‘অনন্ত ভালোবাসা’ থেকে ‘লিডার’, শাকিব খানের চব্বিশ বছর
প্রথম সিনেমা দিয়েই তারকা হতে পারেননি তিনি। পারেননি দ্বিতীয় ছবি দিয়েও। অভিনয় নিয়ে স্বপ্নপূরণে ছুটে চলেছেন। তিন নায়ক—দুই নায়ক আছেন ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে, এমন সিনেমাতেও অভিনয় করেছেন। নায়ক হওয়ার স্বপ্নে বিভোর একজনের পরিচালক ও গল্প বাছাইয়ের সুযোগ সে অর্থে ছিল না। তবে হাল ছাড়েননি। এভাবে চলতে চলতে একদিন তিনি হয়ে উঠেছেন গত দুই দশকে ঢাকাই ছবির অন্যতম বড় তারকা। তিনি শাকিব খান। আজ চলচ্চিত্রে অভিষেকের দুই যুগ পূর্ণ হচ্ছে তাঁর। ১৯৯৯ সালের ২৮ মে মুক্তি পেয়েছিল শাকিব খান অভিনীত প্রথম সিনেমা ‘অনন্ত ভালোবাসা’।
ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে সিনেমা পছন্দের ক্ষেত্রে তাঁর সব পছন্দ যে ঠিকঠাক ছিল না, সে কথা অভিনেতা নিজেও স্বীকার করেছেন।
দুই বছর আগে আজকের দিনেই চলচ্চিত্রে ২২ বছর পূর্তি উপলক্ষে ফেসবুকে তিনি লিখেছিলেন, ‘আমি যখন চলচ্চিত্র ক্যারিয়ার শুরু করি, তখন অপরিপক্ব থাকলেও দূরদর্শী ছিলাম। কোথায় যাচ্ছি বা কী করব, কিছুই জানতাম না। শুধু এইটুকু জানতাম, আমাকে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। আর কোনো সময় হাল ছেড়ে দেওয়া যাবে না। আজ যখন ফিরে তাকাই, তখন আমি সব মানুষ এবং অভিজ্ঞতার কাছে কৃতজ্ঞ।’
১৯৯৯ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত অনেকগুলো সিনেমা অভিনয় করেছেন শাকিব খান। এসব সিনেমায় তাঁর বিপরীতে দেখা গেছে পূর্ণিমা, মৌসুমী, পপি, শাবনূরসহ সেই সময়ের আলোচিত প্রায় অভিনয়শিল্পীদের সঙ্গে।
এই সময়ে তাঁর অভিনীত প্রায় সব সিনেমাই ছিল পুরোপুরি বাণিজ্যিক ঘরানার। ব্যতিক্রম বলতে ‘সুভা’। ২০০৫ সালে মুক্তি পায় চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত ছবিটি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্প অবলম্বনে নির্মিত ছবিটিতে শাকিবের বিপরীতে ছিলেন পূর্ণিমা। বাণিজ্যিক সিনেমার তারকা হিসেবে পরিচিত শাকিবের ইমেজে নতুন মাত্রা যোগ করে ছবিটি।
তবে ঢাকাই ছবির শীর্ষ নায়ক তিন হয়ে ওঠেন ২০০৬ থেকে ২০১০ সালে মধ্যে। এই সময়ে এসে প্রায় অবিশ্বাস্য শোনালেও ২০০৬ সালে শাকিব অভিনীত ১৩টি সিনেমা মুক্তি পায়। যেগুলোর বেশির ভাগই ছিল ব্যবসাসফল। ফল, ঢাকাই সিনেমার পরিচালক, প্রযোজকদের কাছে শাকিব হয়ে ওঠেন সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত তারকাদের একজন।
২০০৬ সালে মুক্তি পাওয়া সিনেমা ‘কোটি টাকার কাবিন’ সিনেমায় প্রথম দেখা যায় শাকিব খান ও অপু বিশ্বাস জুটিকে। তুমুল ব্যবসাসফল ছবিটির পর একের পর এক হিট ছবি উপহার দিয়েছে এই জুটি।
২০০৭ সালে শাকিবের দশটির বেশি সিনেমা মুক্তি পায়, বেশির ভাগই সুপারহিট। এর মধ্যে ছিল পিএ কাজলের ‘আমার প্রাণের স্বামী’ও। যে ছবির জন্য সমালোচক শাখায় শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র অভিনেতা বিভাগে প্রথম মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার পান শাকিব।
২০০৮ সালে ঢাকাই ছবির আরেক তারকা মান্নার মৃত্যুর পর যে শূন্যতা তৈরি হয়, শাকিব তা ভালোভাবেই পূরণ করে গেছেন। মান্নার মৃত্যুর পর যে ছবিটি দিয়ে শাকিবের ক্যারিয়ার অন্য উচ্চতায় চলে যায় সেটা হলো ‘প্রিয়া আমর প্রিয়া’।
২০০৮ সালে মুক্তি পাওয়া এ ছবিটি শাকিবকে ঢালিউডের মূল রাস্তায় তুলে দিয়েছিল। এরপর আর পেছনে তাকানোর দরকার পড়েনি। ২০০৮ সালের ১৩ জুন মুক্তির পর ছবিটি ব্লকবাস্টার হিট হয়ে যায়। আয়ের দিক থেকে সেই সময় বক্স অফিসের সব রেকর্ড ভেঙে ফেলে এই ছবি।
‘প্রিয়া আমার প্রিয়া’ মুক্তির পর শাকিব খানের পারিশ্রমিক বেড়ে ২০ গুণ হয়ে যায়। শুধু তা-ই নয়, এই ছবিতে শাকিব খানের বিপরীতে অভিনয় করে রাতারাতি তারকা বনে যান সাহারাও। পরে শাকিব-সাহারা জুটির ‘প্রেম কয়েদি’, ‘বলব কথা বাসর ঘরে’, ‘বস নাম্বার ওয়ান’, ‘টাইগার নাম্বার ওয়ান’, ‘তোমার জন্য মরতে পারি’, ‘খোদার পরে মা’সহ বেশ কয়েকটা ছবি দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছিল।
ছবিটি মুক্তির এক যুগ পূর্তি উপলক্ষে ২০২০ সালে প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ছবিটির পরিচালক বদিউল আলম খোকন প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘প্রিন্টের খরচ ছাড়া মাত্র ৫০ লাখ টাকা বাজেটের এই ছবি থেকে প্রায় ১৫ কোটি টাকা আয় করেছিলেন প্রযোজক।’
২০১১ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত শাকিব খান আগের মতোই একের পর এক হিট ছবি উপহার দিতে থাকেন। ২০১০ সালে মুক্তি পাওয়া ‘ভালোবাসলেই ঘর বাঁধা যায় না’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য ২০১২ সালে প্রথমবারের মতো জাতীয় চলচ্চিত্রে সেরা অভিনেতার পুরস্কার পান।
তবে এই সময়ে তাঁকে বেশ কয়েকটি অন্য ঘরানার সিনেমাও করতে দেখা যায়। এর মধ্যে একটি চাষী নজরুল ইসলামের ‘দেবদাস’, ছবিতে শাকিব করেন দেবদাসের চরিত্র, পর্দার পার্বতী হন অপু বিশ্বাস। এ ছাড় শাকিব খান অভিনয় করেন সাফি উদ্দিন সাফির ‘পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেম কাহিনী’—জয়া আহসানের বিপরীতে, ছবিতে ক্রিকেটারের চরিত্রে দেখা যায় শাকিবকে।
২০১৪ সালে নিজের প্রযোজনা সংস্থা এসকে ফিল্মস প্রতিষ্ঠা করেন শাকিব খান। নিজস্ব প্রযোজনা সংস্থার ব্যানারে নির্মিত প্রথম সিনেমা ‘হিরো: দ্য সুপারস্টার’ ঈদে মুক্তির পর ব্যাপক ব্যবসা সফল হয়।
২০১৬ সালে যৌথ প্রযোজনার সিনেমা ‘শিকারি’ দিয়ে যেন নবজন্ম হয় শাকিব খানের। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শাকিব খানের নতুন সাজপোশাক আলোচিত হয়। ওই বছর ঈদুল ফিতরে বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গে মুক্তি পায় ছবিটি। দর্শক নতুনত্বের স্বাদ পেয়ে হলমুখী হন সে বছর। প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি টাকা বাজেটের এই ছবি থেকে বিনিয়োগ উঠে আসে দ্রুত। ওই ঈদেই শাকিবের আরও দুটি ছবি মুক্তি পায় ‘মেন্টাল: দ্য রানা পাগলা’ ও ‘সম্রাট’।
কিন্তু ‘শিকারি’ এতই ব্যবসা করে যে এর সামনে ফিকে হয়ে যায় বাকি দুটি ছবি। ‘মেন্টাল’-এ শাকিবের নায়িকা হয়েছিলেন ছোট পর্দার জনপ্রিয় তারকা নুসরাত ইমরোজ তিশা। এ ছাড়া ২০১৯ সালে ‘সত্তা’য় পাওলি দামের বিপরীতে অভিনয় করেন শাকিব খান। ছবিটির জন্য চতুর্থবারের মতো জাতীয় পুরস্কার পান।
যৌথ প্রযোজনার ছবি সাফল্য পাওয়ায় পরপর আরও কয়েকটি সিনেমায় অভিনয় করেন শাকিব খান। কোনটি ব্যবসাসফল হয়, কোনটি ততটা সাফল্য পায়নি। তবে ছবিগুলোতে তাঁর লুক, অ্যাকশন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচিত হয়। পরে যৌথ প্রযোজনার সিনেমার নতুন নীতা মালাসহ নানা কারণে আবারও পুরোপুরি ঢাকাই সিনেমায় ফেরেন শাকিব খান।
ব্যক্তিগত জীবনের নানা বিতর্ক, কোভিড মহামারি, দেশের হলসংখ্যা কমাসহ নানা কারণে গত পাঁচ বছরে শাকিব খানের অভিনীত ছবির সংখ্যা কমে গেছে।
তবে তাঁর নতুন সিনেমা যখনই মুক্তি পেয়েছে দর্শক নিরাশ করেনি। গত বছরের ঈদুল ফিরতে শাকিব খান অভিনীত সিনেমা ‘গলুই’ দিয়ে কোভিডের পরে দর্শক হলে ফেরে। ব্যতিক্রম হয়নি চলতি বছরও। গত ঈদে মুক্তি পাওয়া তপু খানের ছবি ‘লিডার: আমিই বাংলাদেশ’ও ভালো ব্যবসা করে। শতাধিক হলে মুক্তি পাওয়া ছবিটি দেখতে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে ভিড় করেন দর্শকেরা। ছবির বিষয়বস্তু, গান আর শাকিব খানের পারফরম্যান্স মিলিয়ে আরও একটি জমজমাট সিনেমা উপহার দিয়েছেন তিনি। এই সাফল্যের রেশ ধরেই আজ ২৪ পূর্ণ করলেন শাকিব খান। এদিনে তিনি কক্সবাজারে নতুন ছবির শুটিংয়ে ব্যস্ত আছেন। ‘প্রিয়তমা’ নামের এই ছবির পরিচালক হিমেল আশরাফ, যা ঈদুল আজহায় মুক্তি পাবে।