‘পরাণ’-এর এক মাস: জয়রথ ছুটছেই
দেশের প্রেক্ষাগৃহে ‘পরাণ’–ঝড় যেন থামছেই না। প্রেক্ষাগৃহে মুক্তির এক মাস পার হচ্ছে, রেকর্ড গড়ে এখনো এগিয়ে চলেছে ছবিটি। পঞ্চম সপ্তাহে এসেও হাউসফুল, আগাম টিকিট বিক্রি অব্যাহত আছে ‘পরাণ’-এ।
গত মাসের ১০ জুলাই ঈদুল ফিতরের তিন ছবির মধ্যে সবচেয়ে কম ১১টি প্রেক্ষাগ্রহে মুক্তি পায় ছবিটি। কিন্তু মুক্তির পরপরই দর্শকের পছন্দের তালিকায় উঠে আসে এটি। দেশের নানা প্রান্তে আলোচনা ছড়িয়ে পড়ে ছবিটির। হল বাড়তে থাকে। চতুর্থ সপ্তাহে এসে হলসংখ্যা দাঁড়ায় ৬০-এ। মাল্টিপ্লেক্সসহ একক হলগুলোতেই হাউসফুলের পর হাউসফুল চলতে থাকে। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে একক হলগুলোতেও আগাম টিকিট বিক্রির রেকর্ড গড়তে থাকে ‘পরাণ’। এক মাস ধরে যে ধারা এখনো অব্যাহত আছে। ঢাকার বাইরে দীর্ঘদিন ধরে অনেকগুলো হল দর্শকের অভাবে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছিল, ‘পরাণ’-এ সে সব হল নতুন ‘প্রাণ’ পেয়েছে।
‘পরাণ’ ছবির অভাবনীয় সাফল্যে হলমালিক থেকে শুরু করে চলচ্চিত্র–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মুখে হাসি ফুটেছে। তাঁরা বলছেন, শুরুতে ‘পরাণ’-এর ঝড়ে মন্দা চলচ্চিত্রের চাকা ঘুরিয়ে দিয়েছে। পরপর ‘হাওয়া’ এসে আরও চাঙা করেছে।
স্টার সিনেপ্লেক্সের পাঁচটা শাখায় চতুর্থ সপ্তাহ পর্যন্ত দিনে সর্বোচ্চ ২২টি করে শো প্রদর্শিত হয়েছে ‘পরাণ’। এক মাসের মাথায় এখনো ১৪টি করে শো চলছে ছবিটির। সব কটি শো হাউসফুল। সিনেপ্লেক্সে টানা এক মাস ‘পরাণ’ ছবির এ ধরনের সাফল্য প্রসঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘পরিবার, এমনকি বয়স্ক ব্যক্তিরাও এই ছবিটি দেখতে আসছেন। বিশেষ করে নারী দর্শকের চাপ বেশি দেখছি আমরা। সিনেমাটি ঘিরে দর্শকের এত উৎফুল্ল, আনন্দঘন পরিবেশ আগে দেখিনি আমি।’ এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘এখনো ১৪টি করে শো চলছে। টিকিট পাচ্ছেন না দর্শক। আগামী বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ‘পরাণ-এর সব টিকিট আগাম বিক্রি হয়ে গেছে।’
ঢাকার বাইরে ময়মনসিংহের পূরবী সিনেমা হলে টানা এক মাস চলছে ‘পরাণ’। প্রায় সাড়ে আট শো সিটের এই হলটিতে এক মাসের মাথায় এখনো দিনের চারটি শোর মধ্যে দুটি করে শো হাউসফুল যাচ্ছে। দারুণ খুশি হলের ব্যবস্থাপক দেলোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, ‘শুরুর দিকে টানা ১০–১২ দিন সব কটি শো হাউসফুল ছিল। এখনো প্রতিদিনই কিছু শো হাউসফুল যাচ্ছে। সেই ‘শিকারি’ ও ‘নবাব’ ছবির সময় আমার এমন সেল দিতে পেরেছিলাম।’
এই ব্যবস্থাপকের কথা, ‘নারী দর্শকই বেশি। ছোট ছোট বাচ্চা কোলে করে পরিবারসহ ছবি দেখতে আসছেন নারীরা। বিগত দিনের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, আমার কাছে মনে হচ্ছে আগামী আরও পাঁচ–ছয় সপ্তাহ ছবিটিতে দর্শক আগ্রহ অব্যাহত থাকবে।’
এদিকে খুলনার ৫০০ সিটের শঙ্খ সিনেমা হলের চিত্র একই। এক মাস পরেও হলটিতে আগাম টিকিট বিক্রি ও হাউসফুল অব্যাহত আছে। যা হলটির জন্য রেকর্ড।
হলটির পরিচালক কামাল হোসেন জানালেন বহু বছর আগে তাঁরা এই হলে সালমান শাহর ‘সত্যের মৃত্যুর নেই’ ছবিতে এমন দর্শক পেয়েছিলেন। বলেন, ‘জীবনেও যাঁরা হলে বাংলা সিনেমা দেখতে আসেননি, তাঁরাও হলে আসছেন। বিশেষ করে নারীরা তাঁদের বাচ্চাদের সঙ্গে করে সিনেমাটি দেখাতে নিয়ে আসছেন। নারী দর্শক প্রচুর। এক মাস পেরিয়ে যাচ্ছে এখনো চার শোর মধ্যে তিনটি শো প্রায় হাউসফুল যাচ্ছে।’
এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘শঙ্খ হলের জন্য নতুন রেকর্ড, এখানে আগাম টিকিট বিক্রির জন্য আলাদা বুথ খোলা হয়েছে। আগে শুনতাম শুধু মাল্টিপ্লেক্সেই আগাম টিকিট বিক্রি হয়। যেটি প্রথম আমাদের এই হলে হচ্ছে। পাঁচ দিন আগেরও আগাম টিকিট বিক্রি করেছি।’
রংপুরের শাপলা সিনেমা হলেরও পরিচালনার দায়িত্বে আছেন কামাল হোসেন। দুই সপ্তাহ ‘পরাণ’ চালানোর পর এখন ‘হাওয়া’ চলছে সেখানে। বলেন, ‘“হাওয়া” ছবিটিও ভালো যাচ্ছে, তবে আগামী সপ্তাহ থেকে আবারও “পরাণ” ছবিটি চালাব। “পরাণ” ছবিটি দেখার জন্য এখনো দর্শকের চাপ আছে শাপলাতে।’
এদিকে দর্শক উন্মাদনা নিয়ে কোনো সিনেমা এক মাস অতিবাহিত হওয়ার ঘটনা ঢাকার চলচ্চিত্রে অনেক বছর দেখেননি দর্শক।
‘পরাণ’–এর এই সাফল্য নিয়ে ছবির পরিচালক রায়হান রাফির বলেন, ‘আমার এতটা প্রত্যাশা ছিল না। মানুষ যে ভাবে ছবিটি গ্রহণ করেছেন সিনেমাটি, আমি কৃতজ্ঞ দর্শকের কাছে। কারণ, দর্শকই সিনেমার প্রাণ। অনেকে আমাকে বলেছেন, তাঁরা আগে কখনো বাংলা সিনেমা দেখতে হলে যাননি। “পরাণ” দেখতে গিয়েছেন। “মনপুরা” বা “নবাব”-এর পর ‘পরাণ’ দিয়ে রেকর্ড গড়তে পেরেছি। ‘পরাণ’ ভবিষ্যতে আরও ভালো ভালো ছবি তৈরিতে উৎসাহিত করবে আমাকে। আমি নিজেও হলে গিয়ে দেখছি, নারী দর্শক বেশি।’
ওয়েব ফিল্ম তৈরি করলেও ‘পরাণ’ প্রথম বাণিজ্যিক ঘরানার ছবি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান লাইভ টেকনোলজিসের। প্রেক্ষাগৃহে টানা এক মাস সফলভাবে প্রদর্শিত হওয়া প্রসঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক ইয়াসির আরাফাত বলেন, ‘দর্শকদের আমরা একটা ভালো সিনেমা উপহার দিতে পেরেছি। এই ছবি দিয়ে দর্শক হলে ফিরেছেন। নতুন নতুন দর্শক আসছেন। এটি আমাদের জন্য অত্যন্ত ভালো লাগার ব্যাপার। “পরাণ” আমাদের সিনেমায় নিয়মিত বিনিয়োগে উৎসাহিত করছে।’ এই প্রযোজক আরও বলেন, ‘“পরাণ” থেকে যে আয় হবে, আমরা একটা টাকাও ঘরে নেব না। পুরো টাকাই নতুন সিনেমায় বিনিয়োগ করব।’
‘পরাণ’কে ঘিরে আগে থেকেই ঢাকা ও ঢাকার বাইরের প্রেক্ষাগৃহে বেশি নারী দর্শকের চাপের খবর পাওয়া যাচ্ছিল। রোববার রাতের শোতে বসুন্ধরা সিনেপ্লেক্সে গিয়ে তেমন চিত্রই দেখা গেল। হাউসফুল শোর প্রায় অর্ধেকের বেশি নারী।ওই দিন ঢাকার খিলগাঁও থেকে পরিবারের সাতজন সদস্য নিয়ে ছবিটি দেখতে এসেছিলেন সাহেরা বেগম। প্রায় তিন বছর পর তিনি সিনেমা হলে এসেছিলেন। বলেন, ‘শুনছি ছবিটা নাকি ভালো। অনলাইন, টেলিভিশনে খবর শুনে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ছবিটি দেখতে এসেছি।’‘পরাণ’ ছবিতে অভিনয় করেছেন শরীফুল রাজ, বিদ্যা সিনহা মিম, ইয়াস রোহান, নাসির উদ্দীন খান প্রমুখ।