প্রথম আলো :
শিল্পী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক নিপুণ আপনাদের (মিশা-ডিপজল) মূর্খ বলেছেন, এমনকি আপনাকে মিথ্যুকও বলেছেন। বিষয়টি নিয়ে আপনার কী বলার আছে।
মিশা সওদাগর : কথা বলার জন্য আমরা এখন অবশ্য মুখপাত্র ঠিক করে দিয়েছি। মুখপাত্র ছাড়া শিল্পী সমিতি নিয়ে কেউ কথা বলবে না। তারপরও যেহেতু আপনি ফোন করেছেন, বলতে চাই—আমরা যেহেতু শিল্পী, নিজেকে যে যে ক্যাটাগরির শিল্পীই ভাবি না কেন, আমাদের শব্দচয়নে সংযত হলে সম্মানিত বোধ করি। আমি ঢাকাইয়া, ভিলেনের চরিত্রে অভিনয় করি—তিনবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছি। তিন যুগ ধরে অভিনয় করছি। আমি কমিটেড না হলে অভিনয়জীবন তো কোনোভাবে তিন যুগের হতো না। চলচ্চিত্রের আমরা একে অপরকে যে কথাই বলি না কেন, অবশ্যই সংযত হয়ে বলা উচিত। নিপুণের সঙ্গে শুটিংয়ের বাইরে কিন্তু কোনো দিন বসে আমি এক কাপ চা-ও খাইনি। দেশ-বিদেশে তিনটি অনুষ্ঠান করেছি, তা-ও কমিটমেন্ট ঠিক রেখে। সেই আমাকে নিপুণ কথাটা কোন ভিত্তিতে বলল, পুরো ইন্ডাস্ট্রির কাছে প্রশ্ন রইল। ৩ যুগ ধরে কাজ করছি, ১০টার মতো স্ক্রিপ্ট এখনো হাতে আছে। তাহলে চলচ্চিত্রের মানুষেরা এত লম্বা সময় ধরে আমার সঙ্গে কাজ কীভাবে করল! এমন কথা নিপুণের বলার আগে আমার ব্যক্তিত্ব নিয়েও তার ভাবা উচিত ছিল, আমি কাদের কাদের সঙ্গে এত লম্বা সময় ধরে কাজ করেছি। আমি যদি মিথ্যুকই হতাম, তাহলে এত লম্বা সময় ধরে কোনো প্রযোজক, পরিচালক আমাকে নিয়ে কি কাজ করতেন? নিপুণ কিন্তু আমার অনেক জুনিয়র, বয়সেও ছোট, ছোট বোনের মতো হবে—আমার ব্যক্তিত্বকে নিয়ে এভাবে বলাটা গোটা চলচ্চিত্র পরিবারকে ছোট করা হলো।
এটা নিয়ে কি কোনো আক্ষেপ আছে কি না?
মিশা সওদাগর : না না, কোনো আক্ষেপ নেই। কিছু করার কথাও ভাবছি না। আমার সমিতি আছে, সমিতির গঠনতন্ত্র আছে...তারা ভাববে।
প্রথম আলো :
যেহেতু নিপুণের কথায় আপনার সংগঠনের সাধারণ সম্পাদকের নামও জড়িয়ে আছে, এটা নিয়ে কি তাহলে সাংগঠনিকভাবে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে?
মিশা সওদাগর : সাধারণ সম্পাদককে যেসব কথা বলেছে, এটা কিন্তু সবাই দেখেছে। আমাদের গঠনতন্ত্রেও আছে—শিল্পী সমিতি নিয়ে কোনো অবমাননাকর, আপত্তিকর মন্তব্য কেউ করলে তাঁর সদস্যপদ খারিজ কেন হবে না, সাত দিনের মধ্যে জানাতে হয়। এরই মধ্যে তাকে বিষয়টি জানানো হয়েছে। নোটিশ করেছি। আমরা তো তার মতো না, আমরা নিয়ম মেনে সব করতে চাই।
আপনার কথায় এটা পরিষ্কার, শিল্পী ও চলচ্চিত্রের মানুষদের কথা বলায় সংযত হতে হবে। পারস্পরিক শ্রদ্ধার বিষয়টিও খেয়াল রাখতে হবে। আপনার সাধারণ সম্পাদক ডিপজল সাবেক সাধারণ সম্পাদক নিপুণকে নিয়ে মন্তব্যে বলেছেন, ‘কেস খেলবা আসো। যেটা খেলার মন চায় সেটাই খেলো।’ এমন কথা নিয়েও নিপুণের আপত্তি আছে। কী বলবেন?
মিশা সওদাগর : না, তার আগে তো নিপুণ কেস করে ফেলছে। তারপর এ-ও বলছি, প্রত্যেকের একটা কথা বলার ধরন আছে। সবচেয়ে ভালো হয়, প্রশ্নটা ডিপজল ভাইকেই করা উচিত। চলাফেরা, বাচনভঙ্গি, শব্দচয়ন, শারীরিক, মানসিক ও শাব্দিক সত্তা মিলিয়ে একজন মানুষের ব্যক্তিত্ব হয়। আমরা শুনেছি, আগেই কেস করে ফেলা হয়েছে। পেপার-পত্রিকায়ও চলে আসছে। আমরা কপি পাইনি বলেই হয়তো কথা বলি নাই।
প্রথম আলো :
কিন্তু সভাপতি হিসেবে সাধারণ সম্পাদকের এমন মন্তব্য বিষয়ে কী বলবেন?
মিশা সওদাগর : ডিপজল ভাই তো কোনো খারাপ শব্দ বলেন নাই। ডিপজল ভাইয়ের কথা বলার স্টাইল আলাদা, আমারটাও আলাদা। কথা বলার পদ্ধতিটা আমরা লালন করি, তা একদিনে সম্ভব না। আর এ ধরনের কথা ডিপজল ভাইয়ের একদম স্বাভাবিক কথা।
প্রথম আলো :
আচ্ছা কয়েক বছর ধরে কথায় কথায় চলচ্চিত্রের একটা অংশের মানুষকে খুব অসহিষ্ণু আচরণ করতে দেখা যায়। শিল্পী সমিতিতে এটা বেশি দৃশ্যমান। কী বলবেন এই ব্যাপারে...
মিশা সওদাগর : আমি কোনো দিন কোনো শিল্পী নিয়ে কোনো কথা বলিনি। এটা উচিতও না। চলচ্চিত্রের মানুষদের আমাদের অবশ্যই কথা বলায় সহিষ্ণু হওয়া উচিত, পারস্পরিক শ্রদ্ধা থাকা উচিত। শব্দচয়নে সতর্ক থাকা উচিত। এমন কোনো কথা বলা উচিত নয়, যাতে চলচ্চিত্র সম্পর্কে নেতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি হয়। সহকর্মীরা মনে কষ্ট পান।
আচ্ছা, নিপুণ নির্বাচনের পরদিন সকালে আপনাদের ফুলের মালা পরিয়ে দিলেন। এরপর কথাবার্তাও হলো। চার সপ্তাহ পর এসে এই যে রিট করলেন, এসব কেন করছেন বলে মনে করছেন?
মিশা সওদাগর : হয়তো পরাজয় মেনে নিতে পারছে না। পেছন থেকে কেউ না কেউ নিপুণের কলকাঠি নাড়ছে। কারও কথায় এসব করতেছে। গতবারও কিন্তু তো সে জায়েদের কাছে ১৩ ভোটে হেরেছে। পরপর দুবার হারল। তার ধারণা থাকতে পারে, সে জিতবে। কিন্তু জেতেনি, এটাই বাস্তবতা। কাগজে-কলমেও লেখা, সে পরাজিত। একবার ইসি পদেও নির্বাচন করেছিল, সেখানেও হেরেছে। কিন্তু ব্যর্থতাকে মেনে না নেওয়া তো খেলার অংশ হতে পারে না—এটা মানতে হবে। একটা কথা কি, নিপুণ তো কোনো দিন চাইলেও শাবনূর, মৌসুমী হবে না। এটা দর্শকেরা বানান। মিশা সওদাগরকে দর্শক বানিয়েছেন। আমিও কিন্তু শিল্পী সমিতির নির্বাচনে শুরুতে ইসি ছিলাম, এরপর কালচারাল সেক্রেটারি, তারপর সেক্রেটারি, এরপর ভাইস প্রেসিডেন্ট এখন মিলিয়ে তিনবারের প্রেসিডেন্ট। রাজনৈতিকভাবেও যদি উদাহরণ দিই, তৃণমূল থেকে উঠে আসা। বলতে চাই না তারপরও বলতে হচ্ছে, আমার কললিস্টে আছে, নিপুণ আমাকে একাধিকবার ফোন করেছে। লোক পাঠিয়েও কথা বলেছে—আমাকে তার প্যানেল থেকে সভাপতি করতে চেয়েছিল। শাকিব খানকেও চেয়েছিল। তার আগে পত্রপত্রিকায় যখন দেখছি, নিপুণ একে প্রেসিডেন্ট চায়, ওকে চায়, ডিপজল ভাইকে বলেছেন—তিনিও না করে দিয়েছেন। আর আমি করিনি। কারণ, ডিপজল ভাইকে কথা দিয়ে দিয়েছি। তবে নিপুণের যেন শুভবুদ্ধির উদয় হয়। আশা করব সে আরও ধৈর্যশীল হবে। আমি তাকে দেখতে চাই একজন অভিনেত্রী হিসেবে। আমার জুনিয়র হিসেবে। সহকর্মী ও সহযোদ্ধা হিসেবে। নির্বাচনের পরদিন সে যে মননশীল, ধীশক্তিসম্পন্ন উদ্ভাবনী চিন্তা নিয়ে আমাদের ফুলের মালা পরিয়েছিল, তাতে আমাদের মস্তিষ্ক অক্সিজেন পেয়েছিল—চাইব এটার ধারাবাহিকতা বজায় রাখুক, তাহলে অনেক ভালো কিছু হবে, চলচ্চিত্রের জন্যও তা ইতিবাচক বার্তা দেবে।
আচ্ছা, শুধু ডিপজলকে কথা দেওয়ার কারণে নাকি অন্য কারণে নিপুণের সঙ্গে নির্বাচন করতে চাননি?
মিশা সওদাগর : নিপুণকে আমি পছন্দ করি কিন্তু। ওকে পছন্দ না করার বিন্দুমাত্র কোনো কারণ নাই। তবে আমি যে নিপুণকে পছন্দ করতাম, তাকে এখন অচেনা লাগছে। সে ডিপজল ভাইকে নিয়ে যে শব্দ ব্যবহার করল, এটা দুঃখজনক।
প্রথম আলো :
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি একটি অলাভজনক সংগঠন। এরপরও এই সমিতির নির্বাচন ঘিরে বারবার কেন জটিলতা তৈরি হয়? শিল্পীদের মধ্যকার বোঝাপড়ার সমস্যা, রেষারেষিও দৃশ্যমান এই নির্বাচন ঘিরে। মামলা-হামলায় আদালত পর্যন্ত যাওয়ার ঘটনাও ঘটছে।
মিশা সওদাগর : শুনতে খারাপ লাগবে, মানুষ যখন যোগ্যতার চেয়ে বেশি পেয়ে যায়, তখনই এমনটা ঘটে। তবে আপনারা দেখেন, আমি ও শাকিব খান যখন শিল্পী সমিতিতে ছিলাম, তখন কিন্তু এমনটা হয়নি। তার আগে তো এমনটা শোনাও যায়নি। শাকিব-আমি যখন শিল্পী সমিতিতে আসি, তখন শাকিব তার জায়গায় সেরা, আমিও। শাকিবকে জাতি চেনে, বাংলাভাষীরাও চেনে। মিশাকেও তা-ই। এরপর যখন কাদা-ছোড়াছুড়ি আরম্ভ হলো, তা শুধুই অনভিজ্ঞদের কারণে। আমি বলব জায়েদ-নিপুণদের কারণে। তারা কেউই আবার কার্যনির্বাহী থেকে আসেনি। গতবার নিপুণ কীভাবে সাধারণ সম্পাদক হয়েছিল, তা নিয়ে আমি কথা বলতে চাই না, এটা সবাই জানেন। ইসি থেকে পর্যায়ক্রমে যদি আসত, তাহলে হয়তো এই সমস্যা হতো না। এখন প্রশ্ন আসতে পারে, শাকিব খান তো সরাসরি সভাপতি নির্বাচন করেছেন। কিন্তু এটাও ঠিক, শাকিবের পেছনে মিশার মতো দক্ষ একজন সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। হামলা-মামলা মূলত জায়েদ খান-নিপুণদের আমলে হয়েছে। আমি-মৌসুমী দাঁড়িয়েছি, ওমর সানীও দাঁড়িয়েছিল—কোনো সমস্যা হয়নি। সমালোচনা হয়নি। হয়েছে যা, সেটা শুধুই আলোচনা। কারণ, আমরা স্টার। কিন্তু জায়েদ-নিপুণ কতটা স্টার, তাদের কতটুকুই স্টারডম আছে, এটাও সবাই জানেন। তারা যখন শিল্পী সমিতির নেতা হয়ে গেছে, যেভাবেই হোক হয়ে গেছে—শিল্পীরা হামলা-মামলা করেন তখন থেকেই মানুষ জানল। শিল্পীরা আবার হামলা করেন কীভাবে, মামলা করেন কীভাবে! জায়েদ-নিপুণরা হামলা-মামলার মতো কাজ করে শিল্পী সমিতির পদকে ছোট করেছে। তারা কেউই কিন্তু শিল্পী সমিতির নির্বাচনের আগে যথেষ্ট পরিমাণে ফোকাসড ছিল না। শিল্পী সমিতির চেয়ার দিয়েই পরিচিতি পেয়েছে। এটাই তাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই হামলা-মামলার মতো ঘটনাও তাদের সময়ে ঘটেছে। তারা প্রকৃত শিল্পীদের সম্মানের বিষয়টার কদর বুঝতে পারেনি। সম্মান হারালেও তাই তাদের কিছু যায় আসে না। তারা শিল্পীসত্তায় বিচার করে নাই। প্রকৃত শিল্পীদের দর্শকেরাই দেশ-বিদেশ চিনিয়েছে। প্রযোজক, পরিচালক, পরিবেশকেরাই চিনিয়েছে। আর জায়েদ-নিপুণকে শিল্পী সমিতির চেয়ারই মানুষের কাছে চিনিয়েছে। কোনো চেয়ার আমাকে মানুষের কাছে পরিচিত করে নাই। একজন শিল্পী কিন্তু শিল্পী সমিতি দিয়ে নন, শিল্পী তাঁর সৃজনশীল কাজ দিয়ে। ইতিহাসে কাজই থাকে। একজন প্রকৃত শিল্পী নেতৃত্বে থাকাটা শিল্পী সমিতির জন্য সুন্দরের। কারণ শিল্পী হিসেবে প্রমাণিত তাঁরা। যখন থেকেই চলচ্চিত্রের মানুষেরা মামলা-হামলায় জড়িয়েছেন, তখন থেকে আলোচনা নয়, সমালোচনা তাঁদের কপালে জুটেছে। এতে করে প্রকৃত শিল্পীদের সম্মানটাই নষ্ট হয়েছে, হচ্ছে। গোটা চলচ্চিত্রের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে।
প্রথম আলো :
নিপুণ-জায়েদের অনভিজ্ঞতার কথা বললেন। কিন্তু জায়েদকে নিয়েই তো আপনি আবার নির্বাচন করলেন।
মিশা সওদাগর : জায়েদ তো সাংগঠনিকভাবে সফল। বিচক্ষণ। সাংগঠনিকভাবে সে অনেক কাজ করেছে। তবে জায়েদের ব্যক্তিগত কোনো বিষয় ঠিক করার মানুষ আমি না।