মায়ের চেইন বিক্রির টাকায় প্রথম শর্ট ফিল্ম বানাই

এই মুহূর্তে ঢালিউডের আলোচিত পরিচালক রায়হান রাফি। তাঁর পরিচালিত ‘পরাণ’ ছবিটি চার সপ্তাহের বেশি সময় ধরে দেশের বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শিত হচ্ছে। ছবির সাফল্য ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে কথা হলো তাঁর সঙ্গে

নির্মাতা রায়হান রাফি। ছবি : ফেসবুক থেকে

প্রশ্ন :

‘পরাণ’ নানা দিকে প্রশংসিত। পরিচালক হিসেবে এই সাফল্য আপনাকে কীভাবে উজ্জীবিত করছে?

সবাই পছন্দ করেছেন, প্রযোজকও খুশি। প্রযোজকের বিনিয়োগের তিন-চার গুণ বেশি টাকা উঠেছে। এটা আমার কাছে খুবই আনন্দের। ‘পরাণ’ আমার তৃতীয় ছবি। পরিচালক হিসেবে প্রথমেই আমার চিন্তা থাকে, প্রযোজকের লগ্নি তুলে আনা। আমি যখন তাঁকে তিন গুণ বেশি ফেরত দিতে পেরেছি, তা অনেক বেশি ভালো লাগার। নির্মাণের পর অনেক দিন ছবিটা বসে ছিল। মুক্তির পর সুপারডুপার হিট হলে ভালো লাগবে ভেবেছিলাম।

প্রশ্ন :

উজ্জীবিত করার পাশাপাশি ছবির এই সাফল্য কি আপনার জন্য বাড়তি দায়িত্বেরও?

এই ছবির সাফল্যে দায়িত্ববোধ আরও বেড়ে গেল। এখন তো ছবি বানাতে গেলে চিন্তা থাকবে আগের চেয়ে আরও অনেক ভালো করার। ‘পরাণ’ আমার বেস্ট ছবি নয়, কারণ এটি ২০১৯ সালে বানানো। তখন আমি আসলে এতটা ম্যাচিউরড ছিলাম না। আস্তে আস্তে আরও ম্যাচিউরড হয়েছি। তাই এখন আরও ভালো চেষ্টা করছি। আরও অনেক দিকে খেয়াল করে ছবি বানানোর চেষ্টা করি।

প্রশ্ন :

‘পোড়ামন টু’, ‘দহন’, ‘টান’, ‘সাত নম্বর ফ্লোর’ থেকে শুরু করে ‘পরাণ’—এ পর্যন্ত যে কটি চলচ্চিত্রই বানিয়েছেন, কমবেশি দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছে। নির্মাণের সময় সাফল্যের বিষয়টা মাথায় থাকে কি?

একদমই সাফল্যের বিষয় মাথায় রেখে কাজ করি না। তবে আলহামদুলিল্লাহ, আমি লাইফে এখনো কোনো কাজে ফেল করিনি। ছোট পর্দা আর ওটিটিতে—সব কাজই মোটামুটি হিট। বড় পর্দায় তো তিন নম্বর ছবি পরাণ, যা প্রথম দুইটাকে ছাড়িয়ে গেল। প্রথম দুইটা হিট, এবার ব্লকবাস্টার। কাইন্ড অব হ্যাটট্রিকও বলতে পারি। আমি যখনই ছবি বানাই, প্রপারলি গল্পটা বলতে চাই। আরেকটা জিনিস চিন্তা করি, ছবিটা আগে নিজে বোঝার চেষ্টা করি। আমি যদি ছবিটা দেখে এনজয় না করি, তাহলে দর্শক কেন এনজয় করবে—এটাই থাকে আমার ভাবনা। তা ছাড়া হিট হবে, ওই রকম ভেবে ছবি বানানো যায় না।

পরিচালক রায়হান রাফি

প্রশ্ন :

ব্যবসাসফল ছবি নির্মাণের ক্ষেত্রে অনেকে আবার বাজেটের কথাও বলে থাকেন। যত দূর জানি, ‘পরাণ’ ছবির বাজেট অর্ধকোটি টাকার কম। তাহলে কীভাবে ব্যবসাসফল ছবি বানানো সম্ভব হয়েছে?

আসলে ভালো ছবি বানাতে বাজেট লাগে না। ভালো গল্প, ভালো মেকিং আর লাগে নতুনত্ব। ভালো অভিনয় তো লাগেই। সবকিছুই ‘পরাণ’-এ ছিল। সে জন্যই হয়তো ‘পরাণ’ ব্লকবাস্টার হয়েছে। আরেকটা জিনিস, আমার অনেক ছবি আছে ওটিটিতে, ‘পরাণ’ থেকে বেশি বাজেটের। বাজেট আসলে ডিপেন্ড করে গল্পটা কী, কীভাবে পর্দায় গল্পটা বলছি, সেটার ওপর।

প্রশ্ন :

পরাণ ছবির পর নিশ্চয় নতুন কোনো কাজের পরিকল্পনাও শুরু করেছেন? প্রযোজকেরাও আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করছেন? নতুন কাজের খবরাখবর বলুন।

অনেক প্রযোজক যোগাযোগ করছেন, অনেক কিছুই হচ্ছে—অনেক মানুষ সিনেমা বানাতে আগ্রহবোধ করছেন, চলচ্চিত্রের জন্য যা খুবই ভালো দিক। কিন্তু আমি ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে চাই। অলরেডি কিছু কাজ শুরু করেছি। ওই যে বললাম, দায়িত্ববোধ বেড়ে গিয়েছে। আমি আসলে দর্শকদের কোনো দিন হতাশ করতে পারব না। দর্শক বিশ্বাস করে ফেলেছে আমাকে। রাফি সিনেমা বানায়, দেখতে যাচ্ছে মানুষ—এটা ধরে রাখতে চাই। তাই বুঝেশুনেই সিনেমা করতে চাই।

নায়ক শরিফুল রাজ, রায়হান রাফি, বিদ্যা সিনহা মিম ও ইয়াশ রোহান
ছবি : সংগৃহীত

প্রশ্ন :

সিয়াম, আরিফিন শুভ, শরীফুল রাজকে নিয়ে ছবি বানালেন। ঈদের পর আলাপে বলছিলেন, শাকিব খানকে নিয়েও ছবি বানাতে চান। আলাপ-আলোচনা কি এগিয়েছে?

সিয়াম, আরিফিন শুভ, রাজ—সবাইকে নিয়েই তো বানিয়ে ফেললাম। এখন বাকি আছেন শুধু শাকিব ভাই। আমাদের আলাপ-আলোচনাও চলছে। মাঝেমধ্যে কথা হয়। শাকিব ভাই আমাদের দেশের বিগ সুপারস্টার, তাঁর সঙ্গে ছবি হলে বড় আয়োজন করে বলতে চাই, সুন্দর করেই বলতে চাই। এটাও বলতে চাই, শাকিব ভাইয়ের সঙ্গে ছবি তো অবশ্যই হবে, আজ নয়তো কাল।

প্রশ্ন :

আপনার পরিবারে কেউ বিনোদন অঙ্গনে কাজ করেন? নির্মাণের মতো পেশায় জড়ানোর ক্ষেত্রে পরিবারের মধ্যে কে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রেরণা দিয়েছেন?

আমার চৌদ্দ পুরুষের মধ্যে কেউ বিনোদন অঙ্গনে কাজ করেননি। আমার মনে আছে, ক্লাস নাইনে থাকতে প্রথম শর্ট ফিল্ম ‘আজব বাক্স’ বানাই। নির্মাণের আগে আমার কোনো টাকা ছিল না। অনেক কান্নাকাটি করেছিলাম। এরপর আম্মু একদিন আমাকে বাজারে নিয়ে যান, তাঁর গলার চেইন বিক্রি করে আমাকে ১২ হাজার টাকা দেন। মায়ের চেইন বিক্রির টাকায় প্রথম শর্ট ফিল্ম বানাই। ওইটা আমার কাছে ছিল অনেক বড় অনুপ্রেরণার। তাই তো আম্মুর নামেই আমার কোম্পানির নাম ‘কানন ফিল্মস’। আমার মনে হয়, এই যে সাকসেস, এর মূলমন্ত্র হলো আমার মা। মায়ের দোয়ায় হয়তো আমার সিনেমাগুলো ভালো হয়।

প্রশ্ন :

এমন এক সময়ে ছবি নির্মাণে এসেছেন, যখন পুরো পৃথিবীর ছবি মানুষের হাতের মুঠোয়। সবাই দেখছে সব দেশের ছবি। বাংলাদেশে এখন ভারত, আমেরিকা ছাড়াও কোরিয়াসহ বিশ্বের অনেক দেশের ছবির দর্শক তৈরি হয়েছে। এই সময়টায় ছবি নির্মাণে কি কোনো চ্যালেঞ্জ মনে করেন?

আমি বিশ্বাস করি, দেশ–বিদেশের ছবি যতই চালানো হোক, বাংলা ছবি দর্শক পাগলের মতো দেখেন। এই ঈদে আবারও প্রমাণ করেছি। বিদেশের ছবি প্রেক্ষাগৃহমালিকেরা নামিয়ে ফেলেছেন আমাদের ছবির জন্য। আমরা বাংলাদেশিরা যারা বাংলাদেশকে ভালোবাসি, তারা সব সময় বাংলা ছবিই দেখতে চাই। যতই আমি বিদেশের যেকোনো তারকা খেলোয়াড় বা শচীন টেন্ডুলকারের ভক্ত হই না কেন, সাকিব আল হাসানের চার–ছক্কা মারে, খুব মজা লাগে।

প্রশ্ন :

তার মানে পৃথিবী যতই উন্মুক্ত থাকুক, নিজ দেশের সুন্দর সব গল্প দিয়েই দেশের দর্শককে প্রেক্ষাগৃহে টানা সম্ভব?

বাংলাদেশি মানুষ যারা, তারা বাংলা ছবিই দেখতে চায়। তারা যদি ভালো গল্প পায়, পাগলের মতো দেখে। আমরাও তো কল্পনা করিনি মানুষ এভাবে পাগল হয়ে সিনেমা দেখবে। আমার ছবিটি ৪ সপ্তাহ শেষে ৫ সপ্তাহ রানিং হবে। এটা তো ক্রেজি না হলে সম্ভব নয়।

প্রশ্ন :

পাঁচটা গান, দুইটা ফাইট আর সিকোয়েন্স—এই ফর্মুলা ছাড়া আমাদের দেশে অন্য ফর্মুলায়ও ছবি তৈরি হয়। আপনার কোনো নিজস্ব ফর্মুলা আছে কি?

আমি ফর্মুলায় কখনো বিশ্বাস করি না। এটা একসময় হতো। এখন মানুষ অনেক স্মার্ট হয়ে গেছে, এসব ফর্মুলায় কাজ হবে না। ফর্মুলা এখন একটাই, ভালো গল্প, ভালো চিত্রনাট্য, ভালো নির্মাণ—এই ফর্মুলার ওপরে অন্য কোনো ফর্মুলা চলবে বলেও আমার মনে হয় না।