নিজেও বুঝতাম, ছ্যাঁকা খাওয়া চরিত্রটাই ক্লিক করবে: বাপ্পারাজ

আজ ১১ মার্চ চিত্রনায়ক বাপ্পারাজের জন্মদিন। এই দিনে জানা গেল শিগগিরই ‘রক্তঋণ’ নামের একটি সিরিজে অভিনয় করবেন। বাপ্পারাজ–এর সঙ্গে আজ মঙ্গলবার দুপুরে কথা বলেছেন মনজুর কাদের

প্রথম আলো:

শুভ জন্মদিন।

বাপ্পারাজ : ধন্যবাদ। তবে জন্মদিন আমি উদ্‌যাপন করি না। এমনকি বিবাহবার্ষিকী, মৃত্যুবার্ষিকী এ ধরনের কোনো দিবসই পালন করি না। এসব নিয়ে আমার আগ্রহও নেই। এই পালনের কোনো অর্থও আমি খুঁজে পাই না। হুদাই মনে হয়। আমি জন্মাইছি তো জন্মাইছি, কী এমন হয়েছে। (হাসি)। জন্মগ্রহণ করে কী এমন করে ফেলছি যে এটা সাড়ম্বরে উদ্‌যাপন করতে হবে।

প্রথম আলো :

আপনি নাহয় করেন না। কিন্তু ফেসবুকে তো আপনাকে নিয়ে ভক্ত–শুভাকাঙ্ক্ষীরা বিশেষ এই দিনে শুভেচ্ছা, শুভকামনা জানান। এটা কেমন লাগে?

বাপ্পারাজ : ফেসবুকে সবাই যে শুভকামনা জানায়—এটা মজাই লাগছে। মনে হয়, এটাই আমার অর্জন। মানুষ যে নিঃস্বার্থভাবে এটা করে, এটা কয়জনেরই জীবনে জোটে। কত লোকে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকাপয়সা দিয়েও মানুষের মনে থাকতে পারে না। আমি তো বছরের পর বছর শুধু অভিনয়ের কারণে মানুষের মনে আছি। মানুষই তাদের মতো করে ভালোবেসে দিনটি উদ্‌যাপন করে, এটা সত্যিই ভীষণ আনন্দের।

বাপ্পারাজ। ছবি: ফেসবুক

প্রথম আলো :

বিশেষ এই দিনে আপনার অভিনীত বিভিন্ন চরিত্র নিয়ে কথা বলে। অনেকে আবার পুরোনো অনেক ছবির ক্লিপ ফেসবুকে শেয়ার করে। এসব কি আপনাকে কিছু স্মৃতিকাতর করে?

বাপ্পারাজ : আমি কাতর হই না, সব সময় পাথর। (হাসি) কোনো কিছুই আমাকে সেভাবে ইফেক্ট করে না। সেটা দুঃখ, খুশিও। আমার কোনো লোভও পাই, অনেক প্রাপ্তি হতে হবে—এটাও মনে আনি না। আমি অতি সাধারণভাবে চলাফেরা করি। সবকিছুতেই আমি সন্তুষ্ট থাকার চেষ্টা করি।

প্রথম আলো:

বিষয়টা যদি এভাবে বলি, এসব দেখে পুরোনো কোনো কথা মনে পড়ে যায় কি না?

বাপ্পারাজ : ভক্ত ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা যখন পুরোনো বিষয়গুলো সামনে নিয়ে আসেন, অনেক কথা মনে পড়ে যায়।

বাপ্পারাজ
ছবি : প্রথম আলো

প্রথম আলো :

আপনার বিভিন্ন সিনেমার ক্লিপ যখন ফেসবুকে আসে, অনেকে তখন অভিমানের সুরে বলেন, অভিনয়ে কেন নিয়মিত নন?

বাপ্পারাজ : এখন তো আমার সেই সময় নাই, হিরোইনের পেছনে ছুটে ছুটে গান করব। সত্যি কথা বলতে আমাদের এখানে তো ওই রকম চিত্রনাট্যই হয় না। আমরা যারা, এই যেমন আমি, আমিন খান, নাঈম—আমাদের নিয়ে গল্প ভাবা হয় না। যা–ও কেউ আমাদের কথা ভাবেন, চিত্রনাট্য করতে গেলে, বলবে, বাবার চরিত্র করো বা করেন। বাবার চরিত্র যে করব, আমাদের তো বাবার মতোও অবস্থা হয় নাই। (হাসি)। আমাদের নিয়ে চরিত্র লেখা না হলে কীভাবে কী করব। মুম্বাইয়ের দিকে তাকালে দেখি, এই বয়সেও অমিতাভ বচ্চনসহ অন্যদের নিয়ে যেভাবে চরিত্র তৈরি হয়, তা সত্যিই অন্য রকম। বয়স্ক যাঁরা, এখনো তাঁদের পর্দায় যেভাবে উপস্থাপন করে, তা ঠিকঠাকভাবেই করে। আমাদের এখানে গল্প এখনো একই প্যাটার্নের। হয়তো বাবার চরিত্র দরকার হলো, বলল, বাপ্পা ভাই করবেন? আমি বললাম, না, আমি করব না। এরপর দেখা গেল নাঈমের কাছ গেল, সেও করবেন না। এরপর আমিন খানের কাছে গেল, সেও করল না। এরপর এমন একজনকে নিল, যা হয়তো নিতে হবে বলেই নেওয়া। তাই বলব, আমাদের এখানে কাউকে ভেবে চরিত্র তৈরি হচ্ছে না।

আরও পড়ুন
প্রথম আলো:

এটা কি পরিচালকদের চিন্তার দৈন্য নাকি প্রযোজকদের উদাসীনতা?

বাপ্পারাজ : প্রযোজকেরা এখানে কী করবে। প্রযোজকদের যদি পরিচালকেরা সঠিকভাবে বোঝাতে পারেন, তাহলেই হয়। প্রযোজকেরা সাধারণত কী চায়, আমার ছবিটা হিট হোক। লগ্নি ফেরত আসুক। লাভ করুক। বাবা, ভাই, বোন, মা কাকে নেবেন, এটা নিয়ে মোটেও তিনি ভাবেন বলে মনে হয় না। খুব বেশি কিছু হলে প্রযোজক নায়ক-নায়িকা পর্যন্ত কে হতে পারেন, তা নিয়ে নাক গলায়। এখন যদি বলি, প্রযোজকেরা চাইবেন যে শাকিব খান থাকুক। শাকিব থাকলে তাঁদের মার্কেটের ভ্যালুটা ঠিক থাকবে, টাকা ফেরত আসবে, লাভও হবে। যে–সে থাকলে আবার ঝুঁকি। এরপরও বুঝলাম পরিচালক বোঝাল, গল্প খুব ফাটাফাটি। তারপরও প্রযোজক চিন্তা করবে, ফাটাফাটি হলেও যদি গল্প দর্শক না পছন্দ করে, তাহলে তো আমি শেষ। প্রযোজক চান তাঁর বিনিয়োগের নিরাপত্তা। আমাদের পরিচালনার প্যাটার্ন বদলাতে হবে। না বদলাতে পারাটা অবশ্যই তাঁদের দীনতা। তবে নতুন যে কয়জন পরিচালক কাজ করছেন, তাঁদের কারণে প্যাটার্ন আস্তে আস্তে বদলাতে শুরু করেছে। নির্মাণের ধরন বদলে যেতে শুরু করেছে, ভাবনাচিন্তাও বদলেছে। আর আমাদের পুরোনোদের চিন্তাভাবনা ওখানেই আটকে আছে, যেখানে তাঁরা শুরু করেছিলেন। তাঁদের বক্তব্যটা অনেকটা এ রকম, হ্যাঁ, আমি ২০-৩০টি ছবি বানাইছি, তোমরা এখন আমারে জ্ঞান দাও। তাঁরা এখনো ওই ২০-৩০টি ছবির মধ্যে আটকে আছেন। এখন যে দুনিয়া কোথায় চলে গেছে, তা তাঁরা জানতে বা বুঝতে চান না। অনেক কিছু বদলে গেছে। এখন আর গোঁ ধরে বসে থাকলে হবে না।

দুই সন্তান বাপ্পারাজ ও সম্রাটের সঙ্গে রাজ্জাক

প্রথম আলো :

পরিচালকেরা কী কারণে ভাবতে পারছেন না বলে আপনার মনে হয়?

বাপ্পারাজ : সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে পারছেন না। আমাকে সময়ের সঙ্গে থাকতে হবে। আগে আমি অ্যানালগ ফোনসেট ব্যবহার করতাম, বাটন টিপতাম। এখন আমি যদি বলি, এটাই আমি চালাইতে পারি, সেটাই ভালো কিন্তু তা তো হবে না। টাচ ফোন ব্যবহার করতে পারি না বলে, ধুর ওইটা ঝামেলা। কিন্তু যাঁরা টাচ ফোন চালানো শিখে গেছেন, তাঁদের কাছে তো তা না। এটা হচ্ছে চর্চার বিষয়। কিন্তু আপনার কাছে বাটন ফোনে সুবিধা, আপনি বললেন, এটাই ভালো, আমি তো এটাই চালাইতে পারি। তো চালান। কিন্তু আপনার সেই বাটন ফোনে তো কাজ হয় না। আপনি ইউটিউব দেখতে পারবেন না, নতুন সিনেমা-গান দেখতে পারবেন না, বঙ্গ দেখতে পারবেন না, নেটফ্লিক্স দেখতে পারবেন না—অনেক সীমাবদ্ধতা সেটার মধ্যে। তারপরও যদি বলেন, আমারটাই ঠিক আছে। তাহলে তো আপনার সেই কাজ আপনি ছাড়া কেউ দেখবেও না।

প্রথম আলো :

আপনাকে কয়েক দিন আগে ছোট্ট একটা টিজারে দেখা গিয়েছিল।

বাপ্পারাজ : ওটা একটি ওয়েব সিরিজ। মোস্তফা খান শিহান বানাবে। সিরিজের প্রতিটা চরিত্রের ওপর একটা করে টিজার বানিয়েছে। বানানোর পর চুপচাপ ছিল, ভাবছিল পরে প্রকাশ করবে। কিন্তু হেনা-বকুল নিয়ে এত মাতামাতি শুরু হলো, তার মধ্যেই এটি ছেড়ে দিয়েছে। সময় ও সুযোগটা কাজে লাগিয়েছে। সিরিজটির নাম ‘রক্তঋণ’। কোনো চ্যানেলের সঙ্গে চূড়ান্ত হলে তবেই শুটিং শুরু হবে। এটি আমার অভিনীত প্রথম ওয়েব সিরিজ হতে যাচ্ছে।

আরও পড়ুন
শুটিংয়ের মুহূর্তে বাপ্পারাজ। ছবি: সংগৃহীত
প্রথম আলো:

প্রথমবার ওয়েব সিরিজে কাজ করতে রাজি হলেন।

বাপ্পারাজ : বিষয়বস্তুর কারণে সিরিজটিতে কাজ করতে রাজি হয়েছি। যেমন এটার মধ্যে হিরোইন নাই। নাচ-গান নাই। চরিত্রনির্ভর। চরিত্রে অভিনয়ের দুর্দান্ত সুযোগ আছে। ধুমধাম ব্যাপারও আছে।

প্রথম আলো :

টিজার প্রকাশের পর ভালোই সাড়া ফেলেছে। এটা কি আপনাকে উদ্দীপ্ত করেছে?

বাপ্পারাজ : আমি সব সময় উদ্দীপ্ত থাকি। আমাকে কেউ জিজ্ঞেস করলে, কেমন আছেন? আমি বলি, অলওয়েজ সেক্সি। আগে যেমন ছিলাম, তেমন আছি। আমার ফেসবুকের টাইমলাইনে লেখা আছে, ‘আমি এখনো তেমনই, যেমন আমাকে প্রথম পরিচয়ে পেয়েছেন।’ এটাই আমার জীবনদর্শন।

শাবনাজ ও বাপ্পারাজ
ছবি: শাবনাজের ফেসবুক

প্রথম আলো :

২৯ বছর আগের ‘প্রেমের সমাধি’ ছবির একটি ক্লিপিংস তো ভাইরাল। সব প্রজন্ম এটির সঙ্গে আনন্দে মেতেছে। এত বছর আগের একটি ছবির ক্লিপিং কীভাবে সব বয়সীদের আনন্দের কারণ হয়েছে বলে মনে করেন?

বাপ্পারাজ : আমি মনে করি, মানুষের আবেগ–অনুভূতি সর্বজনীন। যদি বলি, ‘বেদের মেয়ে জোস্‌না’ ছবিটির কথা, সেটি কিন্তু আমাদের দেশেও হিট, ভারতেও হিট। তার মানে মানুষের যে আবেগ, তা সব দেশে একই রকমভাবে কাজ করে। আবেগ প্রকাশের ক্ষেত্রে ভাষা কখনোই কোনো বাধা না। প্রেমিক-প্রেমিকা, বাবা-সন্তান, মা-সন্তান, ভাই-বোন—সবার আবেগ–অনুভূতি পৃথিবীর সব দেশেই একই রকম। এটা পরিবর্তন হয় না, তখন যা, এখনো তা।

আরও পড়ুন
সম্রাট ও বাপ্পারাজ
ছবি : প্রথম আলো
প্রথম আলো:

তার মানে এটা কি বলা হয়, আমরা এখন যে বেশির ভাগ ছবির ক্ষেত্রে সাফল্য পাচ্ছি না—আবেগটা ঠিকঠাক ধরতে পারছি না বলে?

বাপ্পারাজ : সব সময় বলেছি, আমি যেসব ছবি করেছি, আমাকে সেকেন্ড হিরো বলা হতো। এতে আমি কিছু মনে করতাম না। সেকেন্ড হিরো হয়েও ফার্স্ট হিরোকে সব সময় টেক্কা দিয়ে লাইমলাইটে থেকেছি। এটাই আমার ক্রেডিট। ত্রিভুজ প্রেমের যত ছবি ছিল, নাচ-গানের হিরো আরেকজন ছিল। কিন্তু তারপরও ট্রফিটা সব সময় আমি নিয়েছি, কারণ আমার অভিনয়, চরিত্রের আবেগ, আমার সঙ্গে সঙ্গে মানুষকেও কাঁদিয়েছে, হাসিয়েছে—মানুষ তাই মনে রেখেছে। মানুষ সুখের দিন বেশি সময় মনে রাখে না। দুঃখটাকে মানুষ মনে রাখে। আপনার জীবনে কে কী উপকার করেছে, তা মানুষ কখনোই মনে রাখে না, তবে কষ্ট দেওয়ার ঘটনা মরার আগপর্যন্ত মানুষের মনে থাকে।

বাপ্পারাজ

প্রথম আলো :

আপনাকে নিয়ে প্রায়ই ট্রল হয়, ছ্যাঁকা খাওয়া নায়কের শুভেচ্ছাদূত আপনি। এটা নিয়ে কোনো দুঃখবোধ কাজ করে?

বাপ্পারাজ : একদমই না। আমি মনে করি, আমার জায়গায় আমি এক নম্বর। আমার অভিনীত চরিত্র সবার মনে জায়গা করেছে বলেই এমনটা হয়েছে, তাই এটাকে ইতিবাচকভাবে দেখি। নিঃসন্দেহে এটা আমার সফলতা। আমাকে যখনই পরিচালকেরা গল্প শোনাতেন, চরিত্র নিয়ে কথা বলতেন, তখন আমি বেছেই নিতাম ছ্যাঁকা খাওয়া চরিত্র। আমি নিজেও বুঝতাম, ছ্যাঁকা খাওয়া চরিত্রটাই ক্লিক করবে।