হলে ফিরছে দর্শক, আশা জাগাচ্ছে সিনেমা
ঈদের ছুটি শেষ হলেও এখনো ছুটির আমেজ কাটিয়ে উঠতে পারেনি ঢাকা। বৃহস্পতিবারের মতো ব্যস্ত দিনেও গতকাল রাজধানীর বেশির ভাগ প্রধান সড়ক ছিল ফাঁকা। চিরচেনা যানজট, পথঘাটে মানুষের উপচে পড়া ভিড় নেই। তবে রাজধানীর পান্থপথের স্টার সিনেপ্লেক্সের সামনে হাজির হতেই বদলে গেল দৃশ্যপট। রাস্তায় ভিড় না থাকলেও হলের সামনে মানুষের অভাব নেই। কেউ এসেছেন সিনেমা দেখতে, কেউ আবার অগ্রিম টিকিট কাটতে। বেশির ভাগই এসেছেন পরিবার বা বন্ধুবান্ধবসহ। করোনার প্রভাব কাটিয়ে গত ঈদুল ফিতরে প্রথম সিনেমাগুলোতে হলমুখী দর্শকের ভিড় দেখা যায়। তবে সিনেমাগুলো পরের সপ্তাহগুলোতে প্রেক্ষাগৃহের সংখ্যা সেভাবে বাড়াতে পারেনি। সেই জায়গায় আশা জাগিয়েছে এবারের ঈদের সিনেমা। বোঝা যায়, ঢালিউড সিনেমা নিয়ে সাধারণ দর্শকদের আগ্রহ বাড়ছে। দর্শক চাহিদার কথা মাথায় রেখে বাড়ছে সিনেমার প্রদর্শনীর সংখ্যা; যা আশা দেখাচ্ছে মুক্তির অপেক্ষায় থাকা সিনেমাগুলোর অভিনয়শিল্পী ও নির্মাতাদের। চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট অনেকের মতে, সিনেমা মুক্তির এই ধারাবাহিকতা চলতে থাকলে বছরজুড়েই হলে দর্শকদের ভিড় থাকবে।
হলে ভিড়, ফেসবুকে পোস্ট
এবারের ঈদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অন্যতম আলোচিত বিষয় ‘ঢালিউড সিনেমা’। ফেসবুকে ঢুঁ মারলেই দেখা যাচ্ছে ঈদের ছবি নিয়ে সাধারণ দর্শকের নানা ধরনের রিভিউ।
এই যেমন ধরা যাক নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রাফিয়ার কথাই। ফেসবুকে বাংলা চলচ্চিত্র গ্রুপে তিনি লিখেছেন, ‘বাংলা সিনেমা অনেক দিন দেখিনি। এবার ঈদে পরিবার নিয়ে গিয়েছিলাম ছবি দেখতে। পরাণ আমাদের মন জয় করে নিয়েছে। এত সুন্দর গল্প, অভিনয়, দর্শকদের উচ্ছ্বাস, ভিড় বেশ ভালোই লেগেছে।’ মেহেদি হাসান নামের একজন লিখেছেন, ‘ঢাকার সব কটি সিনেপ্লেক্সেই প্রচুর দর্শকের চাপ দিন: দ্য ডে দেখার জন্য। অবশেষে বসুন্ধরা সিনেপ্লেক্সে সিনেমাটি দেখলাম, উপচে পরা ভিড়। আমার ভালোই লেগেছে। প্রেম, ভালোবাসার গল্প থেকে বের হয়ে নতুন কিছু করার চেষ্টা করেছে অ্যাট লিস্ট।’
ঈদে ১৩৪টি সিনেমা হলে মুক্তি পায় তিন ছবি—দিন: দ্য ডে, পরাণ ও সাইকো। সিনেমাগুলোতে অভিনয় করেছেন অনন্ত জলিল, বর্ষা, শরীফুল রাজ, বিদ্যা সিনহা মিম, ইয়াশ রোহান, জিয়াউর রোশান ও পূজা চেরি। প্রেক্ষাগৃহ–সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ঢাকার বাইরে জেলা পর্যায়ের প্রেক্ষাগৃহগুলোতে সিনেমা দেখতে ভিড় করছে মানুষ। তবে জেলা শহরের বাইরের হলগুলোতে ততটা চাপ নেই।
ঢাকায় দিন: দ্য ডে ও পরাণ সবচেয়ে বেশি দর্শক টানছে। দর্শক কম সাইকোর। দীর্ঘদিন পরে হল হাউসফুল, দর্শকেরা টিকিট পাচ্ছেন না—এসব ঢালিউডের জন্য আশাজাগানিয়া খবর বলে মনে করেন নির্মাতা সোহানুর রহমান সোহান, ‘তিনটি সিনেমাই আমি দেখেছি। দুটি ছবি দেখতে উপচে পড়া ভিড় ছিল। বলা যায় দর্শকই দর্শক বাড়াচ্ছে। এটা শুভ লক্ষণ। ভালো ছবি দিতে পারলে দর্শক আসবেই। তবে ভালো সিনেমা নির্মাণে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। দর্শক ফিরবে, এমন বাণিজ্যিক সিনেমা মুক্তি দিতে হবে।’
বাড়ছে প্রদর্শনী
প্রথম সপ্তাহ শেষ না হতেই বেড়েছে ঈদের সিনেমার প্রদর্শনীসংখ্যা। বিশেষ করে হলমালিকদের আগ্রহ দেখা গেছে পরাণ নিয়ে। ঈদের চতুর্থ দিন থেকেই বসুন্ধরা সিটির স্টার সিনেপ্লেক্স ছবিটির প্রদর্শনীসংখ্যা বাড়িয়েছে। বর্তমান সেখানে ১২টি করে শো হচ্ছে। যমুনা ফিউচার পার্কের ব্লকবাস্টার সিনেমাসে মাত্র একটি শো ছিল ছবিটির। এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে চারটিতে। লায়ন সিনেমাসে যোগ হয়েছে নতুন চারটি শো। সব মিলিয়ে এই সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি। ঢাকার পর এবার সারা দেশের জেলা শহরের হলের দিকে মনোযোগ দিচ্ছেন পরাণ পরিচালক রায়হান রাফি। তিনি বলেন, ‘ঈদের সিনেমা ভাঙা সপ্তাহে মুক্তি পেলে (শুক্রবার ছাড়া অন্যদিন) পরের সপ্তাহকে প্রথম সপ্তাহ ধরা হয়। চাহিদা থাকা সত্ত্বেও আগাম চুক্তি থাকায় হলসংখ্যা তেমন বাড়াতে পারছি না। পরাণ পরিবার নিয়ে দেখার মতো ছবি। সেটা মেনটেইন করেই মুক্তি দেব। এই ছবি দেখতে দর্শকদের যে জোয়ার, সেটা আমাদের আশাবাদী করছে। প্রথম সপ্তাহেই বিনিয়োগ ফেরত আসবে।’ মুক্তির আগে থেকেই ব্যক্তিগত আক্রমণের শিকার হয়েছেন উল্লেখ করে এই পরিচালক আরও বলেন, ‘শুরু থেকে আমরা পারসোনাল অ্যাটাকের শিকার হয়েছি। আমরা নোংরামি করতে চাই না। চাই দেশের সিনেমা নিয়ে দর্শকদের এই আগ্রহ ধরে রাখতে।’
আগ্রহ বাড়িয়েছে আলোচনা–সমালোচনা
ঈদে মুক্তি পাওয়া সিনেমা নিয়ে এখন দর্শক আগ্রহ দেখা গেলেও মুক্তির আগে ও পরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কাদা–ছোড়াছুড়িও কম হয়নি। তবে এতে হিতে বিপরীত হয়েছে। নানা বিতর্ক আদতে হলে দর্শকই বাড়িয়েছে। ফজলে এলাহী নামের একজন ফেসবুকে লিখেছেন, বর্ষার কান্না দেখেই তিনি ছবিটি দেখতে গিয়েছিলেন। গত বুধবার সন্ধ্যায় তিনি দিন: দ্য ডে দেখেছেন। ছবিটি ১০০ কোটি টাকার বেশি বাজেটে নির্মিত এমন দাবির পরেই মূলত আলোচনার সূত্রপাত। বাজেট নিয়ে অন্য সিনেমার নির্মাতা ও শিল্পীদের ব্যক্তিগত আক্রমণের শিকার হতে হয়েছে বলে জানান ঈদে মুক্তি পাওয়া এক সিনেমা পরিচালক। কেবল দিন: দ্য ডে নয়, ঈদের তিন সিনেমা নিয়েই কমবেশি আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রে ছিল। কখনো একটিকে ছাড়িয়ে আরেকটি ছবি হাউসফুল হওয়ার দাবি, ফেসবুক লাইভে তথাকথিত হুমকি, পাল্টাপাল্টি ফেসবুক স্ট্যাটাস—এসব ঘটনা প্রায় প্রতিদিনই সিনেমাগুলো নিয়ে নতুন নতুন খবর তৈরি করেছে। অনেকে মনে করেন, নেতিবাচক এসব ঘটনাও দর্শকদের আকৃষ্ট করে থাকতে পারে।
আয়নাবাজি সিনেমার মূল প্রচারণার দায়িত্বে ছিলেন গাউসুল আলম শাওন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সিনেমা প্রচারণা নিয়ে ঝগড়ার পক্ষে আমি নই। এটা কোনো কাজের কথা না। ভালো সিনেমা হলে সেটা নিয়ে কথা বলেও সাপোর্ট করা যায়। কাদা–ছুড়াছুড়ি অল্প সময়ের জন্য দর্শক আনবে। কিন্তু এর প্রভাব সিনেমার জন্য ভালো না। ভালো পরিকল্পনা করেই হলে দর্শক টানতে হবে।’
দর্শক ফিরছেন, হল বাড়বে কবে
ঈদের সিনেমা ঘিরে দর্শকদের নতুন করে উপস্থিতি আশা দেখাচ্ছে চলচ্চিত্র–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের। তবে অনেকে মনে করেন, বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের অন্যতম বড় সমস্যা হলসংকট। তাঁদের দাবি, ঢালিউড সিনেমা ঘিরে দর্শকের এই আগ্রহ থাকতে থাকতেই নতুন নতুন হল চালু করা হোক। বাণিজ্যিক সিনেমার বাজার তৈরি করা গেলেই ঢালিউডে সুদিন ফিরবে বলে মনে করেন চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সভাপতি ইলিয়াস কাঞ্চন। তিনি বলেন, ‘গত ঈদে মুক্তি পাওয়া গলুই ব্যবসায়িকভাবে সফল হয়েছে। তার মানে দর্শক সিনেমা দেখছেন। দুই ঈদের মাঝখানে মুক্তি পাওয়া সিনেমাগুলোও দর্শক পেয়েছে। এবার ঈদের সিনেমায় ব্যাপক সাড়া আমাদের আশাবাদী করেছে। ছবি দেখার এই অভ্যাসটা ধরে রাখতে হবে। এ জন্য নিয়মিত ভালো বাণিজ্যিক সিনেমাগুলো মুক্তি দিতে হবে। ভালো সিনেমা বানাতে হবে। না হলে দর্শক আবার হলবিমুখ হবেন। আমরা নানাভাবে চেষ্টা করছি হলসংখ্যা বাড়িয়ে, হলের পরিবেশ ঠিক করে, মাল্টিপ্লেক্স চালু করে দেশের মধ্যে সিনেমার বাজার সম্প্রসারিত করতে।’