জন্মদিনের আগাম শুভেচ্ছা।
সোহেল রানা : ধন্যবাদ। তবে এখন আমার জন্মদিন উদ্যাপন করা হয় না।
প্রথম আলো :
ছোটবেলায় তো উদ্যাপন করা হতো!
সোহেল রানা : ছোটবেলায় বাসায় লোকজন আসতেন, আত্মীয়স্বজনেরা আসতেন; হইচই করে খাওয়াদাওয়া হতো। বিকেলে মিলাদ হতো। দশম শ্রেণি পর্যন্ত এমনটাই চলেছে। এরপর দেখতাম কেক কাটার প্রচলন শুরু হলো। তখনো বাসার লোকজন মিলে হইচই করতেন। কলেজজীবনে রাজনীতি করতে গিয়ে জেলজীবন যাপন করতে হয়েছে। জীবনে নানা কিছু ঘটল। দেশ স্বাধীনের পর ফিল্মে চলে আসার পর জন্মদিনটা উদ্যাপন করা হতো। তবে মুক্তিযুদ্ধের আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকা অবস্থায় উদ্যাপনের শুরুটা হয়। জন্মদিনে তখন বন্ধুবান্ধব মিলে চায়নিজ খেতে যেতাম। আর কিছু তো ছিলও না। এরপর গল্পগুজব। আড্ডাবাজি চলত, সিনেমা দেখতাম—এটুকুই আনন্দ। পুরোদস্তুর হিরো, রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার পরও বাসায় আড্ডা হতো। শুরুর দিকে আড্ডা জমত আমাদের পুরান ঢাকার ৯৩ বিসিসি রোডে বাবার বাসায়। উত্তরায় আসার পর আসলে জন্মদিন জমজমাট হতো। চলচ্চিত্রের কারণে সবাই ভালোবেসে চলে আসতেন। গায়ক-গয়িকা, নায়ক–নায়িকা, রাজনীতির সবাই আসতেন। তখন অনেক বেশি হইচই হতো। জীবন নিয়ে কোনো ভাবনা–চিন্তা ছিল না। সেই জীবন শেষ হয়ে গেল। বয়স ভর করল। অসুখ-বিসুখ শুরু হলো। নানা ভাবনা এল।
কী কী ভাবনা এল?
সোহেল রানা : সময়টা তো যাচ্ছে। মনে হতে লাগল, আমি খেলার পুতুল ছাড়া তো আর কিছুই নই। কোথা থেকে এসেছি, জানি না। আমার জন্ম কোথায়, তা–ও আমি জানি না। আমাকে প্রথম কে কাপড় পরিয়েছেন, জানি না। প্রথম কে গোসল করিয়েছেন, তা–ও আমি জানি না। এরপর আমাকে মা বললেন, ‘এটা তোর বাবা, এটা তোর চাচা, এটা তোর মামা এসব...। এভাবে আমি সবাইকে চিনতে শুরু করলাম। সম্পর্ক গড়ে উঠল। পথ চলতে চলতে চিনলাম, ও আমার নিকটবন্ধু, ও আমার পরবন্ধু। এরা আত্মীয়। এরপর কী হবে? আবার চলে যাব। আমাকে প্রথম গোসল করিয়েছেন কে, তা যেমন জানি না, তেমনি যখন মারা যাব, তখন কে আমাকে গোসল করাবেন, তা–ও জানি না। প্রথম কে কাপড় পরিয়েছেন তা আমি জানি না, যাওয়ার বেলায় কে কাফন পরাবেন, তা–ও জানি না। তখন আমাকে কে বড় করেছেন, আমি জানি না। এখন কাঁধে চড়িয়ে কারা নিয়ে যাবেন, তা–ও আমি জানি না। আমি কে? কাজেই জন্মদিন আমার কাছে এখন কিছু না। ইটস নাথিং বাট সিম্পল ডে।
প্রথম আলো :
তারপরও জীবনটা কী?
সোহেল রানা : আমারও প্রশ্ন। আমি আসলে উত্তর খুঁজে পাই না।
প্রথম আলো :
কিন্তু আপনি তো জন্মদিন পালন করতেন। তাহলে এই উপলব্ধি কবে থেকে?
সোহেল রানা : কোভিড শুরুর আগে কিছুটা ছিল। কোভিডের সময় প্রকটভাবে। তার পর থেকে আমি উদ্যাপন করি না। যাঁরা ভালোবেসে বাসায় আসেন, তাঁদের আনন্দটা নষ্ট করতে চাই না। এখন যাঁরা আসেন, ভালোবেসে আসেন, গল্প করেন, আড্ডা দেন, এরপর চলে যান। কিছুটা সময় কাটে। এই আরকি! তবে আমার মনে হয়, জীবনটা খুবই ক্ষুদ্র। আমাদের যে আয়ু দেওয়া হয়েছে, সেটা খুবই কম। আমি নামাজের সময় প্রায়ই বলি, আল্লাহ তাআলা, তুমি আমাকে এত স্বল্প সময় দিয়ে পাঠালে কেন? যৌবনটা আসতে না আসতেই যেন ভাটার টান!
জীবনটা আরও দীর্ঘ হলে কী করতেন?
সোহেল রানা : আমি আমার আদর্শ উদ্দেশ্য থেকে সরতাম না। আমার দ্বারা যেন মানুষের যাতে ক্ষতি না হয়, সেই চেষ্টা সব সময় করেছি, জানি না কতটা পেরেছি—এটাই করে যেতাম। সীমিত ক্ষমতার মধ্যে সবার পাশে থাকার চেষ্টা করেছি। আমি জ্ঞানত কখনোই কারও কোনো ক্ষতি করিনি। কেউ আমার কাছে পরামর্শ নিতে এলে আমার জ্ঞানে, যা মনে হয়েছে, তা–ই বলেছি। কোনো কিছু চাপিয়ে দিইনি। দীর্ঘজীবন যদি পেতাম, এই কাজই করতাম। আমি ভালো মানুষ হতে চাই। সব সময় এটাই চেয়েছি।
প্রথম আলো :
আপনার মধ্যে এই বোধ কীভাবে বেড়ে উঠেছে?
সোহেল রানা : এটা মনে হয় আমার বাবার মধ্যেও ছিল। গ্রামে যতটুকু দেখেছি, মানুষজনও তেমনটাই বলতেন। আমার মা–ও মানুষের জন্য করতেন। তখন বরিশালে থাকতাম আমরা।
প্রথম আলো :
ভালো মানুষ হওয়ার উপায় কী?
সোহেল রানা : এটা যাপিত জীবন থেকে শেখা হয় না। এটা আসলে অন্তর থেকে আসে। এটা পুরোপুরি আল্লাহর দয়া। সৃষ্টিকর্তা যদি চান, তবেই তুমি ভালো মানুষ হবে।
শিল্পীর ভালো মানুষ হওয়া কতটা জরুরি?
সোহেল রানা : আমি তো সবাইকে শিল্পী বলি না। তবে শিল্পী হতে হলে অবশ্যই অবশ্যই ভালো মানুষ হতে হবে। অন্তর পরিষ্কার থাকতে হবে। সিনেমায় অভিনয়ে পারদর্শী হয়ে নায়িকা হতে পারে, গানে পারদর্শী হয়ে গায়িকা হতে পারে, অভিনয়ে পারদর্শী হয়ে অভিনেতা হতে পারে। শিল্পী নয়। শিল্পী হতে পারা মুশকিল। শিল্পীকে অবশ্যই অন্তর থেকে ভালো মানুষ হতে হবে।
প্রথম আলো :
ফেলে আসা জীবনে অনেক কিছুই করেছেন। তারপরও অনেকে বলেন, আরও অনেক কিছুই করার ছিল...
সোহেল রানা : জীবনে এটা-ওটা করা হয়নি, অনেক অপূর্ণতা রয়ে গেছে—এমনটা ভেবে দুঃখ করি না। বরং আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করি, এতটা বছর সুন্দরভাবে পার করে এসেছি বলে। জীবনে সফলও হয়েছি। মানুষের জীবনে যা যা প্রয়োজন, আমি সবই পেয়েছি।
প্রথম আলো :
ছোটবেলায় কী হতে চেয়েছিলেন?
সোহেল রানা : আমার মনে হয়, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটি সময় মানুষের উদ্দেশ্যের বদল হতে থাকে। মা-বাবার আমাকে নিয়ে হয়তো এক রকম চিন্তা ছিল। তবে ছোটবেলা থেকে আমি যেটাই করতাম, ভালো করতাম। ফুটবল যখন খেলেছি, ফুটবল দলের অধিনায়ক ছিলাম। ক্রিকেট খেলেছি, সেখানেও অধিনায়ক ছিলাম। যে দলের রাজনীতি করেছি, ময়মনসিংহ বিভাগে সেই দলের জেনারেল সেক্রেটারি ছিলাম। আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ইকবাল হলের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলাম। অভিনয় না শিখে ফিল্মে এসেছি, অভিনয় করেছি, অভিনেতা হিসেবে সৃষ্টিকর্তা যথেষ্ট জনপ্রিয়তা দিয়েছেন। ৩৪টি সিনেমা বানিয়েছি, সেগুলোও সুপারহিট। এখন একটাই চাওয়া, আপনজনদের সান্নিধ্যে যেন আমার মৃত্যু হয়।