অভিমান নিয়ে সোহান সেদিন বলেছিলেন, ‘তাদের বলে দিয়ো, আমি সালমান শাহ আর মৌসুমীকে কোনো টাকা দেই নাই’
উত্তরা রাজলক্ষ্মীর পেছনে ৪ নম্বর রোডের একটি বাসায় থাকতেন ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’খ্যাত পরিচালক সোহানুর রহমান সোহান। এক বছর ধরে বাসায় স্ত্রীর সঙ্গে সময় কাটত। সেই স্ত্রীর মৃত্যুর ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই প্রয়াত হলেন সোহানুর রহমান। আজ সন্ধ্যায় তিনি মারা গিয়েছেন। প্রায় এক মাস আগে এই নির্মাতার খোঁজখবর নিতে সর্বশেষ কথা হয়। সে সময় তিনি জানিয়েছিলেন, সিনেমার মানুষ আর সিনেমার সংস্পর্শেই বাকিটা সময় কাটিয়ে যাচ্ছিলেন ঢালিউড এই পরিচালক। কিছু বিষয় নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন সালমান শাহ ও মৌসুমীদের এই পরিচালক।
কথার শুরুতেই জানালেন, ‘শরীরটা ভালো নেই। তেমন একটা বের হই না। নিয়মিত ওষুধের ওপর টিকে আছি। প্রতিদিন অনেক অনেক ওষুধ খেতে হয়। এগুলো নিয়ে মানসিক অবস্থা ভালো থাকে না। জরুরি কিছু বলার থাকলে বলো।’
পরক্ষণেই এই পরিচালকের কাছে জানতে চাই, ‘সোহান ভাই একটি বিষয়টি নিয়ে প্রায়ই অনলাইনগুলোতে নানা আলোচনা হয়। অনেক গণমাধ্যম বলার চেষ্টা করে আপনার হাত ধরে সিনেমায় আসা “কেয়ামত থেকে কেয়ামত” সিনেমায় অভিনয় করে নায়ক সালমান শাহ ও মৌসুমী কোনো পারিশ্রমিক পায়নি।’
কথাটা শুনে কিছুটা নীরব সোহানুর রহমান। এরপর আস্তে আস্তে বলা শুরু করলেন, ‘আমি এই জন্যই এখন আর অনেকের ফোন ধরি না। কথা বলতে গিয়ে, শুনতে গিয়ে রাগ হয়ে যায়। এত বছর পরে এসব নিয়ে যে যা বলে বলুক। এসব নিয়ে এখন আর কিছু বলার নেই। যারা লেখে তাদের বলে দিয়ো, আমি সালমান আর মৌসুমীকে কোনো টাকা দেই নাই। এগুলো শুনলে অস্থির লাগে। কী সব বিষয় নিয়ে চর্চা হয়। তাদের সিনেমায় না নিলে তাদের আজ জন্ম হতো? তাদের কে চিনত? এই প্রশ্ন তারা করে না কেন? কোন ডিমান্ডে তাদের কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা পারিশ্রমিক দেব? ঝুঁকিটা কে নিয়েছে?’ কিছুটা রাগান্বিত হয়ে কথাগুলো বললেন এই পরিচালক।
কথা বলে কিছুক্ষণ চুপ রইলেন। বোঝা যাচ্ছিল তিনি কিছুটা অস্থির। পরে বলতে শুরু করলেন, ‘এই মুহূর্তে আমার শারীরিক অবস্থা তেমন ভালো না। কথা বলার মতো অবস্থায় নেই। আমার স্ত্রী অসুস্থ। এখানে চিকিৎসা করিয়ে কোনো লাভ হচ্ছে না। এর আগে ভুল চিকিৎসা হয়েছে। এখনো ভালো চিকিৎসা হচ্ছে কি না জানি না। তেমন উন্নতি বুঝতে পারছি না।’
চিকিৎসা নিয়ে তিনি দোটানায় ছিলেন। তারপরও জানান, চিকিৎসা করাতে দেশের বাইরে যাবেন। সেই প্রস্তুতি নিচ্ছেন। শারীরিক সমস্যা সম্পর্কে জানতে চাইলে সেদিন জানিয়েছিলেন, ‘আমার প্রেশার খুব বেশি আপ–ডাউন হয়। নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। নার্ভের সমস্যা। ডায়াবেটিস, হার্টের সমস্যা আরও অনেক সমস্যা। আমি এই যে কথা বলছি, এর ফাঁকেও ওষুধ খেতে হচ্ছে। আমাকে প্রায় প্রতিদিন ৫০টির বেশি ওষুধ খেতে হয়। নিয়মিত চেকআপে থাকতে হয়। কোনো কিছুই হচ্ছে না।’
অসুস্থ শরীর নিয়েও সিনেমার কথা ভাবতেন। একটু সময়–সুযোগ হলেই বাসায় চিত্রনাট্য নিয়ে বসে যেতেন। তাঁর সঙ্গে যোগ দেন চিত্রনাট্যকার ছটকু আহমেদ। সোহানুর রহমানের সঙ্গে সেই আলাপ আরও দীর্ঘ হচ্ছিল। তিনি বলেন, ‘দীর্ঘদিন কোনো কাজই করতে পারছি না। ছটকু ভাইয়ের সঙ্গে বসছি। কিছু কাজ এগিয়ে রাখছি। নিয়মিত আমাদের কথা হয়। ইচ্ছা আছে একদম নতুন মুখ নিয়ে আবার সিনেমার কাজ শুরু করব। দেখা যাক কী হয়।’
সর্বশেষ অনুদানের একটি সিনেমার শুটিং করার কথা ছিল। সেটা নিয়ে কথা হলো। চমকে দিয়ে তিনি বললেন, ‘অনুদানের ওই সিনেমাটি তো আমি আর বানাচ্ছি না। সিনেমাটি করব না সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমি সরকারকে অনুদানের টাকা ফেরত দিয়েছি। এটা আরও বেশ আগে। এর পর থেকেই নতুন সিনেমা নিয়ে ভাবছি। এখন চিকিৎসা করাতে দেশের বাইরে যাব। সুস্থ হলে হয়তো আবার কোনো সিনেমা বানানো হবে। কিন্তু মানসিকভাবে চিকিৎসা নিয়ে অনেক চিন্তায় রয়েছি।’
সর্বশেষ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচনে তিনি দায়িত্ব পালন করেন। এরপর তাঁর একটি সিনেমার শুটিং নিয়ে ব্যস্ত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ছয় মাস পার না হতেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরপর সবকিছু থেকেই নিজেকে গুটিয়ে নেন। এক বছর ধরে তিনি অনেকটা আড়ালেই ছিলেন। এ সময় কেটেছে চিকিৎসায়। এফডিসিতেও তেমন একটা আসেননি। তিনি বলেন, ‘মানসিক অবস্থা ভালো নেই। অসুস্থতার উন্নতির তেমন কোনো লক্ষণ দেখছি না। এসব নিয়ে মন খারাপ থাকে। এর মধ্যে কে কী বলল এসব শুনতে ভালো লাগে না। আজ সালমান শাহ, মৌসুমীর যে পরিচিতি, এগুলো কি আমি শুরুতে পেয়েছিলাম? তাঁরা ছিল নতুন মুখ। তাদের নায়ক–নায়িকা হিসেবে কী দামটা ছিল? তাদের ধরে এনে সিনেমা বানিয়েছি। তাদের তো সে সময়ে কত টাকা পারিশ্রমিক দিলাম, সেটা মাথায় ছিল না। তারা একটি সিনেমা করছে, এটাই ছিল তাদের কাছে বড় বিষয়। সেখানে কম হলেও আমরা তাদের পারিশ্রমিক দিয়েছি। এটা নিয়ে তারা তো কখনোই কিছু বলে নাই। অন্যরা যারা বলছে তারা বলুক।’
সোহানুর রহমান সোহান চার দশক ধরে ঢালিউড সিনেমার সঙ্গে জড়িত। ১৯৭৭ সালে তিনি নির্মাতা শিবলী সাদিকের সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ শুরু করেন। প্রধান নির্মাতা হিসেবে সোহানুর রহমান সোহান আত্মপ্রকাশ করেন ১৯৮৮ সালে। তাঁর পরিচালিত প্রথম সিনেমা ‘বিশ্বাস অবিশ্বাস’। তবে তিনি সাফল্য পান ১৯৯৩ সালে। সিনেমার নাম ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’। একে একে অনেক ব্যবসাসফল সিনেমা ঢালিউডে উপহার দিয়েছেন তিনি। সেই পরিচালক আজ উত্তরার বাসায় ঘুমের মধ্যে মারা যান। সোহানের বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর। ১৯৬০ সালের ১৫ অক্টোবর বগুড়ার ফুলবাড়ীতে জন্মগ্রহণ করে সোহান। বগুড়া এবং জয়পুরহাটে স্কুল ও কলেজজীবন শেষে ঢাকায় আসেন তিনি। ব্যক্তিজীবনে তাঁর তিন মেয়ে। বড় দুই মেয়ের বিয়ে হয়েছে। ছোট মেয়ে মালয়েশিয়া পড়াশোনা করেন। তাঁরা তিন বোনই মাকে দাফন করতে আজ সকালে নানাবাড়ি টাঙ্গাইলে গিয়েছেন। সেখান থেকেই বাবার মৃত্যুর খবর জেনেছেন।