জনপ্রিয়তা ও শৈল্পিক প্রশংসা নিয়ে ‘কহে বীরাঙ্গনা’র শততম প্রদর্শনী
মণিপুরি থিয়েটারের ‘কহে বীরাঙ্গনা’ নাটকটি দেখে অবাক হয়েছি! মানসম্পন্ন এবং চমৎকার কাজ। যিনি পারফরম্যান্স করলেন, আমার মনে হয়, পৃথিবীর যেকোনো জায়গায়, যেকোনো নাট্যোৎসবে আমরা যত শক্তিমান অভিনেত্রী দেখেছি, তিনি তাঁদের মধ্যে অন্যতম! ২০১৫ সালে প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এমন মন্তব্য করেন উপমহাদেশের খ্যাতনামা নাট্যব্যক্তিত্ব ভারতের ‘ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা’র সাবেক চেয়ারম্যান রতন থিয়াম। সেবার তিনি মণিপুরি-অধ্যুষিত কমলগঞ্জে গিয়ে দেখেছিলেন ‘কহে বীরাঙ্গনা’। রতন থিয়ামের মতো ‘কহে বীরাঙ্গনা’য় মুগ্ধ হয়েছেন অনেক থিয়েটার অনুরাগী, বিদগ্ধজন। মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’ থেকে নাটকটির নির্দেশনা দিয়েছেন শুভাশিস সিনহা। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল ছাড়াও ভারতের আসাম, ত্রিপুরায় এ নাটকের মঞ্চায়ন হয়েছে। দেখতে দেখতে শততম প্রদর্শনীর সামনে দাঁড়িয়ে নাটকটি। আজ বৃহস্পতিবার রাজধানীর বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির পরীক্ষণ থিয়েটার মিলনায়তনে সন্ধ্যা সাতটায় অনুষ্ঠিত হবে ৯৯তম প্রদর্শনী। আগামীকাল একই সময় ও স্থানে হবে নাটকটির শততম প্রদর্শনী।
‘কহে বীরাঙ্গনা’য় চার পৌরাণিক চরিত্র শকুন্তলা, দ্রৌপদী, দুঃশলা ও জনার প্রেম, বিরহ, ঈর্ষা, বেদনা, ক্ষোভ আর দ্রোহের মধ্য দিয়ে নারীর বহুমাত্রিক রূপের নান্দনিক প্রকাশ ঘটেছে। যুদ্ধ নয়, প্রেমেই মানুষের মুক্তি—এটিই এ নাটকের মূলকথা। মঞ্চে চার নারী চরিত্রে একক অভিনয় করেছেন জ্যোতি সিনহা।
নাটকের শুরুটা ১৪ বছর আগে, ২০১০ সালের ২৪ ডিসেম্বর। কমলগঞ্জের ঘোড়ামারায় মণিপুরি থিয়েটারের নটমণ্ডপ থেকে এর যাত্রা।
“কহে বীরাঙ্গনা” নাটকে জ্যোতি সিনহার অভিনয় দেখে চমকে উঠেছিলাম। এমন শক্তিমান অভিনয়শিল্পী যে এত দিন নিভৃতে ছিলেন, মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের মণিপুরি সমাজে, তা ভাবতেই পারিনি।
সেই সময়ের কথা জানতে চাইলে নাটকের অভিনেত্রী জ্যোতি সিনহা স্মৃতিচারণা করেন, ‘আমাদের স্টুডিও থিয়েটার নটমণ্ডপ উদ্বোধন হয়েছিল এই নাটক দিয়ে। গ্রামের কাঁচা রাস্তা ধরে বিভিন্ন বয়সের মানুষজন নাটক দেখতে এসেছিল। দুই দিনে বিকেল ও রাত মিলিয়ে চারটি শো করেছিলাম। টিকিটের দাম ছিল মাটিতে ২০ টাকা, চেয়ারে ৫০ টাকা। মাটিতে খড় বিছিয়ে দেওয়া হয়েছিল, শিশুরা ১০ টাকা দিয়ে নাটক দেখতে এসেছিল।’ ‘কহে বীরাঙ্গনা’ নাটকটিকে জীবনের টার্নিং পয়েন্ট—এমন মন্তব্য করে জ্যোতি সিনহা বলেন, ‘নাটকটির জন্য জীবনে অনেক মানুষের ভালোবাসা, মায়া-মমতা অর্জন করেছি। আমরা ১০ জনের টিম শো শেষ করে দেখতাম, মানুষ একটা তৃপ্তি নিয়ে বের হয়ে যেত, যদিও আমি বেদনায় ভারাক্রান্ত থাকতাম, এখনো তা–ই। শেষ পর্বটি বেদনাদায়ক, যেখানে সন্তানহারা এক মায়ের আর্তনাদ দিয়ে নাটকটি শেষ হয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘আজ এ সময়ে এসে স্মৃতিরা যেন চোখের সামনে লুটোপুটি খাচ্ছে। সে সময় অনেক সহশিল্পী আমার সাথে কাজ করেছে, তারা এখন জীবনের তাগিদে, সংসারের তাগিদে, সময়ের তাগিদে সরে গেছে, অনেক নতুন শিল্পী যুক্ত হয়েছে। মনে পড়ছে সহশিল্পী শুক্লা, ভাগ্যলক্ষ্মী, স্মৃতি, সুনন্দা, অরুণাসহ অনেককেই। ৯৯টি প্রদর্শনী পর্যন্ত যাঁরা এই নাটকে কাজ করেছেন, তাঁদের সবাইকে ভালোবাসা জানাই।’
১৯৯৭ সালে আজবপুরের বর্ষবরণ নাটকে অভিনয় দিয়ে মঞ্চযাত্রা শুরু করেন মৌলভীবাজারের ঘোড়ামারা গ্রামের জ্যোতি। তবে ‘কহে বীরাঙ্গনা’ নাটক দিয়েই সারা দেশে, এমনকি ভারতের মঞ্চপাড়ায় দিনে দিনে সু–অভিনেত্রী হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন তিনি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নৃবিজ্ঞানে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর করেছেন। তারপর একই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ থেকে রাসলীলা ও মণিপুরি সমাজ বিষয়ে এমফিল শেষ করেছেন। তাঁর প্রতিভায় মুগ্ধ নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার প্রথম আলোতে লিখেছেন, ‘“কহে বীরাঙ্গনা” নাটকে জ্যোতি সিনহার অভিনয় দেখে চমকে উঠেছিলাম। এমন শক্তিমান অভিনয়শিল্পী যে এত দিন নিভৃতে ছিলেন, মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের মণিপুরি সমাজে, তা ভাবতেই পারিনি।’ রামেন্দু মজুমদারের মতে, মাইকেলের ভাষা কঠিন, তার ওপর কাব্য; জ্যোতির মাতৃভাষাও বাংলা নয়। তা সত্ত্বেও যেভাবে তিনি ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’–এর চরণগুলো আত্মস্থ করেছেন, ভাবলে বিস্মিত হতে হয়। চার পর্বে মহাভারতের চারটি চরিত্র শকুন্তলা, দ্রৌপদী, দুঃশলা ও জনার ভূমিকায় সম্পূর্ণ আলাদা ব্যক্তি হয়ে অভিনয়ের পারদর্শিতা প্রদর্শন করেছেন জ্যোতি। চরিত্রের গভীরতা অনুভব করা, সংলাপ প্রক্ষেপণে স্পষ্টতা, উচ্চারণের শুদ্ধতা, নৃত্যগীতে দক্ষতা—সব মিলিয়ে জ্যোতির অভিনয় দর্শকের মনে গভীর ছাপ ফেলতে সক্ষম হয়।
শুক্রবার শততম মঞ্চায়নের পর নাটকটি নিয়ে দর্শকের সঙ্গে কথা বলবেন ‘কহে বীরাঙ্গনা’র সঙ্গে জড়িত শিল্পীরা। এ ছাড়া এদিন অভিনেত্রী জ্যোতি সিনহাকে সম্মাননা প্রদান করবে মণিপুরি থিয়েটার।
নির্দেশক শুভাশিস সিনহাও জ্যোতির অভিনয়ে মুগ্ধ। তিনি বলেন, ‘এই নাটক এতটা সাড়া ফেলবে, আমরা প্রথমে তা ভাবিই–নি। বরং খুব শঙ্কায় ছিলাম, দর্শক আপাত–নাটকীয়তাহীন একেবারে কাব্যধর্মী নাটকটি কীভাবে গ্রহণ করবে। কিন্তু দর্শক অবাক করে দিয়ে প্রবলভাবে গ্রহণ করল, উচ্ছ্বসিত হলো। অভিনেত্রী জ্যোতি সিনহার অভিনয়ের শক্তি এর প্রধান কারণ বলা যায়। সংগীত (শর্মিলা সিনহা) আর বাদ্যও (বিধান চন্দ্র সিংহ ও বাবুচান সিংহ) একটা বড় ভূমিকা রেখেছে নাটকটিতে। সব মিলিয়ে কাব্যকে একটা জৈবসুষমায় বাঁধার যে আকাঙ্ক্ষা নির্দেশক হিসেবে মনে রেখেছিলাম, তার একটা অভূতপূর্ব প্রকাশ ঘটেছে বলা যায়। বাংলা ক্ল্যাসিক আর মণিপুরি ঐতিহ্যের ছন্দ-মুদ্রা এবং আধুনিক থিয়েটারের সিনথেসিস—এসব মিলেই ‘কহে বীরাঙ্গনা’। এমন দুরূহ একটি নাটকের শততম প্রদর্শনী হতে যাচ্ছে, জনপ্রিয়তা ও শৈল্পিক প্রশংসার সঙ্গে—এ গভীর আনন্দের। বিশুদ্ধ শিল্পের এই অভিযাত্রা যেকোনো শিল্পীকে আলোর পথ দেখাবে।’
শুক্রবার শততম মঞ্চায়নের পর নাটকটি নিয়ে দর্শকের সঙ্গে কথা বলবেন ‘কহে বীরাঙ্গনা’র সঙ্গে জড়িত শিল্পীরা। এ ছাড়া এদিন অভিনেত্রী জ্যোতি সিনহাকে সম্মাননা প্রদান করবে মণিপুরি থিয়েটার।