প্রশ্ন :
‘স্টপ জেনোসাইড’ তৈরিতে একদিকে যেমন ছিল অর্থসংকট, অন্যদিকে ছিল সরঞ্জামের অপ্রতুলতা। আপনার কাছ থেকে ছবিটি তৈরির গল্পটি শুনতে চাই।
মুক্তিযুদ্ধের সময় যখন জহির রায়হান বললেন ছবি বানাবেন, আমি ইস্ট-ইন্ডিয়া মোশন পিকচার্স অ্যাসোসিয়েশনের অফিস সেক্রেটারি প্রামাণিকের সঙ্গে কথা বললাম। তাঁর সঙ্গে আগেও যোগাযোগ ছিল। তাঁর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের সময় এর আগেও অর্থ সাহায্য পেয়েছিলাম। তাঁকে বললাম, ‘আমরা একটা ছবি বানাতে চাই, মুক্তিযুদ্ধের ওপর।’ তখন তাঁর মাধ্যমে ভারতীয় ১৬ হাজার টাকার ব্যবস্থা হলো। জহির রায়হানকে সেই টাকা এনে দিলাম, বললাম, ‘এই নেন আপনার ফান্ড।’ আমরা ১৬ হাজার টাকায় ‘স্টপ জেনোসাইড’ বানালাম। অপর্ণা সেনের মামাশ্বশুর বড় মাপের ডকুমেন্টারি ফিল্মমেকার ছিলেন, অনেক ন্যাশনাল-ইন্টারন্যাশনাল পুরস্কার তিনি পেয়েছিলেন। তাঁর একটি ক্যামেরা ছিল, এই সিনেমা বানাতে ওই ক্যামেরা তিনি আমাদের দিলেন বিনা খরচে। কীভাবে বাংলাদেশে গণহত্যা হচ্ছিল, এটা পৃথিবীর মানুষ জানল এই চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। ছবিটি মুক্তিযুদ্ধে একটা বিরাট ভূমিকা রেখেছিল।
প্রশ্ন :
এই চলচ্চিত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আর কেউ কি আছেন?
আমার তো মনে হয় জীবিত আর কেউই নেই। ওই সিনেমা বানানোর সময় আলমগীর কবির, জহির রায়হান, আলী যাকের ও আমি ছিলাম। আরেকটা ছেলে বোধ হয় ছিল—নুরুল হক বাচ্চু—অ্যাসিস্ট করেছিল জহির রায়হানকে, আমার ঠিক মনে নেই।
প্রশ্ন :
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী ও কলাকুশলী সমিতি তৈরি করেছিলেন, তা কতটা সার্থক রূপ পেয়েছিল?
সবচেয়ে বড় সার্থকতা হচ্ছে, আমরা বিজয় অর্জন করেছি। আমরা তো হেরেও যেতে পারতাম। অনেক বড় দেশ আমাদের বিরুদ্ধে ছিল। স্বাধীনতা ও বিজয় অর্জন করেছি, সেটাই প্রথম সাফল্য। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি, মানুষের কল্যাণে কাজ করতে পারছি।
প্রশ্ন :
বিজয়ের ৫০ বছরে সাংস্কৃতিক অঙ্গন সামনের দিকে কতটা এগিয়েছে বলে মনে করছেন আপনি।
অনেকটাই এগিয়েছি। আমি তো বলব, চলচ্চিত্রে নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা খুব প্রতিভাবান। আমাদের কিন্তু ভারতের সঙ্গে তুলনা করা ঠিক হবে না, তাদের অনেক দিনের ঐতিহ্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তুলনা করাও ঠিক নয়। আমাদের দেশের অনুযায়ী আমরা এগিয়েছি। বেশ কয়েকটি ভালো চলচ্চিত্র আমরা পেয়েছি। এটাও ঠিক, সংখ্যাটা কমেছে। সারা পৃথিবীতেই কিন্তু ভালো ছবির সংখ্যা এমনিতেই কম। এখন কোনো দেশে বছরে ৫০০ সিনেমা তৈরি হলে মাত্র ৫টি ভালো ছবির খবর পাওয়া যায়। আমরা শুধু ভালো ছবির খবরটা পাই। শিল্পসম্মত ছবি সারা পৃথিবীতে কম, আমাদের এখানেও কম। এটাও ঠিক, নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা প্রতিভাবান। আমি মনে করি, তারা ক্রমেই এগিয়ে যাবে।
প্রশ্ন :
নতুন প্রজন্মে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের ব্যাপারে আপনার কোনো পরামর্শ?
আমি পরামর্শ দিতে যাব না। আমি বলতে চাই, সংস্কৃতি ব্যবহার করে শুধু নিজের উন্নয়ন নয়, দেশ ও মানুষের কল্যাণেও ব্যবহার করা দরকার। সংস্কৃতি নিজের অর্থ উপার্জন ও সুনাম অর্জনের জিনিস নয়। সংস্কৃতি জনগণ ও দেশের কল্যাণে ব্যবহার করার একটি বড় অস্ত্র।
প্রশ্ন :
আপনাকে আমরা মূলধারার বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রেও অভিনয় করতে দেখেছি। কী অবস্থা মূলধারার চলচ্চিত্রের?
এখন তো অনেক দিন আমি নেই। যথেষ্ট বয়সও হয়ে গেছে। চলচ্চিত্রে সোনালি দিন আর কোনো দিন আসবে কি না, আমি জানি না। সারা পৃথিবীরও একই দশা। পঞ্চাশ বা ষাটের দশকে ভারত ও আমেরিকায় চলচ্চিত্রের যে অবস্থা ছিল, সেখানেও তেমনটা নেই। তুলনা করাটাও ঠিক না।
প্রশ্ন :
বাংলাদেশের সংস্কৃতি নিয়ে আপনার আশাবাদের কথা শুনতে চাই।
একটা সময় যে রমরমা অবস্থা, সে জায়গায় ফিরে যাওয়া অসম্ভব। পেছন দিকে হাঁটার চিন্তা করাটাও ঠিক নয়। পেছন বা উল্টো দিকে তো ভূত হাঁটে, মানুষ তো হাঁটে না। আমরা সামনের দিকে হাঁটব। আগের চেয়ে আরও ভালো কিছুও হতে পারে।