শুরু করলাম। জগৎটাকে দেখতে গিয়ে মনের মধ্যে অনেক ক্ষোভ জমা হচ্ছে। মানুষ ন্যায্যতা চায়, ন্যায্যতায় বিশ্বাস করে। বারবার ন্যায্যতাবোধ আহত হলে সেই আক্ষেপটা নিয়ে আমি কী করব? গানটাই লিখি। আমার গানে কোনো সমস্যার সমাধান হয় না। আমি গান গেয়েছি বলে, গাজায় হত্যা কমেনি; বরং বেড়েছে। মাঝখানে আমার ‘প্যালেস্টাইন’ শব্দটা ফেসবুক ফিল্টার করে গানের রিচ কমিয়ে দিয়েছে। আমি গানের মাধ্যমেই প্রতিবাদ করি। এটা আমার সহজাত প্রকাশ, এর মধ্য দিয়েই আমি বাঁচি।

প্রথম আলোকে দেওয়া দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে শিল্পীর রাজনীতি নিয়ে কথা বলছেন সায়ান
ছবি: তানভীর আহাম্মেদ
প্রথম আলো:

শাহবাগ কিংবা টিএসসিতে বিভিন্ন প্রতিবাদ সমাবেশেও আপনাকে দেখা যায়। রাজনৈতিক ‘ট্যাগ’ লাগার আশঙ্কায় শিল্পীদের অনেকে এসব প্রতিবাদ এড়িয়ে চলেন। আপনি কেন যান?

রিকশাচালক রিকশা চালিয়ে, কৃষিজীবী ফসল ফলিয়ে ও আমি গান গেয়ে খাই। আমাদের যোগসূত্র কী—আমরা সবাই বাংলাদেশের নাগরিক। একজন শ্রমিক প্রতিবাদ সমাবেশে যেতে পারলে একজন বিনোদন বিক্রয়কারী শিল্পী কীভাবে এর থেকে আলাদা হন? উনি কি বাংলাদেশে ৭০ টাকা কেজি চাল খান না? এই যে একটা বয়ান তৈরি হয়েছে, শিল্পীরা শুধু শিল্প করবেন। বাংলাদেশের কোনো কিছুতে শিল্পীদের যুক্ত হওয়ার প্রয়োজন নেই—এটা একেবারে ভুল ধারণা। শিল্পী চাইলে কোনো প্রতিবাদে না–ও যেতে পারেন। সব রিকশাচালক যেমন সব প্রতিবাদে যান না, শিল্পীও সব প্রতিবাদে যান না। কিন্তু আমি কেন প্রতিবাদে যাই? এটা আমার দেশ, আমি বিশ্বাস করি, দেশের মানুষেরা একে অপরের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত। যিনি কৃষিকাজ করেন, তাঁর জন্য আমি অন্ন গ্রহণ করতে পারি। তাঁর স্বার্থ আমাকে দেখতে হবে, অন্যথায় একদিন ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাবে।
আমি অন্যায় কিছু দেখলে প্রতিবাদ সমাবেশে যাই, যাব। সব প্রতিবাদে যেতে পারি না; তার মানে এই নয় যে তাতে আমার সমর্থন নেই। আবার সব প্রতিবাদে সমর্থন রয়েছে, তেমনও না। মানুষের স্বার্থে আঘাত এলে আমি সেই প্রতিবাদে যাওয়ার চেষ্টা করি।

এখন প্রশ্ন হলো, অন্য শিল্পীরা কেন যান না? সবাইকে সব জায়গায় যেতে হবে—এটা মনে করি না। তবে শিল্পী হিসেবে কোনো রাজনৈতিক ‘ট্যাগ’ আমাকে সহযোগিতা করে—সেটা একটা বিষয়। ধরেন, কোনো বাম দল ক্ষমতায় এল আর সেই দলের মুখপাত্র হলে আমি অনেক শো পাব। উল্টো তাদের নিন্দা করলে বেশ কিছু জায়গা থেকে আমার ওপর সেন্সরশিপ আসবে। যে আপনাকে নিন্দা করে তাঁকে ডাকবেন? যে আপনার পক্ষে থাকে তাঁকেই নিশ্চয়ই ডাকবেন। শিল্পী হিসেবে আমরা গত ১৫ কিংবা ২০ বছরে ক্ষমতাকাঠামোর সঙ্গে জড়িতদের কোনো নিন্দাই করিনি। নিন্দা করার মতো কোনো কাজই হয়নি? হয়েছে। আমরা চাইলে আওয়ামী লীগকে সমর্থন করেই আওয়ামী লীগের নিন্দা করতে পারতাম। কিন্তু ওই পরিচয়টাকে মুছে শিল্পীত্বকে ধরে রেখেছি। কেন রেখেছি? এতে আমার সুবিধা হয়।

প্রথম আলো:

প্রতিবাদে আপনার সমসাময়িক শিল্পীরা থাকে না বলে আপনি একা অনুভব করেন?

আমি ব্যক্তির স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি; আমার কথা আমাকেই বলতে হবে। প্রতিটি মানুষ আসলে একা, আপনার মতো আরেকজনকে পেলে সে সঙ্গী হয়। তবে মানুষের যাত্রাটা একাই। এটা ঠিক, কণ্ঠস্বরটা ছড়াচ্ছে না। কণ্ঠস্বর শোনার কথা পরে, আমি তো আগে বলতে চাই। আমি বলতে পারছি, বলছি—এটাই আমার কাজ। আবার সেই অর্থে আমি একক মানুষও নই; আমি অনেকের প্রাণের কথা বলছি। আমি যেটা বলছি, তার চেয়েও অনেক বলছি না। আমি যতটা বলতে চাই, তার পুরোটা বলতে পারছি? পারছি না; সেখানেও আমার সেলফ সেন্সরশিপ নেই? আছে। জেলে যাওয়ার ভয় আমার নেই? আছে। কে চায় জেলে যেতে? আমি চাই না; কিন্তু আমি জেলে যেতে চাই না বলে হাত–পা গুটিয়ে বসে থাকব—তাহলে হয়তো জেলের ভাত খেলাম না কিন্তু জীবনটাই জেলখানা হয়ে যায়। এটা সম্ভব না, এই দর–কষাকষি করতে করতে আমি জীবনে যাত্রা করি।
কাজটা আমার একারই; আমি একা খাই, একা ঘুমাই; প্রতিটি কাজ একাই করি। তবে বাংলাদেশ আমার সঙ্গে আছে; আবরার ফাহাদ আমার সঙ্গে আছে। আমি কোনো দিন আবরারের দুঃখ থেকে বের হতে পারব না; কোনো দিন না। আবরারকে আমি চিনতাম না, সে একজন মানুষ। সে দেশের কথা বলতে গিয়ে মারা গেল। আপনি কী করে বলতে পারেন, এটা আমার কোনো ব্যাপার না। আবরারের কষ্ট আমি বহন করি, সেই কষ্ট আমাকে জাগিয়ে রেখেছে।

নিজের স্টুডিওতে সায়ান
ছবি: প্রথম আলো
প্রথম আলো:

পশ্চিমে পিট সিগার, জোয়ান বায়েজরা প্রতিবাদের গান করেছেন; ভারতেও এই ধারার গানের চর্চা রয়েছে। আমাদের বেশির ভাগ শিল্পীর গানে এই সময়ের ছাপ কম। কারণ কী?

ভারতের পশ্চিমবঙ্গে উচ্চাঙ্গ সংগীতের শিল্পীরা সংগীত করে খেতে পারেন। সলিল চৌধুরী, হেমাঙ্গ বিশ্বাসরা গান করেছেন। সাধারণের মাঝে এই গানের কদর ছিল। পরে অঞ্জন দত্ত, কবীর সুমন, নচিকেতা চক্রবর্তীরা এলেন। শিল্পীর সঙ্গে ক্ষমতার শত্রুতা না হোক, বন্ধুত্ব হলে, শিল্পীরা ক্ষমতার ঢাল হয়ে কথা বললে তাঁর ইতিহাস আমার কাছে বড় হয়ে থাকে না। পশ্চিমবঙ্গের শিল্পীদের যাঁরা একদিন মানুষের পক্ষে কথা বলতেন, তাঁদের কেউ কেউ ক্ষমতার সঙ্গে দারুণ মমতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়েছেন। যদিও তাঁদের অনেকের গান আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে, তবু তাঁদের সেই জায়গায় রাখি না।

ক্ষমতার সঙ্গে সখ্য শিল্পীর জন্য ক্ষতিকর। ক্ষমতার সঙ্গে সখ্য করলে শিল্পী মানুষের থেকে দূরে চলে যান। ক্ষমতাপুষ্ট শিল্পীরা অনেক বেশি রাজনৈতিক কর্মী হয়ে ওঠেন, শিল্পী কম থাকে। সেটা একজন শিল্পীর ব্যক্তিগত বিষয়, তবে তাঁকে মানুষের কণ্ঠস্বর বলব কি না, তাঁকে শ্রদ্ধা করব কি না, সেটা আমার সিদ্ধান্ত। সেই জায়গা থেকে বলব, পশ্চিমবঙ্গের গানে এখন মানুষের কণ্ঠস্বর কতটা শোনা যাচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। আর দেশের কথা যদি বলি, এখানে সেই সংস্কৃতি কখনোই গড়ে ওঠেনি। আমরা কোনো দিন বিশ্বাসই করিনি, আমরা মানুষের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠতে পারি, ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করতে পারি।

প্রায় দেড় দশক ধরে গান করছেন সায়ান
ছবি: প্রথম আলো
প্রথম আলো:

শিল্পীও তো রাজনীতি করতে পারেন। রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণের বাইরে গায়কি, সুর, কথা দিয়েও তো শিল্পীকে আলাদা করা যায়।

কেন যাবে না, অবশ্যই যাবে। আমি শিল্পী হিসেবে আওয়ামী লীগ, বিএনপি করতে পারি। তবে একটা ব্যাপার থেকেই যায়, দল কখনো মানুষের বিপক্ষে কাজ করলে দলের বিরুদ্ধে আমার কথা বলার স্বাধীনতা থাকবে? যেই স্বাধীনতা একজন শিল্পীর থাকার কথা। রাস্তার যে শিল্পীকে কেউ চেনে না, তারও ওই স্বাধীনতা আছে। তবে এটা রাজনৈতিক দলের অনুগামী বড় কোনো শিল্পীর নেই। খোলা গলায় আমি যতটা আরামে বিএনপি কিংবা আওয়ামী লীগের সমালোচনা করতে পারি, দেশের অনেক বড় বড় শিল্পীর পক্ষেও তা সম্ভব নয়। আমি ক্ষমতার কাছে কোনো সুবিধা নিচ্ছি না, আমি মানুষের সঙ্গে আছি। আমি যখন সুবিধাভোগী কণ্ঠ হয়ে যাই, তখন নিজের কণ্ঠস্বরও হারিয়ে ফেলি। দলভুক্ত শিল্পী হিসেবে আপনার ক্যারিয়ার দাঁড়িয়ে যাবে, কিন্তু আপনি কি মুক্ত কণ্ঠস্বর হতে পারবেন? পারবেন না।

প্রথম আলো:

আপনার রাজনৈতিক দর্শন কী?

আমার রাজনৈতিক দর্শন—লিবারেল ডেমোক্রেসি। আমি মানুষের ক্ষমতায়ন চাই। সাধারণ মানুষ যেন অনুভব করেন, তিনি নিজেই একটি শক্তিশালী পক্ষ। তিনি যেন মনে করেন, বাংলাদেশে ভোট খুব জরুরি। আমি মানুষের আনন্দকে উদ্‌যাপন করতে চাই, নিপীড়িতের কান্নার সঙ্গে থাকতে চাই; এটা আমার ধর্ম। যেখানে অধিকার, সম্মান ক্ষুণ্ন হচ্ছে, সেখানে আমি থাকতে চাই। ক্ষমতা ভালো কাজ করলে প্রশংসা করব না, কাজ করা ক্ষমতার দায়িত্ব। ক্ষমতা মন্দ কাজ করলে সর্বোচ্চ কণ্ঠে নিন্দা করতে চাই। আমার কাছে কখনোই ক্ষমতার প্রশংসা আশা করবেন না।

প্রথম আলো:

কেন?

আপনি যে চাকরি করেন, প্রতিদিন আপনার কাজে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে? আপনি আপনার কাজ করছেন। তাহলে ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তিকে আমি প্রশংসা করব কেন? তিনি তাঁর কাজ করছেন, তিনি আমার সেবক। কাজটা ভালোভাবে করলে খুশি হব, তাই বলে তাঁকে মাথায় তুলে নাচব না। আমি সব সময় মনে করি, ক্ষমতা আমাকে সার্ভ করে। ক্ষমতাকে প্রশংসা করে কথা বলা আমার নিজের অবক্ষয়, অপমান। এটাই আমার রাজনীতি। আমি কখনোই ক্ষমতার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে পারব না। গততেও পারিনি, আজকেও পারিনি, ভবিষ্যতেও পারব না। গত ১৫ বছরে যারা ক্ষমতায় ছিল, তাদের প্রশংসা করিনি। আগামী ১৫ বছরেও যারা থাকবে—তাদের প্রশংসাও করব না।

প্রথম আলো:

প্রতিবাদের গানের বাইরে ‘তার চেয়ে মেনে নাও’; ‘হঠাৎ করেই চোখ পড়েছে’, ‘এক হারিয়ে যাওয়া বন্ধু’, ‘মুখোশ’, ‘ফিরতে ঘরে ভয়’–এর মতো গানে প্রেম আছে, অন্তর্দ্বন্দ্ব আছে; বিরহও আছে। গানগুলো শ্রোতারা গ্রহণও করেছে।  

আমি আমার প্রাণের অনুগত একজন মানুষ। আমার প্রাণ যখন বলছে, ‘আমি কেন প্রতিবাদে যাই’ গান লিখব, তখন লিখেছি। আমার প্রাণ যখন হারিয়ে যাওয়া বন্ধুর জন্য কষ্ট পাচ্ছে তখন ‘এক হারিয়ে যাওয়া বন্ধু’ লিখেছি। প্রাণের কথা শোনার ফলে কিছু গান বেশিসংখ্যক মানুষ গ্রহণ করল। কিছু গান রাজনৈতিক দল গ্রহণ করল, কিছু মানুষের ধারণা, আমি বিএনপির জন্য গান গাই। ‘আমিই বাংলাদেশ’ গানটি ওদের খুব কাজে লেগে গেল। গান গেয়ে শিল্পীকে জেলে যেতে হয়েছে—মাঝে এমন একটি প্রোপাগান্ডা ছড়ানো হয়। পরে আমি ফেসবুকে প্রতিবাদ করি, আমি লেখেছি, এই গান গেয়ে আমি জেলে যাইনি। কোনো দিনই বিএনপির সঙ্গে আমার সংযোগ পাবেন না, আমি বিএনপি–আওয়ামী লীগের চেয়েও অনেক বড় রাজনীতি করি। আমার জায়গা এসব দলের জন্য হারাব না, এটুকু মর্যাদাবোধ আমার আছে। তার মানে এই নয়, তাঁদের রাজনীতি আমি অসম্মান করি।

২০০৮ সালে সায়ানের প্রথম অ্যালবাম প্রকাশিত হয়
ছবি: তানভীর আহমেদ
প্রথম আলো:

গান আপনার জীবিকার অবলম্বন নয়; আপনার বিকল্প পেশা আছে। গানই রুটিরুজি হলে আপনাকে সমঝোতা করতে হতো না?

২০০৮ সালে আমার প্রথম অ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু আমি এ ধরনের গান করছি ১৯৯৮ সাল থেকে। গানে আসার আগেই জানতাম, গান করে খেতে পারব না। কিন্তু আমার কাছে অঙ্গীকার ছিল, চাকরিতে বস যেটা বলবেন, সেটা মাথা নিচু করে লিখে দেব কিন্তু গান আমি মাথা উঁচু করে গাইব। আমি গান লিখি, সুর করি—পারফর্মিং আর্টের মানুষ। নিয়মিত রেওয়াজ করতে হবে। গান সুরে গাইতে না পারলে আপনার প্রাণকে স্পর্শ করবে না।
মাঝে আইনের পড়াশোনা করেছি, শিক্ষকতা করেছি—গানের বাইরে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কাজ করেছি। আমি কোনো দিন ভাবতেও পারিনি, গান করে টাকা আসবে। এটা আশাতেও ছিল না। তা–ও যতটুকু এসেছে, সেটাও অবাক করা ব্যাপার। বাংলাদেশের মতো জায়গায় এ ধরনের গানের চর্চাই নেই। লোকে এখনো আমাকে গান গাইতে ডাকে—সেটার জন্য আমি খুবই কৃতজ্ঞ। আমার জীবিকার সংগ্রাম দীর্ঘকাল ধরে ছিল। আমি চাকরি করার সময় মনে করতাম, কবে এই চাকরি থেকে বের হয়ে আসতে পারব; সারাক্ষণ গান গাইতে পারব। শিল্পীর আলস্যভরা স্বাধীনতা অনেক দিন ছিল না, ২০১৫ সাল থেকে আস্তে আস্তে পুরোদমে গানের দিকে আসতে থাকি। আমার বয়স ৪৭ হওয়ার আগপর্যন্ত ওই সংগ্রামটা কোনো না কোনো মাত্রায় ছিল। কিছুদিন হলো, ওই স্বাধীনতাটা এসেছে। রুটিরুজির চিন্তাটা আগের তুলনায় কমেছে।

প্রথম আলো:

আপনি বলছিলেন, আপনার গান কেউ প্রকাশ করতে চাইছিল না। তবু কীভাবে লেগে থাকার অনুপ্রেরণা পেলেন?

তখন আমার বয়স ছিল ২৭ বছর। ওই সময়ে দুটো রেকর্ড কোম্পানির পেছনে পেছনে ঘুরলাম, চুক্তিতেও আবদ্ধ ছিলাম। কিন্তু কোনো গান প্রকাশ করলেন না। আমার গান নিয়ে কেউ স্বস্তিবোধ করেনি। শুনেছি, এই গান দিয়ে ব্যবসা করা যাবে না, এখনও মুনাফা করা যায় না। আমি ভীষণভাবে স্বপ্নবাজ মানুষ। শেষ পর্যন্ত গানটাই করতে চেয়েছিলাম, সেই সংগ্রামটা আমার প্রাপ্য ছিল। ফুল বিছানো পথে আপনাকে বরণ করা হবে—এটা অলীক ব্যাপার। আমি খুবই আনন্দিত, ওই কষ্টটা করার সুযোগ পেয়েছি। আমি এখনও খুব জনপ্রিয় শিল্পী না কিন্তু আমি জনমানুষের কাছাকাছি একজন শিল্পী।একজন শিল্পী।

এই বছরের জানুয়ারিতে প্রথম আলো কার্যালয়ে গাইছেন সায়ান
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন
প্রথম আলো:

এখন তো রেকর্ড লেবেলকে তোয়াজ করতে হয় না। নিজের গান নিজেই রেকর্ড করে ফেসবুক, ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশ করতে পারছেন। ডিজিটাল মাধ্যম আপনাকে কতটা স্বাধীনতা দিয়েছে?

সাংঘাতিকভাবে স্বাধীনতা এসেছে। গত পাঁচ বছরে কোনো টিভি চ্যানেলের সঙ্গে তেমন কোনো সম্পর্ক নেই। আপনাকে যদি বলে দেওয়া হয়, এই গান গাইবেন না, এটা করবেন না, তাহলে ভাই আমাকে ডাকেন কেন? ফুল-পাখির গান করার জন্য আমাকে চেনেন? আমাকে এই জন্য ভালোবাসেন, গানে আপনার মনের কথা বলার চেষ্টা করি। আস্তে আস্তে ওই জায়গাগুলো সংকুচিত হয়ে গেল। তখন বিকল্প মাধ্যমগুলো আসায় আমার ভীষণ লাভ হয়েছে। নিজের গান রেকর্ড করে সেটা নিজের চ্যানেলে প্রকাশ করি। আমাকে কারও ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে না, স্বাধীনভাবে আজীবন গান করে যেতে পারব।

প্রথম আলো:

নিজেই গান লেখেন, সুর করেন, কণ্ঠে তোলেন। বাদ্যযন্ত্রও বাজান। এই ভাবনাটা পেলেন কীভাবে?

আমি তিনটা জায়গায় সৎ থাকার চেষ্টা করেছি—গান লেখা, সুর ও গাওয়া। সঙ্গে গিটার, পিয়ানো, হারমোনিয়াম থাকে; এগুলো আমি ভালো বাজাই না। আমার কি–বোর্ড গভীর মাপের বাজনা থাকে না, তবে এতে আমার প্রাণের মধ্যে আরাম লাগে। এটা আমাকে শান্তি দেয়।

প্রথম আলো:

আপনার গান কথাপ্রধান। ফলে আপনি গাইছেন, আপনিই বাজাচ্ছেন—এই পরিবেশনাই শ্রোতারা গ্রহণ করেছে। এর বাইরে স্টুডিওতে জোরালো বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে আপনার গানের কথা ততটা জোরালো লাগে না।

এটা একদম শতভাগ সহমত। কিন্তু আমি বাজনা দিয়ে গান প্রকাশ না করলে আপনি আমাকে বাজারে যতটুকু শিল্পী মানেন, সেটাও মানবেন না। একজন বাউলশিল্পী একতারা দিয়ে গান করতে পারে—সেটাকে মানার মতো সংস্কৃতি বেড়ে ওঠেনি। সেই কারণে আমি দুটি ভার্সন করি। আমি সব সময় একটা যন্ত্র দিয়ে একা গান করতে ভালোবাসি। আমার প্রাণের পুরোটা সেখানে প্রকাশিত হয়; বাজনাসহ গানটি বাজারি প্রকাশ হয়।

প্রথম আলো:

সংগীতে কে আপনাকে প্রভাবিত করেছেন?

আমার গানে বহু শিল্পী ও মানুষের প্রভাব রয়েছে। তবে একজনের কথা না বললেই না, শাহনাজ রহমতউল্লাহ। অনেকে অবাক হয়ে যান, আমি তো জীবনমুখী গান করি। তাহলে তিনি প্রভাবিত করলেন কীভাবে? ছোটবেলায় রাতভর ওনার গান আমি শুনতাম। তাঁর হারমোনিয়ামে তুলে রেওয়াজ করতাম। একটা মানুষ শুধু কণ্ঠ দিয়ে গান গায় না, দুঃখ দিয়ে গান গায়। আত্মাটাকে সুরের ভেতরে প্রকাশ করাটা তাঁর গানে পেয়েছি। পৃথিবীতে আমার সবচেয়ে প্রিয় শিল্পী শাহনাজ রহমতউল্লাহ।

প্রথম আলো:

শাহনাজ রহমতউল্লাহর সঙ্গে কখনো সাক্ষাৎ হয়েছিল?

গানে আসরে একটা করে হলেও ওনার গান গাইতাম। উনি অনেক বড় মানুষ, ওনার কাছে গিয়ে বিরক্ত করতাম না। তিনি নিভৃত থাকতেন, তাঁকে ভালোবাসতাম। তবে তার জন্য কখনো মনে হয়নি, ওনার সঙ্গে সখ্য করতে হবে। একদিন তিনি আমাকে ফোন করে বললেন, তুমি আমার বাসায় এসো। আমার মধ্যে সমীহের ভয় করেছিল, আমি তোতলাতে শুরু করলাম। বাসায় ডেকে আমাকে বললেন, গান গাও। আমি কী করে তাঁকে গান শোনালাম, জানি না। তিনি পৃথিবীতে নেই, তাঁর গান আমি এখনো গাই। আমার ইচ্ছা, তাঁর কয়েকটি গান পিয়ানো ও গিটারে গেয়ে প্রকাশ করব।

প্রথম আলো:

আপনি তো জেমসের গানও পছন্দ করেন।

জেমসকে নিয়ে আমি গর্বিত। শরীরী ভাষা, সুর, গিটার—সব একাকার হয়ে যায়। আমি জেমসের ভক্ত। তাঁকে ভালোবাসি, তাঁর গান ভালোবাসি।

প্রথম আলো:

সামনে কী গান আসছে?

বেশ কয়েকটি গান নিয়ে কাজ করছি। শিগগির প্রকাশ করব।

আরও পড়ুন