এই নাটক নিয়ে বিতর্ক হবে
১৯৭৩ সালের ২৯ জুলাই কয়েকজন তরুণ প্রতিষ্ঠা করেন ঢাকা থিয়েটার। গত ৫০ বছরে ঢাকা থিয়েটার ৫০টি নাটক করেছে। শহরের অন্যতম প্রাচীন দলটি গতকাল এনেছে নতুন নাটক ‘মেডিয়া’। জাতীয় নাট্যশালার স্টুডিও থিয়েটার মিলনায়তনে নাটকটির উদ্বোধনী মঞ্চায়ন হয়। গ্রিক নাট্যকার ইউরেপিডিসের ‘মেডিয়া’র ইংরেজি অনুবাদ করেছেন জর্জ থিওরিদিস। বাংলায় রূপান্তর করেছেন আবদুস সেলিম, নির্দেশনা দিয়েছেন হুমায়ুন কবির।
১৯৭৩ সালের ২৯ জুলাই প্রথম নাটক মঞ্চায়নের উদ্যোগ নিয়েছিলেন ঢাকা থিয়েটারের তরুণ সদস্যরা। কিন্তু সেদিন তুমুল বৃষ্টিতে পানি ওঠে ঢাকা জেলা ক্রীড়া সমিতি মিলনায়তনে। ফলে মঞ্চায়ন সম্ভব হয়নি। ওই বছরের নভেম্বরে দুই টাকা দর্শনীর বিনিময়ে যুগল নাটক মঞ্চায়ন শুরু করে ঢাকা থিয়েটার। নাটক দুটি হচ্ছে নাসির উদ্দীন ইউসুফ নির্দেশিত ‘সংবাদ কার্টুন’ ও হাবিবুল হাসান নির্দেশিত ‘সম্রাট ও প্রতিদ্বন্দ্বীগণ’। সর্বশেষ ২০২২ সালে পরীক্ষামূলক মঞ্চায়ন হয়েছিল ঢাকা থিয়েটারের ৫০তম প্রযোজনা ‘নৈশব্দে ৭১’ নাটকের। এটি ছিল ব্রিটিশ কাউন্সিলের সঙ্গে যৌথ প্রযোজনা। গতকাল ২২ অগ্রহায়ণের বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যায় এই দলের নতুন নাটকের উদ্বোধনী মঞ্চায়নে ছিলেন মিলনায়তনভর্তি দর্শক।
তবে ৫১তম প্রযোজনার উদ্বোধনী দিনে দুটি প্রশ্ন মনে জাগে। ঢাকা থিয়েটারের মতো বড় এবং জনপ্রিয় দলের নতুন নাটক কেন অপরিসর স্টুডিও থিয়েটার মঞ্চে? দ্বিতীয়ত, প্রতিষ্ঠার শুরু থেকে তারা বলে আসছে, মৌলিক তথা দেশজ নাটকে অঙ্গীকারবদ্ধ। তাহলে সুবর্ণজয়ন্তীতে অনুবাদ নাটক কেন?
প্রযোজনা অধিকর্তা নাসির উদ্দীন ইউসুফ দুটি প্রশ্নেরই জবাব দিলেন। শুরুতে তিনি জানালেন, তাঁরা দেশজের পাশাপাশি বিশ্বনাট্যধারার নাট্যচর্চাও করে। এর আগে শেক্সপিয়ারের ‘দ্য টেম্পেস্ট’, বার্টোল্ট ব্রেখটের ‘ধূর্ত উই’ করে সাড়া ফেলেছিল। তাঁর ভাষায়, ‘সারা বিশ্বের নাটক ও নাট্য প্রয়োগ উপলব্ধি করলেই না দেশজ নাটককে সমৃদ্ধ করে তার মাধ্যমে আন্তর্জাতিকতা অর্জন সম্ভব হবে। আমরা বিশ্বের সব সৃষ্টিশীল শিল্পের আঙ্গিক, বিষয় ও প্রয়োগকৌশল জ্ঞাত হয়ে দেশজ শিল্পের ও নাট্যের উন্নতি ঘটাতে চাই।’
নাসির উদ্দীন ইউসুফ আরও বলেন, ‘ঢাকা থিয়েটার উগ্র জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করে না। পৃথিবীর নানা জাতিসত্তার শিল্পসুধা পান করে বিশ্বমানবযাত্রার অংশীদার হতে চায়, তবে অবশ্যই তা হবে জাতিসত্তার সংস্কৃতির নিজস্বতা অক্ষুণ্ন রেখে।’
তুলনামূলক ছোট মিলনায়তনে প্রদর্শনী প্রসঙ্গে কিছুটা হতাশা ফুটে উঠল নাসির উদ্দীন ইউসুফের কথায়। তাঁর মতে, ‘মেডিয়া’ নাটকের রূপটাই এমন, ঘনিষ্ঠ। দর্শকের কাছাকাছি এবং অল্প দর্শকের সামনে করা ভালো। তা ছাড়া এখন যেমন বড় হল পাওয়া কঠিন, তেমনি দর্শকের সংকটও দিন দিন বাড়ছে। প্রথম কয়েকটি শোর পরে আর মিলনায়তন পূর্ণ হয় না। ব্যস্ত এই নগরের যাতায়াত, টিকিটের মূল্যবৃদ্ধি, বিনোদনের বিচিত্র ক্ষেত্র তৈরিসহ নানা কারণে দর্শক ক্রমাগত কমছে।
বৃহস্পতিবার বিরূপ আবহাওয়ার মধ্যেও স্টুডিও থিয়েটারে দর্শক উপস্থিতিতে সন্তুষ্ট আয়োজকেরা। নাটকের আলোক পরিকল্পক ওয়াসিম আহমেদ তো বলেই ফেললেন, ‘এত দর্শক হবে আমরা কল্পনাও করিনি। এমন বৃষ্টি ভেঙে আমি হয়তো অন্য দলের নাটক দেখতে যেতাম না!’
ঢাকা থিয়েটার উগ্র জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করে না। পৃথিবীর নানা জাতিসত্তার শিল্পসুধা পান করে বিশ্বমানবযাত্রার অংশীদার হতে চায়, তবে অবশ্যই তা হবে জাতিসত্তার সংস্কৃতির নিজস্বতা অক্ষুণ্ন রেখে।
নাটক নিয়ে আগের দিন কারিগরি প্রদর্শনীতে ধারণা পেয়েছেন সংবাদকর্মীরা। লাল, কালো রঙে করা পোস্টারে নারীর মুখাবয়ব, রক্তাক্ত ছোরা দেখে নাটকের গল্পের আভাস মেলে। নাটকে দেখা যায়, মেডিয়াকে তার স্বামী কীভাবে নিগৃহীত এবং তুচ্ছ ব্যবহার করে তার পুরুষতান্ত্রিক ইচ্ছা ও উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে চরিতার্থ করে। একসময় মেডিয়া প্রতিশোধপ্রবণ হয়ে হিংস্র হয়ে ওঠে। অনুবাদক আবদুস সেলিম জানিয়েছেন, অনুবাদ করার সময় একটি বিষয় তাঁর কাছে রহস্যের মতো লেগেছে। তাঁর কাছে মনে হয়েছে, আড়াই হাজার বছর আগে ইউরিপিডিস নামের একজন নাট্যকার কি সত্য অর্থে কোনো এক অবচেতন মন থেকে নারীবাদী চিন্তাচেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে নাটকটি লিখেছিলেন? নাকি শুধু একজন নারীর সম্ভাব্য অবহেলা এবং এর ফলে তার জিঘাংসা–আকাঙ্ক্ষার কথা লিপিবদ্ধ করতে চেয়েছিলেন? নাটকের মঞ্চায়ন উপলক্ষে প্রকাশিত পরিচিতিপত্রে তিনি লিখেছেন, ‘আমি জানি, নাটকটি অনেক বিতর্কের জন্ম দিতে পারে, তবু ‘মেডিয়া’র প্রাসঙ্গিকতা অস্বীকার করা যাবে না কোনোক্রমেই।’
আমি জানি, নাটকটি অনেক বিতর্কের জন্ম দিতে পারে, তবু ‘মেডিয়া’র প্রাসঙ্গিকতা অস্বীকার করা যাবে না কোনোক্রমেই।
নির্দেশক হুমায়ুন কবীরও মনে করছেন, নাটকটি নিয়ে বিতর্ক হবে। হয়তো অনেক দর্শক মেনে নিতে পারবেন না, বিশেষ করে প্রতিশোধের আক্রোশে মেডিয়ার নৃশংসতা ও সন্তান হত্যার মতো বিষয়গুলো। হুমায়ুন কবীর বলেন, ‘আমি তিন মাস ধরে এই নাটকের কাজ করেছি। আলোচনা–সমালোচনা যা–ই হোক, আমি আশা করব, দর্শক আমাদের এই মিথস্ক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থেকেই নাটকের মূল রসটুকু অনুধাবন করতে পারবেন।’
গ্রিক ভাষার একজন প্রথিতযশা ট্র্যাজেডি রচয়িতা ইউরিপিডিস। ক্ল্যাসিক গ্রিক সংস্কৃতিতে সবচেয়ে প্রভাবশালী নাট্যকার বলা হয় তাঁকে। এই সময়ে এসে তাঁর ‘মেডিয়া’ গল্পটির প্রাসঙ্গিকতা খুঁজে পান নাট্যব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফ। শুধু যে প্রাসঙ্গিকতা পান তা নয়, তিনি বিস্মিতও, ‘পুরুষের লোভ ও উচ্চাভিলাষে নারীর সামাজিক মূল্যায়ন, নিপীড়িত ও প্রতারিত হওয়ার চিত্র প্রায় আড়াই হাজার বছর আগের সঙ্গে কী অদ্ভুতভাবে মিলে যায়! নাটক নয়, যেন–বা এই তো গত মাসে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া বীভৎস ঘটনা প্রত্যক্ষ করলাম।’ তিনি বলেন, মেডিয়ার নৃশংস কর্ম শুধু সন্তান হত্যার ঘটনায় সীমাবদ্ধ নয়; এটি নিপীড়িত, নির্যাতিত নারীর অস্তিত্বের আর্তনাদ।
গ্রিক ভাষার একজন প্রথিতযশা ট্র্যাজেডি রচয়িতা ইউরিপিডিস। ক্ল্যাসিক গ্রিক সংস্কৃতিতে সবচেয়ে প্রভাবশালী নাট্যকার বলা হয় তাঁকে। এই সময়ে এসে তাঁর ‘মেডিয়া’ গল্পটির প্রাসঙ্গিকতা খুঁজে পান নাট্যব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফ।
আগামীকাল শনিবার ৯ ডিসেম্বর বিকেল পাঁচটা ও সন্ধ্যা সাতটায় থাকছে নাটকের দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রদর্শনী। নাটকে মেডিয়া চরিত্রে অভিনয় করেছেন তাহমিনা মাহমুদ। নাটকে আরও আছেন ফাহমিদা কামাল, মাহমুদুর রহমান, সাইফুদ্দিন আহমেদ, মিলু চৌধুরী, আবদুল গনি, সিফাত ও আদৃতা। নেপথ্যে কণ্ঠ দিয়েছেন শিমুল ইউসুফ, মঞ্চ পরিকল্পনা করেছেন জুনায়েদ ইউসুফ।
ঢাকা থিয়েটার পাঁচ দশকের পথচলায় বেশ কিছু আলোচিত ও সাড়া জাগানো নাটক মঞ্চে এনেছে। ‘মুনতাসির ফ্যান্টাসি’, ‘যৈবতী কন্যার মন’, ‘বনপাংশুল’, ‘কিত্তনখোলা’, ‘কেরামত মঙ্গল’, ‘বিনোদিনী’, ‘প্রাচ্য’, ‘মার্চেন্ট অব ভেনিস’, ‘শকুন্তলা’, ‘নিমজ্জন’, ‘চাকা’, ‘ধাবমান’, ‘হাত হদাই’, ‘পঞ্চনারী আখ্যান’, ‘পুত্র’ ইত্যাদি তাদের প্রশংসিত নাটকগুলোর মধ্যে অন্যতম। দলের সদস্যরা আশা করছেন, ‘মেডিয়া’ এ তালিকায় যোগ হবে।