সার্টিফিকেশন বোর্ড কী করছে

বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন বিধিমালা কার্যকর হওয়ার আগেই কাজ শুরু করে দিয়েছে সার্টিফিকেশন বোর্ড। আইন ছাড়াই কীভাবে কাজ করছে বোর্ড আর প্রস্তাবিত বিধিমালাতেই–বা কী থাকছে, খোঁজখবর করলেন মকফুল হোসেন

সাড়ে চার মাসে সাড়ে তিন শর বেশি সিনেমাকে সার্টিফিকেশন সনদ দিয়েছে সার্টিফিকেশন বোর্ডকোলাজ: প্রথম আলো গ্রাফিকস

সাড়ে চার মাসে সাড়ে তিন শর বেশি সিনেমাকে সার্টিফিকেশন সনদ দিয়েছে বোর্ড। এর মধ্যে ‘ভয়াল’, ‘বলী’, ‘দরদ’, ‘চাঁদের অমাবস্যা’, ‘বাড়ির নাম শাহানা’, ‘প্রিয় মালতী’র মতো সিনেমা যেমন আছে, তেমনি রয়েছে ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের দুই শতাধিক চলচ্চিত্র ও মাল্টিপ্লেক্সে মুক্তি পাওয়া হলিউডের চলচ্চিত্র।

২০২৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন বোর্ড’ গঠন করে সরকার। ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন আইন, ২০২৩’-এর ৩-এর উপধারা (১) অনুসারে গঠিত হয়েছে এই বোর্ড।

বোর্ডের প্রধান কাজ ছবির রেটিং দেওয়া। কোন ছবি কোন বয়সের দর্শকের জন্য উপযোগী, নির্ধারণ করে বোর্ড। আর এই রেটিং প্রদানের জন্য জরুরি বিধিমালা। কিন্তু বিধিমালা এখনো চূড়ান্ত হয়নি, প্রস্তাব আকারে রয়েছে। কেউ কেউ তাই প্রশ্ন তুলেছেন, বিধিমালা ছাড়াই সাড়ে চার মাস ধরে সার্টিফিকেশন বোর্ড কীভাবে কাজ করছে?

২০২৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন বোর্ড’ গঠন করে সরকার
ওয়েবসাইটের স্ক্রিনশট
আরও পড়ুন
গত ৩০ সেপ্টেম্বর প্রথম সিনেমা হিসেবে ‘ভয়াল’ দেখেছে সার্টিফিকেশন বোর্ড। ছবিটি ‘আনরেস্ট্রিক্টেড’ সনদ পেয়েছে।

সার্টিফিকেশন বোর্ড বলছে, মাসের পর মাস ধরে চলচ্চিত্র ছাড়পত্র না পাওয়ায় ইন্ডাস্ট্রি থমকে ছিল। সার্টিফিকেশন আইনের বিধিমালা চূড়ান্ত হওয়ার অপেক্ষায় থাকলে সিনেমার জট তৈরি হওয়ার আশঙ্কা ছিল। ফলে বিকল্প পথ খুঁজে নিয়েছে সার্টিফিকেশন বোর্ড।

পথটা কী? বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন বিধিমালার খসড়া যাচাই-বাছাই করে চূড়ান্তকরণের লক্ষ্যে গঠিত টেকনিক্যাল কমিটির সদস্য নির্মাতা ও প্রযোজক রফিকুল আনোয়ার রাসেল জানান, ‘চলচ্চিত্র সেন্সরশিপ আইন, ১৯৬৩’-এর ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সরশিপ বিধিমালা, ১৯৭৭’ অনুসারে সিনেমা দেখছে সার্টিফিকেশন বোর্ড। এই বিধিমালায় আনরেস্ট্রিক্টেড (সর্বজনীন) ও অ্যাডাল্ট (প্রাপ্তবয়স্ক ১৮+)—দুই ক্যাটাগরিতে সেন্সর দেওয়ার সুযোগ রয়েছে।

গত ৩০ সেপ্টেম্বর প্রথম সিনেমা হিসেবে ‘ভয়াল’ দেখেছে সার্টিফিকেশন বোর্ড। ছবিটি আনরেস্ট্রিক্টেড সনদ পেয়েছে। সার্টিফিকেশন বোর্ডের দেখা বেশির ভাগ ছবিই আনরেস্ট্রিক্টেড সনদ পেয়েছে। হলিউডের ‘জোকার ২’–সহ অল্প কয়েকটি ছবিকে ‘অ্যাডাল্ট’ সনদ দিয়েছে ঢাকার সার্টিফিকেশন বোর্ড।

আরও পড়ুন
সার্টিফিকেশন বোর্ডের দেখা প্রথম সিনেমা ‘ভয়াল’
ফেসবুক থেকে

১৯৬৩ সালের ‘সেন্সরশিপ অব ফিল্মস অ্যাক্ট’ রহিত করে ২০২৩ সালের ১৩ নভেম্বর ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন আইন’ গেজেট আকারে প্রকাশ করে বিগত সরকার। সার্টিফিকেশন আইন কার্যকরের পর রহিত হওয়া ‘সেন্সরশিপ অব ফিল্মস অ্যাক্ট’-এর বিধিমালায় ছবি দেখা কতটা যৌক্তিক, এমন প্রশ্নও উঠেছে।

প্রশ্নের জবাবে সার্টিফিকেশন বোর্ডের সদস্য নির্মাতা ও প্রযোজক রফিকুল আনোয়ার বলছেন, বিদ্যমান ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন আইন, ২০২৩’ মেনেই তাঁরা এটি করেছেন। সার্টিফিকেশন আইনের ২০ ধারার (রহিতকরণ ও হেফাজত) উপধারা (২)-এ বলা হয়, বিদ্যমান আইন কার্যকরের আগপর্যন্ত ‘সেন্সরশিপ অব ফিল্মস অ্যাক্ট’-এর বিধিমালায় ছবির ছাড়পত্র দেওয়া যাবে। সার্টিফিকেশন আইনের বিধিমালা কার্যকর হলে সেন্সরের বিধিমালা রহিত হবে।

১৯৭৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র ‘গোপন কথা’ অ্যাডাল্ট সনদ পেয়েছিল। ছবির পোস্টারে লেখা ছিল, ‘কেবলমাত্র প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য।’ আজাদ রহমান পরিচালিত এই সিনেমায় কবরী, সোহেল রানাসহ অনেকে অভিনয় করেছেন।

সব ছবি সর্বজনীন কেন

১৯৭৭ সালে কার্যকর হওয়া বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সরশিপ বিধিমালায় ‘অ্যাডাল্ট’ ক্যাটাগরিও ছিল। এখন পর্যন্ত কয়টি বাংলা সিনেমা ‘অ্যাডাল্ট’ সনদ পেয়েছে, সুনির্দিষ্টভাবে তা জানা যায়নি। ১৯৭৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র ‘গোপন কথা’ অ্যাডাল্ট সনদ পেয়েছিল। ছবির পোস্টারে লেখা ছিল, ‘কেবলমাত্র প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য।’ আজাদ রহমান পরিচালিত এই সিনেমায় কবরী, সোহেল রানাসহ অনেকে অভিনয় করেছেন।

বাংলা চলচ্চিত্রের রমরমা সময়েও তারকাবহুল ছবিটি ফ্লপ করে। আশি-নব্বইয়ের দশকের দর্শক মূলত পারিবারিক গল্প, ফোক-ফ্যান্টাসি ঘরানার সিনেমা দেখতে ভিড় করতেন। ফলে গোপন কথার মতো ‘অ্যাডাল্ট’ ছবি বাজার পায়নি।

১৯৭৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র ‘গোপন কথা’ অ্যাডাল্ট সনদ পেয়েছিল
আইএমডিবি

চিত্র পরিচালক ও চলচ্চিত্র–গবেষক মতিন রহমান প্রথম আলোকে জানান, আশি-নব্বইয়ের দশকে দর্শক পরিবার নিয়ে বাংলা সিনেমা দেখতেন। বিষয়টি মাথায় রেখে ‘সর্বজনীন’ সিনেমা বানাতেন নির্মাতারা।

তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সিনেমা নির্মাণের ধারায় পরিবর্তন এসেছে। দর্শকের বৈচিত্র্যময় চলচ্চিত্র দেখার আগ্রহ তৈরি হয়েছে। এ পরিবর্তনকে আমলে নিচ্ছেন এই চলচ্চিত্র–গবেষক। তাঁর ভাষ্যে, ‘এখন তো অ্যাডাল্ট সিনেমা হচ্ছে। নির্মাতার স্বাধীনতা আছে, দর্শকেরাও স্বাধীনভাবে ছবি দেখছেন। সময়, পরিবেশ—সবকিছু মিলিয়ে একটা পরিবর্তন এসেছে বলেই তাঁরা সাহস পাচ্ছেন।’

হলিউডের ‘জোকার ২’ ছবিকে ‘অ্যাডাল্ট’ সনদ দিয়েছে ঢাকার সার্টিফিকেশন বোর্ড
আইএমডিবি

প্রস্তাবিত বিধিমালায় কী থাকছে

১৯৭৭ সালের সেন্সরশিপ বিধিমালায় দুটি ক্যাটাগরি থাকলেও প্রস্তাবিত ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন বিধিমালা, ২০২৫’-এ পাঁচটি ক্যাটাগরি থাকছে—১. ইউ: সব বয়সী মানুষ দেখতে পারবেন। ২. ১২‍+: ১২ বছরের বেশি বয়সী দর্শক দেখতে পারবে। ৩. ১৫‍+: ১৫ বছরের বেশি বয়সী দর্শক দেখতে পারবে। ৪. ১৮‍+: ১৮ বছরের বেশি বয়সী দর্শক দেখতে পারবেন। ৫. এস: শুধু বিশেষ শ্রেণি-পেশার মানুষের দেখার উপযোগী।

ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডসহ বিশ্বের বহু দেশে সার্টিফিকেশন (রেটিং) প্রথা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ভারতের আদলে বাংলাদেশের রেটিং প্রস্তাব করা হয়েছে।

প্রস্তাবিত ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন বিধিমালা, ২০২৫’-এ পাঁচটি ক্যাটাগরি থাকছে—১. ইউ: সব বয়সী মানুষ দেখতে পারবেন। ২. ১২‍+: ১২ বছরের বেশি বয়সী দর্শক দেখতে পারবে। ৩. ১৫‍+: ১৫ বছরের বেশি বয়সী দর্শক দেখতে পারবে। ৪. ১৮‍+: ১৮ বছরের বেশি বয়সী দর্শক দেখতে পারবেন। ৫. এস: শুধু বিশেষ শ্রেণি-পেশার মানুষের দেখার উপযোগী।

‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন বিধিমালা’র খসড়া যাচাই-বাছাই করে চূড়ান্তকরণের লক্ষ্যে ৯ সদস্যের টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করেছে সরকার। এতে সরকারি কর্মকর্তাদের বাইরে সদস্য হিসেবে রয়েছেন শিক্ষক, নির্মাতা ও প্রযোজক রফিকুল আনোয়ার; নির্মাতা ও প্রযোজক তানিম নূর এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টেলিভিশন, ফিল্ম অ্যান্ড ফটোগ্রাফি বিভাগের চেয়ারপারসন এস এম ইমরান হোসেন।

রফিকুল আনোয়ার জানান, প্রস্তাবিত বিধিমালা নিয়ে ২ ও ২০ জানুয়ারি টেকনিক্যাল কমিটি দুটি বৈঠক করেছে। ৭ ফেব্রুয়ারি চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজকসহ অংশীজনদের নিয়ে আরেকটি বৈঠক করা হয়েছে। ওটিটি ও স্বাধীন ধারার নির্মাতাদের নিয়ে আরেকটি বৈঠক করা হবে। সবার সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনে পরিবর্তনও আসতে পারে। এরপর বিধিমালাটির খসড়া চূড়ান্ত করা হবে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, বিধিমালার খসড়া চূড়ান্ত হওয়ার পর প্রচলিত নিয়ম অনুসরণ করে দ্রুততম সময়ের মধ্যেই বিধিমালাটি কার্যকর করা হবে।

বিধিমালা প্রণয়নে গঠিত টেকনিক্যাল কমিটির এক সদস্য জানান, ১৯৭৭ সালের সেন্সরশিপ বিধিমালার দুই ক্যাটাগরিতে কোনো নির্দেশনা ছিল না। তবে এবারের বিধিমালায় প্রতিটি ক্যাটাগরির সঙ্গে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা থাকবে, যেটি নির্মাতা ও প্রযোজকদের জন্য সহায়ক হবে।

আরও পড়ুন
মধুমিতা সিনেমা
প্রথম আলো

হলমালিকেরা কী বলছেন

রেটিং প্রথা কার্যকর করার ক্ষেত্রে সিনেমা হলগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। যেমন ১২+ পাওয়া কোনো ছবি ১২ বছরের কম বয়সী কোনো দর্শক দেখতে পারবে না। রেটিং অনুযায়ী ছবি প্রদর্শনের ক্ষেত্রে হলগুলোকে দর্শকের বয়স যাচাই–বাছাই করতে হবে। যেহেতু দেশে রেটিং প্রথার চল তেমন একটা ছিল না, সে ক্ষেত্রে এ অনুযায়ী হলগুলো দর্শকের বয়স যাচাই–বাছাই কতটুকু করতে পারবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।

এ বিষয়ে সিনেমা হলের মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আওলাদ হোসেন বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে আমাদেরও কিছু প্রস্তাব আছে। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ে ৭ ফেব্রুয়ারির বৈঠকে আমরা সেটা জানিয়েছি।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক হলমালিক প্রথম আলোকে বলেন, ‘১৫‍+ কোনো ছবি দেখতে একটি পরিবার এলে সেখান থেকে ১২ বছর বয়সী সন্তানকে কীভাবে ফিরিয়ে দেব! এটা বাংলাদেশের পটভূমিতে খুব জটিল হবে। বিষয়টি নিয়ে আমরাও ভাবছি।’

এদিকে রেটিং নিয়ে দর্শকের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর ব্যাপারে তাগিদ দিচ্ছেন বিশ্লেষকেরা।

আরও পড়ুন