আমি বাবা, আমিই মা
২০১১ সালে দোয়েল যখন মারা যান, ছেলে অন্তরের বয়স তখন ১৪ বছর আর মেয়ে দীঘির ৮। এরপর ১০ বছর পেরিয়ে গেছে। আর বিয়ে করেননি সুব্রত। সিঙ্গেল ফাদারই রয়ে গেছেন। সুব্রত বলেন, ‘এই দীর্ঘ সময়ে ছেলে ও মেয়ে—কাউকে বুঝতে দিইনি, তাদের মা নেই। আমিই মা, আমিই বাবা।’ আজ ছেলে ও মেয়ে—দুজনই বড় হয়েছে। এখন নিজের মতো করে বুঝতে শিখেছে তারা।
দোয়েল মারা যাওয়ার সময় সবে কলেজে ঢুকেছে অন্তর। দীঘি একেবারেই ছোট। দোয়েল মারা যাওয়ার দিন হাসপাতালের পরিবেশের কথা স্মরণ করে সুব্রত জানালেন, দোয়েলের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাচ্ছিল দীঘি। মেয়ের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিলেন সুব্রত। ভাবলেন, দোয়েল তো চলেই গেল, মেয়ের কী হবে?
বাবা না থাকলেও মা-ই ছেলে-মেয়েদের বড় করে। বলেন, ‘মনে হলো, মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। ভাবলাম, অন্তর তো একটু বড়, খুব একটা সমস্যা হবে না। কিন্তু দীঘিকে নিয়ে কী করব, মেয়েকে কীভাবে বড় করব? মাকে ছাড়া ওরা কীভাবে থাকবে? ভেবে কোনো কূলকিনারা পাচ্ছিলাম না সেদিন।’
ছোট বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে ওই বয়সে বিয়ে করতে পারতেন সুব্রত, কিন্তু করেননি। জানালেন, দোয়েল মারা যাওয়ার সাত–আট দিনের মাথায় তাঁর পরিবার ও দীঘির খালাদের পরিবারে সুব্রতের বিয়ে নিয়ে কানাঘুষা শুরু হয়ে যায়। ওই সময়ই সুব্রত সিদ্ধান্ত নেন, বিয়ে করবেন না।
তাঁর ভাষ্য, ভাবলাম, স্ত্রী হিসেবে যিনি আসবেন, মা হিসেবে তিনি ছেলেমেয়েকে আদরযত্ন না–ও করতে পারেন। অঘটনও ঘটতে পারে। এসব ভেবে ঝুঁকি নিতে চাইনি। সন্তানদের মুখের দিকে তাকিয়ে আর বিয়ে করিনি।’
শুরু হলো নতুন সংগ্রাম। দোয়েলের অসুস্থতা ও মৃত্যুর কারণে প্রায় ৯ মাস দীঘির স্কুলে যাওয়া বন্ধ ছিল। মা মারা যাওয়ার পর বেশ কিছুদিন খালা ও মামাদের কাছে ছিল দীঘি। একসময় মেয়েকে কাছে নিয়ে এলেন সুব্রত। নতুন করে আবার স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন। শুরু হলো মায়ের দায়িত্ব পালন। প্রতিদিন সকালে মেয়েকে গোসল করিয়ে ড্রেস পরিয়ে স্কুলে নিয়ে যেতেন। বলেন, ‘স্কুলে কোনো কোনো সময় দীঘির দিকে তাকানো যেত না। তাঁর সব বন্ধুর মায়েরা তাদের স্কুলে আনা–নেওয়া করত। সেসব দেখে মাঝেমধ্যে দীঘির মধ্যে প্রতিক্রিয়া হতো, আমি বুঝতে পারতাম। তার চোখে পানি ছলছল করত। আমার হাতটা তখন শক্ত করে ধরে থাকত। সেসব দৃশ্য বলে বোঝানো যাবে না। আমি কান্না লুকানোর চেষ্টা করেছি কতবার!’
স্কুল পেরিয়ে যখন কলেজে গেল দীঘি, তখনো মেয়ের সঙ্গ ছাড়েননি বাবা সুব্রত। মেয়েকে সুন্দর একটা জীবন দেওয়ার জন্য ছায়ার মতো পিছে পিছে থেকেছেন। প্রথম ছয় মাস মেয়েকে হাত ধরে নিয়ে কলেজে পৌঁছে দিতেন। এরপর রিকশা ঠিক করে দিলে একা একা কলেজে যেত দীঘি।
সুব্রত বলেন, ‘এখনো দীঘি মাঝে মাঝে বলে, বাবা, চলো না কলেজে পৌঁছে দেবে।’ আমিও তার কথা ফেলতে পারি না। সব কাজ ফেলে কলেজে দিয়ে আসি। কোনো কোনো দিন দীঘি ও দীঘির বন্ধুদের সঙ্গে কলেজে আইসক্রিম খাই, ফুচকা খাই। আমাকে কাছে পেয়ে ওরা খুব আনন্দ করে।’ এরই মধ্যে ছোট্ট সেই দীঘি চলচ্চিত্রের নায়িকা হয়ে গেছে। ঢাকার চলচ্চিত্রে শুটিং বা সিনেমার মিটিংয়ে নায়িকাদের পাশে সাধারণত মাকেই দেখা যায়। দীঘির বেলায় ব্যতিক্রম, শুরুর দিকে দীঘির চলচ্চিত্রের মিটিং ও শুটিংয়ে বাবাই সঙ্গ দিয়েছেন। তবে সুব্রত মনে করেন, মেয়ে এখন বড় হয়েছে, তার ভালোমন্দ সিদ্ধান্ত তাকেই নিতে হবে।
তিনি বলেন, ‘ইদানীং কেউ তার শিডিউলের জন্য আমাকে ফোন দিলে আমি দীঘির নম্বরটা দিয়ে দিই তাঁকে। সরাসরি দীঘির সঙ্গে কথা বলতে বলি। কারণ, দীঘি বড় হয়েছে। তাকেই এখন সব বুঝে নিতে হবে।’