যে কাজে চ্যালেঞ্জ নেই, সে কাজে আনন্দ নেই: পূজা সেনগুপ্ত

১০ বছর পূর্ণ করেছে তুরঙ্গমী রেপার্টরি ড্যান্স থিয়েটারের ‘ওয়াটারনেস’। এ উপলক্ষে ঢাকার শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালা মিলনায়তনে আজ সন্ধ্যায় নৃত্য প্রযোজনাটির একটি প্রদর্শনী হবে। ‘ওয়াটারনেস’-এর পরিকল্পক ও পরিচালক পূজা সেনগুপ্তর সঙ্গে কথা বলল ‘বিনোদন’

প্রথম আলো:

‘ওয়াটারনেস’ নিয়ে ১০ বছরের এই যাত্রাপথ কেমন ছিল?

পূজা সেনগুপ্ত: ২০১৫ সালের ২১ জানুয়ারিতে ‘ওয়াটারনেস’-এর প্রথম প্রদর্শনী হয়। এরপর প্রতিবছর প্রদর্শনী হয়েছে। শুধু কোভিডের সময়টায় বন্ধ ছিল। ১০ বছরের পথচলা অনেক কঠিন ছিল। পেছনে ফিরে তাকালে অনেক অবাক লাগে—এত কঠিন পথ হেঁটে আসা। আমাদের দেশে এ ধরনের মিউজিক্যাল প্রোডাকশনের সংস্কৃতি ছিল না। পৃষ্ঠপোষকদের কনভিন্স করতে হয়েছে—এ ধরনের কাজে বিনিয়োগ তাদের ও তাদের ব্র্যান্ডের জন্য কার্যকর হতে পারে। এরপর এ ধরনের প্রযোজনার সেট, লাইট বুঝতে পারা মানুষ, একটু একটু করে দলটা গোছানো—কঠিন কাজ ছিল। কিন্তু কঠিন কাজই আনন্দের। যে কাজে চ্যালেঞ্জ নেই, সে কাজে আনন্দ নেই।

প্রথম আলো :

মোট কতটি প্রদর্শনী হয়েছে?

পূজা সেনগুপ্ত: সব মিলিয়ে ১২টি পাবলিক শো হয়েছে। আর ক্লোজ ডোর প্রদর্শনী আমরা গুনছি না, অনেক হয়েছে। ওখানে সাধারণ দর্শক যেতে পারেননি। ১২টি প্রদর্শনীর সব কটি উল্লেখযোগ্য হলেও বিশেষভাবে হাতিরঝিলেরটার কথা বলব। অ্যাম্ফিথিয়েটারে ২০১৮ সালের অক্টোবরে ‘ওয়াটারনেস’-এর একটি প্রদর্শনী হয়। আমরা শিল্পকলায় মিলনায়তন চেয়েছিলাম, আমাদের দেবে বলেও শেষ মুহূর্তে দেয়নি। বলা হয়েছিল, অন্য দিন করতে। তখন দলের সবার সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নিই, আমরা যেদিন প্রদর্শনী ঠিক করেছি, সেদিনই করব। আমি এটাও দেখিয়ে দিতে চেয়েছি, আমাদের শোতে দর্শক বেশি হবে। আমরা পেরেছি। যত দূর মনে পড়ে, সেদিন মিলনায়তনে ২ হাজার ২০০ দর্শক ছিলেন। আরও ৬০০-৭০০ দর্শক ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে দেখছিলেন।

পূজা সেনগুপ্ত
প্রথম আলো:

নৃত্যশিল্পীদের কাছ থেকে প্রায়ই শোনা যায়, নাচের আয়োজনে সেভাবে পৃষ্ঠপোষকতা পান না। আপনার কথায় মনে হচ্ছে, মানুষের আগ্রহ আছে। এই পথচলায় আন্তরিক পৃষ্ঠপোষকতা কেমন পেয়েছেন?

পূজা সেনগুপ্ত: দর্শক যখন একটা কাজ দেখেন, তাঁর কোনো ব্যারিয়ার থাকে না, আমি শুধু গানই শুনব, শুধু নাচই দেখব বা থিয়েটার দেখব। দর্শক একটা ভালো কিছু অভিজ্ঞতা নিতে চান। একটা সুন্দর সময় কাটাতে চান। এই যে কথা হয়, বাংলাদেশে নাচের কিছু নেই, গানের কিছু নেই—এসব বাধার দেয়াল ভাঙতে হবে। ভাঙার একমাত্র উপায় হচ্ছে, ভালো ভালো কাজ করা। আমাকেও শুরুর দিকে শুনতে হয়েছে—নাচের এ রকম বাজেট হবে না। এখন কিন্তু সবই হচ্ছে। দর্শকের কাছে কৃতজ্ঞতা, আমরা বরাবরই তাঁদের কাছ থেকে ভালো সাড়া পেয়েছি। এবারও তাই। তাই আমি মনে করি, কাজটা ভালো হওয়া জরুরি। আমি মনে করি, যেসব করপোরেট আমাদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন, তাঁরা তুরঙ্গমীর সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকাটাকে তাঁদের ব্র্যান্ডের জন্য ইতিবাচক মনে করেছেন। আমাদেরও তাঁদের সঙ্গে থাকতে পারাটা সহায়ক ছিল। এটা দুই পক্ষেরই একটা বোঝাপড়ার বিষয়। উভয় পক্ষের পেশাদার আচরণ থাকতে হবে।

প্রথম আলো:

এই পেশাদার আচরণের ব্যাপারটা কতটুকু আছে, আমাদের এখানে?

পূজা সেনগুপ্ত: এটা কঠিন প্রশ্ন। ঢালাওভাবে বলা যায় না। বড়দের তো আমার কিছু বলার নেই। আমার ছোট যারা, তাদের বলতে চাই, আসলে আজকের পৃথিবী হচ্ছে দেয়াল ভেঙে দেওয়ার পৃথিবী। এটা বিপ্লবের পৃথিবী। একটা নির্দিষ্ট ঘরানার মধ্যে নিজেদের আটকে না রেখে, যে আমি শুধু নাচই করব; বরং সব ঘরানার মধ্যকার দেয়ালগুলো যদি ভেঙে দেওয়া যায়, তাহলে একটা সার্থক শিল্পেরও সৃজন হয়, দর্শক নতুন কিছু পান। তখন পৃষ্ঠপোষকতাও পাওয়া যায়।

পূজা সেনগুপ্ত
ছবি: সংগৃহীত

প্রথম আলো :

আপনি পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেছেন। নাচে এলেন কী করে?

পূজা সেনগুপ্ত: ভেতরের বিষয় তো আমরা বুঝতে পারি না। এই ব্যাপারটা হয়তো আগে থেকে আমার মধ্যে ছিল। নিজেকে চেনা তো একটা বিশাল ভ্রমণ। নিজের ভেতর অনেক কিছু থাকলেও আমরা বুঝতে পারি না। তবে আমার শিক্ষক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের কবির স্যার, তিনিই প্রথম আমাকে নাচের ব্যাপারে অনুপ্রাণিত করেন। বলেছিলেন, তুমি ফিজিকস ছাড়ো, নাচে নিয়মিত হও। ২০১১ সালের কথা। আমি তখন ফিজিকসে মাস্টার্স শেষ করে থিসিসের কাজ করছি। জার্মান সরকারের একটা বৃত্তিও পেয়েছি, পিএইচডি করার জন্য। স্যারের কথা শুনে জার্মানি না গিয়ে ভারত সরকারের আইসিসিআর বৃত্তির আবেদন করলাম। বৃত্তিটা পেলাম। ভারতে গেলাম, নাচ নিয়ে পড়াশোনা করলাম। এরপর আমার পেশাদার নাচের ভ্রমণ শুরু। আমাদের বাবা-মায়েরা বলেন, নাচ-গান করে জীবন চলবে না। জীবন চালানোর জন্য একটা চাকরি করতে হবে। পাশাপাশি নাচ-গান করবে। কিন্তু আমি যখন জীবন চালানোর জন্য একটা চাকরি করি, তখন চাকরিটাই আমার পেশা হয়ে যায়। নাচ-গানটা সেকেন্ডারি হয়ে যায়, যা আমরা ধরতে পারি না।

বাবার সঙ্গে পূজা সেনগুপ্ত
ফাইল ছবি
প্রথম আলো:

যাঁরা এমন দোটানায় থাকেন, তাঁদের প্রতি আপনার কী পরামর্শ?

পূজা সেনগুপ্ত: দেখেন, জীবনে সফল হতে হলে ঝুঁকি নিতে হবে। এটা শুধু শিল্প-সংস্কৃতিতে নয়, বড় বড় শিল্পপতি, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক—যাঁরাই সফল হয়েছেন, তাঁরা ঝুঁকি নিয়েছেন। ঝুঁকি নিতেই হবে। সবচেয়ে বড় বিষয়, স্বপ্নটা সবার জীবনে থাকে না। যদি স্বপ্ন কারও জীবনে থেকে থাকে, সেটা খুবই মূল্যবান—এটাতে ফোকাস দিতে হবে, স্বপ্নের পেছনে ছুটতে হবে। এটার জন্য সর্বস্ব দিতে হবে। তবেই স্বপ্নকে হাতের মুঠোয় এনে বাস্তবে পরিণত করা যাবে।