শিল্পীকে কালোতালিকাভুক্ত করা এক রকম সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড: বেবী নাজনীন

দীর্ঘ সময় ধরে যুক্তরাষ্ট্রে ছিলেন সংগীতশিল্পী বেবী নাজনীন। দেড় দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বেতারের কোনো অনুষ্ঠানে দেখা যায়নি তাঁকে। ১৯ বছর পর বাংলাদেশ টেলিভিশনে ঈদের একক গানের অনুষ্ঠান ‘প্রিয়তম, একটু শোনো’–তে দেখা যাবে বেবী নাজনীনকে। বিশেষ সংগীতানুষ্ঠনে আটটি গান নিয়ে তৈরি হয়েছে। এর বাইরে এবারের ঈদে আরও দুটি টেলিভিশন চ্যানেলের অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন তিনি। এসব নিয়ে শনিবার তাঁর সঙ্গে কথা বললেন মনজুর কাদের

প্রথম আলো:

বাংলাদেশ টেলিভিশনে সর্বশেষ কোন অনুষ্ঠানে গেয়েছিলেন মনে পড়ে?

বেবী নাজনীন : যত দূর মনে পড়ছে, ‘ইত্যাদি’ অনুষ্ঠানে সবশেষ গেয়েছিলাম, তা–ও ২০০৬ সালে। এরপর সরকার বদল হয়। তারপর থেকে বিটিভি–বেতারসহ রাষ্ট্রীয় সব অনুষ্ঠানে কালোতালিকাভুক্ত ছিলাম।

প্রথম আলো:

বিটিভি ঈদের অনুষ্ঠান নিয়ে কবে থেকে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করছে?

বেবী নাজনীন : অনেক দিন ধরে বিটিভি কর্তৃপক্ষ গানের অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার প্রস্তাব দিচ্ছিল। দেশে ফেরার পর স্টেজ শো ও রাজনৈতিক ব্যস্ততায় সময়–সুযোগ হচ্ছিল না। এর মধ্যে তারা আবার ঈদের অনুষ্ঠানের প্রস্তাব দেয়। তারপর একটা পর্যায়ে সময় বের করি। আটটা গান নিয়ে একক গানের অনুষ্ঠান। বিটিভি কিন্তু আমাদের হৃদয়ে। তাই এত বছর পর প্রস্তাব পেয়ে ভীষণ আবেগপ্রবণ হই। আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ গণমাধ্যম বিটিভি থেকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সংস্কৃতির প্রচার–প্রসারের কাজ হয়। সেখানেই এতটা বছর উপেক্ষিত ছিলাম!

‘প্রিয়তম, একটু শোনো’ গানের অনুষ্ঠানে বেবী নাজনীন
ছবি : শিল্পীর সৌজন্যে

প্রথম আলো :

অনুষ্ঠানে কোন গানগুলো গাইলেন?

বেবী নাজনীন : শ্রোতাপ্রিয় এবং আমার নিজের প্রিয় গানগুলোই গেয়েছি। এই তালিকায় আছে ‘কাল সারা রাত, ‘দুচোখে ঘুম আসে না’, ‘প্রিয়তম, একটু শোনো’, ‘মধুচন্দ্রিমার এই রাত’, ‘বন্ধু তুমি কই কই’, ‘দারুণ বরষায় নদী’, ‘সারা বাংলা খুঁজি তোমারে’ ও ‘খোলা হাঁটির বালুচরে’।

আরও পড়ুন
বেবী নাজনীন
ছবি : শিল্পীর সৌজন্যে
প্রথম আলো:

এত বছর পর যখন বিটিভির প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকছিলেন, কেমন অনুভূতি হয়?

বেবী নাজনীন : বিটিভি আমার ভীষণ আবেগের একটা জায়গা। আমাদের সময়টায় একজন শিল্পীর বিকাশের ক্ষেত্রে বিটিভির একটা বিরাট ভূমিকা রয়েছে। আমরা যারা বিটিভিতে বিভিন্ন অনুষ্ঠান করেছি, যেমন ভালো ভালো গানের অনুষ্ঠান, নাটক দেখেছি, তাদের কাছে বিটিভির ব্যাপারস্যাপারই আলাদা। এই প্রতিষ্ঠানকে অতিক্রম করাটা কারও পক্ষেই সম্ভব ছিল না। আমার কাছে মনে হয়, বিটিভির যে অবকাঠামো তাতে এ–ও বিশ্বাস করি, এখনো যদি সৃজনশীল যোগ্য মানুষ দ্বারা পরিচালিত হয়, তাকে এখনো কেউ বিট করতে পারবে না। সুন্দর সুন্দর পরিকল্পনা দরকার। সিনসিয়ার মানুষ দরকার। মনে রাখতে হবে, রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে যেটা প্রচার হয়, সেটার প্রভাবও কিন্তু বেশি। যে অবস্থায় দেখেছিলাম, বিটিভির যে রমরমা ব্যাপার ছিল, জৌলুশ ছিল; এবার গিয়ে দেখলাম প্রাণহীন একটা প্রতিষ্ঠান। আমি ঘুরে ঘুরে দেখেছি। আমার মনে হয়েছে, কলাকুশলী দরকার, পরিচালনার জন্য দক্ষ মানুষ দরকার। সৃজনশীলদের সম্পৃক্ততা অনেক বেশি দরকার। মোটামুটি বলতে পারি, প্রতিষ্ঠানটিকে শতভাগ সংস্কার করতে হবে।

প্রথম আলো :

আপনি শিল্পীদের কালোতালিকার কথা বলছিলেন...

বেবী নাজনীন : শিল্পীদের কালোতালিকার বিষয়টি মোটেও গ্রহণযোগ্য না। শিল্পীকে কালোতালিকা করা একরকম সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। কালোতালিকার ঘটনা শিল্পীর মনোবল যেমন ভাঙে, তেমনি তাঁকে অর্থহীন করে দেয়। কর্মক্ষেত্রকে তাঁর কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়। শিল্পী যেন তাঁর সৃষ্টিশীল কাজ করতে না পারে, কালোতালিকার মাধ্যমে শিল্পীকে পঙ্গু করে দেওয়া হয়। এগুলো অমানবিক কর্মকাণ্ড। শিল্পীকে কেউ তৈরি করতে পারে না। একজন শিল্পী তাঁর মেধা, অধ্যবসায়, যোগ্যতা, চেষ্টা, দীর্ঘদিনের চর্চার মাধ্যমে ম্যাচিউরড শিল্পী হয়। যখনই একজন শিল্পী ম্যাচিউরড হয়, তখনই সেই শিল্পী দেশকে সমৃদ্ধ করার জন্য তৈরি হয়। যখন সেই শিল্পী তৈরি হয়, তার কাছ থেকে রাষ্ট্র সেই আউটপুট নেওয়ার চেষ্টা করবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তা না করে, শুধু রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে কালোতালিকা করে পিছিয়ে দেওয়া হয়। শিল্পীকে নানা ট্যাগিং করে এমনভাবে উপস্থাপন করে—যেন ফাঁসির আসামি।

‘প্রিয়তম, একটু শোনো’ গানের অনুষ্ঠানে বেবী নাজনীন
ছবি : শিল্পীর সৌজন্যে
প্রথম আলো:

আগামীর বাংলাদেশের শিল্পীদের জন্য কেমন পরিবেশ চান?

বেবী নাজনীন : রাজনীতির প্রতি সমর্থন বা রাজনীতি সব মানুষই করতেই পারে। যেকোনো শিল্পীও করতে পারে। এটা তাঁদের সাংবিধানিক অধিকার। রাজনৈতিক সংস্কৃতির সৌন্দর্য হচ্ছে যেকোনো শ্রেণি, পেশা, ধর্ম–বর্ণের মানুষ রাজনীতি করবে। শিল্পীদের ক্ষেত্রে বলব, শিল্পীর জায়গায় শিল্পী, রাজনীতির জায়গায় রাজনীতি। কোনো শিল্পীর উচিত না রাজনৈতিক প্রভাব সংস্কৃতিতে খাটাবে। রাজনীতি দিয়ে কেন শিল্পীকে মূল্যায়ন করবে। শিল্পী তাঁর শিল্পকর্ম দিয়ে মূল্যায়িত হবে। আবার শিল্পীদেরও উচিত হবে না, রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার পর এমন কিছু না করা, যা তাঁর শিল্পী জীবনকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। সংস্কৃতিতে রাজনীতি ঢুকিয়ে দেওয়া মানে দেশের অবকাঠামোকে ধ্বংস করে দেওয়া। আজকে যদি শিল্পী কলাকুশলী না থাকে সংস্কৃতির বিকাশ হবে কীভাবে।

প্রথম আলো :

বিটিভির বাইরে আরও কোনো চ্যানেলের জন্য গাইছেন?

বেবী নাজনীন : এই ঈদে একাত্তর ও যমুনা টেলিভিশনের দুটি অনুষ্ঠান করেছি। এসব অনুষ্ঠানে সংগীত ও রাজনৈতিক ভাবনাচিন্তা, দর্শন নিয়ে কথা বলেছি। অনেক বছর পর ঈদে কয়েকটি টেলিভিশন অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে ভালো লেগেছে। আসলে আমরা যারা শিল্পী, তাদের সঙ্গে গণমাধ্যমের সম্পর্কটা পরিবারের মতো।

প্রথম আলো:

আপনার কাছ থেকে নতুন গান কবে পাওয়া যাবে?

বেবী নাজনীন : নতুন গানের কাজ চলছে। তবে একটু সময় লাগবে। কারণ, দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা দরকার। দেশ যদি রাজনৈতিকভাবে স্থিতিশীল না হয়, দেশে সুখের কর্মকাণ্ডও হয় না। গান তো একটা সংবেদনশীল বিষয়, যা মানুষ ভেতরে ধারণ করে। মনমানসিকতাকে সঠিক পথে পরিচালিত করে। সেই জায়গা থেকে শিল্পীদের কাছে দেশের পরিবেশ–পরিস্থিতি ভালো থাকা গুরুত্বপূর্ণ। আমি পৃথিবীর অনেক দেশে গিয়েছি, অনেক দেশের মানুষের সঙ্গে মিশেছি, শিল্পীদের সঙ্গে দেখা–সাক্ষাৎ হয়েছে—সেখানকার অনেক শিল্পী, সাহিত্যিক ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শ ধারণ করেন। দেশে রাজনৈতিক সংকটও তৈরি হয়। কিন্তু শিল্পীদের নিয়ে আমাদের এখানকার মতো সংকট তৈরি হয় না। সবাইকে একটা সিস্টেমের মধ্য দিয়ে চলতে হয়। সিষ্টেম কখনোই সংস্কৃতিতে ডমিনেন্ট না করে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলেও শিল্প–সংস্কৃতিতে তার প্রভাব পড়ে না। একে ব্ল্যাক লিস্ট করো, ওকে বের করে দাও—এসব নেই। এসব হীনম্মন্যতা। উন্নত সব দেশে এসব নেই। রাষ্ট্রের দুটি দলের মধ্যে হয়তো আদর্শ নিয়ে দ্বন্দ্ব হচ্ছে, তা হতেই পারে; কিন্তু সেখানে দেশের প্রতিভাবানদের যুক্ত করে তাদের কোণঠাসা করবে, এমনটা কোথাও নেই।

বেবী নাজনীন
ছবি : শিল্পীর সৌজন্যে
প্রথম আলো:

দেশে ফেরার পর এখন আপনি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যাচ্ছেন। এসব অনুষ্ঠানে আপনার সমসাময়িকদের পাশাপাশি তরুণ শিল্পীদের সঙ্গেও দেখা হচ্ছে। সবকিছু মিলিয়ে আমাদের দেশের সংগীতাঙ্গন ও তরুণ শিল্পীদের নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?

বেবী নাজনীন : আমিও একসময় নতুন ছিলাম, আমাদের তখন অনেক ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছিল। কিন্তু আমাদের পরের প্রজন্মের কারও জন্য এই ভোগান্তি চাই না। আমি চাই না, কোনো শিল্পী ভয় পাক। তরুণদের অভিজ্ঞতা না হতেই আমরা যদি তাদের ভয়ের রাজ্যে ঠেলে দিই, তাহলে তাদের বিকাশ হবে কীভাবে? বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবস্থার কারণে সবার মধ্যে একটা অজানা ভয় কাজ করে। আমাদের দেশে এখন সেই অর্থে কোনো পেশাদার রেকর্ডিং প্রতিষ্ঠান নেই, যারা শিল্পীদের নিয়ে কাজ করছে। নিজেদের মতো করে তারা শুধু ব্যবসাই করছে, শিল্পের প্রতি তাদের যেন কোনো দায়বদ্ধতা নেই। রাষ্ট্রের উচিত, শিল্পীদের মর্যাদা দিয়ে তাদের মতো কাজ করার পরিবেশ দেওয়া, শিল্পীরাই তারপর তাদের মতো করেই দেশকে সমৃদ্ধ করে দেবে। সুনাম বয়ে আনবে। আমাদের সংগীতাঙ্গনের ছোট ভাইবোন যারাই গাইছে, কী যে ভালো গায়। কিন্তু তারা আসলে বোঝে না, স্থায়ীভাবে ভালো করতে হলে তাদের কী করতে হবে। একটা পর্যায়ে পৌঁছাতে হলে কীভাবে নিজেদের উন্নয়ন করতে হবে। ক্যারিয়ার উন্নত করার ক্ষেত্রে তারা যেন ভয় না পায়। আমি মনে করি, রাষ্ট্রকে উচিত শিল্পীর চলার পথকে সুরক্ষিত করা।