চঞ্চল চৌধুরী আমাদের ভাই
হঠাৎ করেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকের প্রোফাইল পিকচার বদলে গেছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে চঞ্চল চৌধুরী ও তাঁর মায়ের ছবি। ছবিটি বাংলাদেশের জনপ্রিয় অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী সোমবার মা দিবসে প্রকাশ করেন।
ওই পোস্টের কমেন্ট বক্সে কিছু ফেসবুক ব্যবহারকারী সাম্প্রদায়িক মন্তব্য করে। পরে চঞ্চল চৌধুরী সেসব মন্তব্য দেখে ক্ষুব্ধ হয়ে লেখেন, ‘ভাই ও বোনেরা, আমি কোন ধর্মের, তাতে কী আসে যায়? সবারই সবচেয়ে বড় পরিচয়, সে “মানুষ”। ধর্ম নিয়ে সব রুচিহীন প্রশ্ন ও বিব্রতকর আলোচনা বন্ধ হোক। আসুন সবাই মানুষ হই।’ এরপর থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তারকা ও সাধারণ মানুষ চঞ্চল চৌধুরীর পক্ষে সোচ্চার হন। তাঁরা প্রোফাইল পিকচার বদলিয়ে হ্যাশট্যাগে লেখেন ‘চঞ্চল চৌধুরী ইজ আওয়ার ব্রাদার’, ‘তোমার মা আমার মা’, ‘আমার মা, তোমার মা’, ‘স্টপ সাইবার বুলিং’, ‘হোক প্রতিবাদ’। ফেসবুকের হ্যাশট্যাগে কাল থেকে চলছে এই কথাগুলো।
চঞ্চলের পক্ষে পোস্ট দিয়েছেন নাসির উদ্দীন ইউসুফ, মাসুদ হাসান উজ্জ্বল, বন্যা মির্জা, বাপ্পী চৌধুরী, রেদওয়ান রনি, অপূর্ব, মোনালিসা, শাহনাজ খুশি, সাব্বির মাহমুদ, আসিফ আকবর, মাসুম রেজা, মম, চয়নিকা চৌধুরী, নওশাবা, মিজানুর রহমান আরিয়ান, মিথিলা, আবু হেনা রনি, অরণ্য আনোয়ার, ভাবনা, রওনক হাসান, তানভির তারেক, কোনাল, সোহেল রানা, শবনম ফারিয়া, মাজনুন মিজান, মৌসুমী হামিদ, রুনা খান, শিহাব শাহীন, সাগর জাহানসহ ইন্ডাস্ট্রির অসংখ্য মানুষ। আর ইন্ডাস্ট্রির বাইরে সাধারণ মানুষ তো আছেনই!
নাসির উদ্দীন দুঃসময়ে একজন বড় ভাইয়ের মতোই আগলে ধরেছেন চঞ্চল চৌধুরীকে। ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘স্নেহের চঞ্চল চৌধুরী, কতিপয় আকাট মূর্খের সাম্প্রদায়িক উক্তিতে মন খারাপ করো না। আমরা তোমাকে ভালোবাসি।’
বন্যা মির্জা জানিয়েছেন, তিনি লজ্জিত আর বিব্রতবোধ করছেন। লিখেছেন, ‘আমি জানি না কী বলতে হয়! কেবল সহকর্মীর জন্য এইটুকু বলতে পারি যে আমরা জানি তোমরা মানুষ হিসেবে কত অসাধারণ। আমরা সবাই জানি, ঘৃণা ছড়ানো তো সব থেকে সহজ, তোমাদের মতো ভালোবাসতে পারে কজন মানুষ! সকল বিদ্বেষ বাদ দিয়ে তোমরাই পারো এত শান্তভাবে থাকতে। চঞ্চল, ভাবনা বা আমাদের সকলের এমন অভিজ্ঞতা হয়। কিন্তু আমরা কি কেউ একটুও কথা বলতে পারি না। সাইবারে এই ঘৃণা কি কেবল আমাদের জন্য? তবে অবশ্যই যে মানুষগুলো একটু হলেও এই নিয়ে কথা বলেছেন, অনেকেই যাঁদের আমরা চিনি না তাঁরা এর এই ঘৃণার বিপরীতে কথা বলেছেন, তাঁদের ধন্যবাদ। আমি লজ্জিত, আমি বিব্রত।’
মাসুদ হাসান উজ্জ্বল লিখেছেন, ‘কেবল সাম্প্রদায়িকতা নয়, মানুষের পরশ্রীকাতরতা এখন রীতিমতো মানসিক বিকারের পর্যায় পৌঁছেছে। নিজের স্বজাতিকে নানা কারণে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে মানুষ আনন্দ পায়। সর্ববিষয়ে ট্রল করার প্রবণতা উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে।’ কেন বেড়েছে সেই কারণও জানিয়েছেন তিনি। লিখেছেন, ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে সর্বস্তরের মানুষই কিন্তু এখন পারফর্মার। আপনি নিজেও একজন পারফর্মার। আপনার থেকে মেধা, মনন এবং যোগ্যতায় এগিয়ে থাকা পারফর্মারকে আপনি সহ্য করতে পারেন না। আপনি এমন কাউকে সামনে রাখতে চান যে আপনার তুলনায় খুবই নিচু যোগ্যতার। যে সামনে থাকলে নিজেকে সুপিরিয়র ভাবতে আপনার সুবিধা হয়।’
এই সংকট থেকে উত্তরণের পথও দেখিয়েছেন ‘ঊনপঞ্চাশ বাতাস’খ্যাত এই নির্মাতা। লিখেছেন, ‘সমাধান একটাই, আরেকটি রেনেসাঁ। অ্যাপ্রিসিয়েশন না থাকলেও নিজের ভালো কাজগুলোকে জারি রাখতে হবে। ১৫ শতকের অন্ধকার যুগে দ্য ভিঞ্চি বা মাইকেল অ্যাঞ্জেলোরা যদি কাজ না করে অ্যাপ্রিসিয়েশনের আশায় বসে থাকতেন, পৃথিবীর শিল্পমাধ্যমের এই যুগান্তকারী উন্নয়ন সম্ভব হতো না।’ এই নির্মাতা তাঁর পোস্টটি শেষ করেছেন এভাবে, ‘মানতে হবে আমরা ইতিমধ্যেই ঘোর অন্ধকারে নিমজ্জিত। ক্রমেই সত্য-সুন্দরের সমস্ত পথ বন্ধ হয়ে আসছে। তবু অটল বিশ্বাসের আলোকবর্তিকা হাতে কাউকে না কাউকে দাঁড়িয়ে থাকতেই হবে।’
সব পোস্টের বার্তা একটাই। কাউকে আহত না করে ধর্ম, বর্ণ, দেশ, জাতি—সবকিছুর বেড়া ডিঙিয়ে সেখানে রয়েছে ‘মানুষ’ হওয়ার আহ্বান।