মঞ্চের আলো জ্বলবে কবে
ঢাকার নাটকপাড়ায় ‘আনা ফ্রাঙ্ক’ নাটকটি সাড়া ফেলেছে। মঞ্চনাটকের সমালোচকেরা নাটকের একমাত্র চরিত্র আর্য মেঘদূতের অভিনয়ের প্রশংসা করেছেন। ইংল্যান্ডের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইউনিভার্সিটি অব অক্সফোর্ডে পড়তে যাচ্ছেন আর্য। সব ঠিক থাকলে অক্টোবরে উড়াল দেবেন। তার আগে শেষবারের মতো আনা ফ্রাঙ্ক মঞ্চায়নের উদ্যোগ নেয় ম্যাড থেটার। গত ১৯ জুলাই সন্ধ্যায় ঢাকার শিল্পকলা একাডেমির পরীক্ষণ থিয়েটার মিলনায়তনে নাটকটির প্রদর্শনীর কথা ছিল। প্রস্তুতিও নেওয়া হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেদিন নাটকটি আর প্রদর্শিত হয়নি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কারণে সেদিন নাটক মঞ্চায়নের পরিবেশ ছিল না। এরপর সারা দেশে ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়, জারি করা হয় কারফিউ।
দেশ ছাড়ার আগে শেষবারের মতো নাটকটির মঞ্চায়নে অংশ নিতে না পারায় আর্যর মন খারাপ। গতকাল রোববার দুপুরে আর্য মেঘদূত প্রথম আলোকে বললেন, ‘একদিক দিয়ে তো খুশি, ছাত্র–জনতার আন্দোলন শেষ পর্যন্ত বিজয়ে পরিণত হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারও দায়িত্ব নিয়েছে। কিন্তু পরিস্থিতি এখনো এমন নয় যে শো করা যাবে। তা ছাড়া ইংল্যান্ডে যাওয়ার আগে হাতে এত কম সময়, ব্যস্ত সময় কাটবে; মনে হয় না শেষ পর্যন্ত করা হবে।’
শুধু ‘আনা ফ্রাঙ্ক’ নয়, ঢাকার শিল্পকলা একাডেমিসহ সারা দেশের কোনো শিল্পকলা একাডেমিতে গত এক মাসে পূর্বঘোষিত আরও বেশ কয়েকটি নাটকের মঞ্চায়ন হয়নি। কবে হবে, তা নিয়েও নির্দিষ্ট করে কিছুই বলতে পারছেন নাটকসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। সবার আশা, শিগগিরই শিল্পকলা একাডেমি খুলে দেওয়া হবে। নাট্যচর্চায় মুখর থাকবে ঢাকাসহ দেশের সব মঞ্চ।
নাট্যজন মামুনুর রশীদ মনে করছেন, দ্রুত মানুষের সাংস্কৃতিক জীবনে ফিরে আসা উচিত। তাই তাড়াতাড়ি মঞ্চের আলো জ্বলা উচিত। তিনি বললেন, ‘জীবন যখন স্বাভাবিক হয়, তার বড় প্রতিফলন, সাংস্কৃতিক জীবন শুরু হওয়া। থিয়েটার তো সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করে। কাজেই শিল্পকলা একাডেমি আর বন্ধ রাখা উচিত নয়। সবাই নাট্যচর্চায় মুখর থাকুক। মানুষ আবার নাটকমুখী হোক।’
দর্শকের নিরাপত্তার বিষয়টিও নিশ্চিত করার দিকটায় জোর দিলেন মামুনুর রশীদ। কারণ হিসেবে বললেন, ‘নাটক দেখার জায়গাগুলো যখন মুখর হবে, তখন দেখা গেল, কেউ নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড করে বসল! এতে দর্শক নাটক দেখায় আগ্রহ হারাবে। ঘাবড়ানোর ব্যাপার আছে। কারণ, ভাস্কর্য ভাঙা হয়েছে, বিভিন্ন পাঠাগার ও সারা দেশে ২২টি শিল্পকলায় আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। তাই যখন আবার সাংস্কৃতিক জীবন ফিরিয়ে আনতে চাওয়া হবে, নিরাপত্তা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে।’
ঢাকার বেইলি রোডের মহিলা সমিতি এরই মধ্যে খুলেছে, আহ্বান জানানোও হয়েছে নাটক মঞ্চস্থের ব্যাপারে, জানালেন মোহাম্মদ আলী হায়দার। এটাকে ইতিবাচক উল্লেখ করে তিনি জানালেন, শিল্পকলাও এই সপ্তাহে খুলে দেওয়া দরকার।
সরকার পরিবর্তনের পর শিল্পকলা একাডেমিতেও বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে ইঙ্গিত করে আলী হায়দার বলেন, ‘এত দিন অনেক মানুষ ছিল, যারা শিল্পকলা একাডেমি পরিচালনা করত, তারা যেহেতু কেউ নেই সেখানে, আগে একজন সঠিক মানুষ আনা জরুরি। এরপর খুলে দেওয়া উচিত। নাটকের দলগুলোর অবস্থাও সুবিধার নয়। গত ১৬ বছরে বাংলাদেশের বেশির ভাগ নাটকের দলপ্রধানেরা স্বৈরাচার সরকারের পক্ষে ছিলেন। তবে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্তরে যারা ছিল, ছাত্র আন্দোলনে তাদের সমর্থন ছিল। তাই এখন প্রতিটি দলে সমস্যা বিরাজ করছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন দলের ৩৪ জন প্রধান ব্যক্তি সরকারের পক্ষে বিবৃতি দিয়েছিলেন, তাঁদের সঙ্গেও আলোচনা করতে হবে। তাঁদের আমরা ফেলে দিতে পারব না। কারণ, তাঁরা আমাদের অগ্রজ। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে, প্রতিটি দলের নাট্যচর্চা কীভাবে শুরু করবেন, সে প্রক্রিয়া চালু করতে হবে।’
আলী হায়দার এ–ও বললেন, ‘নাট্য দলগুলোকে আহ্বান জানাচ্ছি নিজেদের দলের সবার সঙ্গে কথা বলে নাট্যচর্চা শুরু করতে। কারণ, একটা বিভেদ তৈরি হয়ে গেছে। একই দলে দুই পক্ষ হয়ে গেছে। যারা সংস্কৃতি চর্চা করতে চায়, নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে আগাতে হবে। কথা বলতে হবে, কথা বলার বিকল্প নেই। যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে, তা এই সরকারও যদি করে। সংস্কৃতিকর্মীরা লেজুড়বৃত্তি বা দালালি না করে যেন অন্যায়ে সবার আগে কথা বলে।’
১৩ বছর ধরে শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালনের পর সম্প্রতি পদত্যাগ করেছেন লিয়াকত আলী লাকী। এর পর থেকে শিল্পকলায় অস্থিরতা। নতুন মহাপরিচালক দ্রুত নিয়োগ শেষে শিল্পকলা খুলে দেওয়া উচিত, জানালেন নাট্যকর্মী রোকসানা রুমা।
তিনি বললেন, ‘শিল্পকলায় সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড করতে আগের মাসে আবেদন করতে হয়। শুনেছি, বন্ধের আগে এ রকম কয়েকটি আবেদন করা আছে। এখন অবশ্য দলগুলো তৈরি কি না, সেটাও বিষয়। আমাদেরই যেমন ২৩ আগস্ট প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে বড় আয়োজন ছিল। কিন্তু এ রকম অস্থির অবস্থায় আনুষ্ঠানিকতা কমিয়ে এনেছি। নাটক উদ্যাপনে যাচ্ছি না। এখনো চারদিকে একটা শোকের আবহ। এটাও ঠিক, মানসিক ট্রমা কাটানোর জন্য হলেও আমাদের মঞ্চে ফেরা উচিত, মঞ্চের আলো জ্বালানো উচিত। সবকিছু স্বস্তিকর হয়ে আসছে, কাজেই শিল্পকলা একাডেমি থেকে সেনাবাহিনীর ক্যাম্প উঠে গেলে আমরা সংস্কৃতিচর্চা শুরু করতে পারব। অফিস, স্কুল, কলেজ, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান—সবই তো চলছে।’
নাট্যকর্মী বাকার বকুল জানালেন, তাঁরা শিল্পকলার সামনে মানববন্ধন করেছেন। এখনই খুলে দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন, দিয়েছেন কিছু প্রস্তাবনাও। তাঁর মতে, গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন, পথনাটক পরিষদ, শিল্পকলা একাডেমি—পুরো কাঠামো সরকারের মতো স্বৈরাচারী ছিল। সরকারের স্বার্থসিদ্ধি ছাড়া তারা কিছুই করেনি বলে উল্লেখ করেছেন। বাকার বকুল বললেন, ‘জানি না, শিল্পকলার নেতৃত্বে কারা আসবেন? আমলা, নাকি নেতা আসবেন। আমরা অবশ্য তার আগে কিছু দাবিদাওয়া জানিয়েছি, যেন যারা থিয়েটারে ছিল, তারা সঠিকভাবে সংস্কৃতি চর্চা করতে পারে। আমরা শো করতে চাই, তাই যত তাড়াতাড়ি খুলে দেওয়া হোক। এক সপ্তাহের মধ্যে খুলে দিলে ভালো। আমরা ওখানে চা খেতে চাই, আড্ডা দিতে চাই, বসতে চাই। আমাদের অনেকের সঙ্গে দেখাও হচ্ছে না।’
মহিলা সমিতির ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা গাজী ইব্রাহিম ফিরোজ বলেন, ‘আমরা নাটক প্রদর্শনীর জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত। ঢাকার বিভিন্ন নাট্যদলকে আহ্বান জানিয়েছি নাটক মঞ্চায়নের জন্য। ধীরে ধীরে সাড়া মিলছে। এরই মধ্যে একাধিক দল প্রদর্শনীর জন্য মৌখিকভাবে বুকিং চূড়ান্ত করেছে। এর মধ্যে দেশ নাট্যদল ২৯ আগস্ট নাটক প্রদর্শনীর জন্য অনুমতি নিয়েছে। এ ছাড়া বটতলা তাদের ১৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ৩০ আগস্ট ‘বন্যথেরিয়াম’ নাটক মঞ্চায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। আমরা চাই, দলগুলো এগিয়ে আসুক নাটক প্রদর্শনীর জন্য।’
যোগাযোগ করা হলে শিল্পকলা একাডেমির সচিব সালাহউদ্দিন আহাম্মদ গতকাল সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে জানান, তাঁরা নতুন মহাপরিচালক নিয়োগের অপেক্ষায় আছেন। নতুন মহাপরিচালক নিয়োগ পেলেই নিয়মিত কার্যক্রম শুরু হবে বলে তিনি আশা করছেন।