আপিল কমিটির কাঁধে বাংলাদেশের আত্মমর্যাদার ভার: মোস্তফা সরয়ার ফারুকী
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডে আটকে আছে মোস্তফা সরয়ার ফারুকী পরিচালিত ‘শনিবার বিকেল’ ছবিটি। ছবিটি মুক্তির দাবিতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তুমুল আলোচনা চলছে। এর মধ্যেই ২১ জানুয়ারি সিনেমাটি নিয়ে সেন্সর বোর্ডের আপিল কমিটির শুনানির দিন ঠিক করেছে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়। এ ছবির মুক্তির সনদপ্রাপ্তি নিয়ে কী ভাবছেন পরিচালক—রোববার রাতে তাঁর বনানীর বাসায় বসে তা জানার চেষ্টা করে প্রথম আলো
প্রশ্ন :
অনেক দিনের অপেক্ষা। ২১ জানুয়ারি আপিল কমিটির সভা। এবার কি আশার আলো দেখছেন?
আমি শুধু একটা জিনিসই দেখছি এবং বিশ্বাস করছি। ফেব্রুয়ারির ৩ তারিখে ভারতে ‘ফারাজ’ ছবিটি মুক্তি পাবে। একই ঘটনার অনুপ্রেরণায় কত আগে ‘শনিবার বিকেল’ তৈরি হয়েছে। ‘শনিবার বিকেল’ তো তার আগেই মুক্তি পাওয়া উচিত। কীভাবে সেটা মুক্তি পাবে, কী হবে, আমি জানি না। তবে আমি বিশ্বাস করছি। আমার এই বিশ্বাসের পেছনে অনেক কারণ আছে।
প্রশ্ন :
কী কারণ?
প্রথম কারণ, ‘শনিবার বিকেল’ ছবিটি বানিয়ে আমরা কোনো অন্যায় করিনি। দ্বিতীয়ত, আমি বিশ্বাস করতে চাই, সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে মধ্যে যাঁরা সংবেদনশীল মানুষ, তাঁরা নিশ্চয়ই খতিয়ে দেখবেন, এ ছবি আটকে দিয়ে কে বা কারা আমাদের দেশকে হেয় করার চেষ্টা করছেন। নিউইয়র্ক টাইমসে এ বিষয় নিয়ে পুরো পাতায় রিপোর্ট হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, ‘শনিবার বিকেল’ ছবিটি দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করল, নাকি ‘শনিবার বিকেল’ আটকে দিয়ে বহির্বিশ্বে আমাদের ছোট করা হলো?
প্রশ্ন :
ছবি ছাড়পত্রের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট মন্ত্রণালয় থাকা সত্ত্বেও ঊর্ধ্বতন মহলকে টানার প্রয়োজন হলো কেন?
এ প্রশ্নের উত্তরে কবি কি একটু নীরব থাকতে পারে?
যে ছবি দেখে সেন্সর বোর্ড সদস্যরা দ্রুত সার্টিফিকেট দেওয়ার কথা বললেন, সেই ছবি কেন ১৫ তারিখে দ্বিতীয়বার দেখে সার্টিফিকেট দিতে অস্বীকৃতি জানানো হলো? কে তাঁদের বাধ্য করল?
প্রশ্ন :
ছবিটি এভাবে আটকে রাখার পেছনে কী কারণ থাকতে পারে বলে আপনার ধারণা?
বিভিন্ন দেশের উৎসবে ‘শনিবার বিকেল’ দেখানো হয়েছে। বিদেশিরা দেখেছেন, বাংলাদেশিরাও। কানাডার টরন্টোতে ছবিটি দেখে অনেক প্রবাসী বাঙালি তা নিয়ে পত্রিকায় ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছেন। তাঁরা ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়ার মতো কিছু তো পানইনি; বরং বলেছেন, ছবিটি বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে। একই কথা হলিউড রিপোর্টার পত্রিকা তাদের রিভিউতেও বলেছে। আমি শুধু এইটুকুই বলতে পারি, ‘শনিবার বিকেল’ আটকানোর প্রক্রিয়ায় বহু নিয়মবহির্ভূত ঘটনা ঘটেছে।
প্রশ্ন :
কী রকম?
প্রথমে আমরা যখন ছবিটি শুট করতে যাই, আমরা তথ্য মন্ত্রণালয়ে চিত্রনাট্য জমা দিয়ে বিদেশি শিল্পী ও কলাকুশলী আনার জন্য আবেদন করি। তখন তথ্যমন্ত্রী ছিলেন হাসানুল হক ইনু। তথ্য মন্ত্রণালয় ছাড়াও সরকারের বিভিন্ন দপ্তর সেই স্ক্রিপ্ট পড়ে আমাদের অনুমোদন দেয়। শুধু অনুমোদনই নয়, ওই সব দপ্তরে দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা আমাদের ফোন করে উৎসাহও দেন। সেই চিত্রনাট্য থেকেই ছবিটি বানিয়ে আমরা সেন্সর বোর্ডে জমা দিলাম। সেটার প্রথম প্রদর্শনী হলো ২০১৯ সালের ৯ জানুয়ারি। সেন্সর বোর্ড সদস্যরা ছবিটি দেখে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে ইন্টারভিউ দিয়ে বললেন, ছবিটি ভালো হয়েছে। বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছবি, দ্রুত সার্টিফিকেট দেওয়া হবে। তারপর যেটা ঘটল, সেটা অভাবনীয়! ১০ জানুয়ারি বাংলাদেশের অনলাইনে একযোগে কিছু ধর্মীয় রাজনীতি করা মানুষের লিংকে দাবি করা হলো ‘শনিবার বিকেল’ নিষিদ্ধ করতে হবে। যাঁরা এটা করলেন, তাঁরা তো কেউই সিনেমাটা দেখেননি। আমি দাবি জানাই, গোয়েন্দারা খুঁজে বের করুক, ছবি মুক্তি পাওয়ার আগেই কে বা কারা এর পেছনে ছিল। তাহলেই পরিষ্কার হয়ে যাবে কে বা কারা পরবর্তী সময়ে এই ছবি নিয়ে নিয়মবহির্ভূত কাজ করেছে।
ফেব্রুয়ারির ৩ তারিখে ভারতে ‘ফারাজ’ ছবিটি মুক্তি পাবে। একই ঘটনার অনুপ্রেরণায় কত আগে ‘শনিবার বিকেল’ তৈরি হয়েছে। ‘শনিবার বিকেল’ তো তার আগেই মুক্তি পাওয়া উচিত। কীভাবে সেটা মুক্তি পাবে, কী হবে, আমি জানি না।
প্রশ্ন :
নিয়মের বাইরে কী কী ঘটল?
যে ছবি দেখে সেন্সর বোর্ড সদস্যরা দ্রুত সার্টিফিকেট দেওয়ার কথা বললেন, সেই ছবি কেন ১৫ তারিখে দ্বিতীয়বার দেখে সার্টিফিকেট দিতে অস্বীকৃতি জানানো হলো? কে তাঁদের বাধ্য করল? আমরা আপিল করলাম। আপিল কমিটির সভাও হয়ে গেল ২০১৯-এর ফেব্রুয়ারিতে। এরপর সাড়ে তিন বছর তারা নিশ্চুপ। আমাদের কিছুই জানাল না। এটা কোন রীতি? এরপর আমরা ২০২২-এর আগস্টে ফ্যাবের পক্ষ থেকে আন্দোলন শুরু হলে মন্ত্রী মহোদয় আমাদের নেতাদের ডেকে বললেন, তাঁরা ‘শনিবার বিকেল’ ছেড়ে দেবেন। তাঁদের দুয়েকটা পর্যবেক্ষণ আছে। সেসব ঠিক করে দিলেই ছেড়ে দিচ্ছেন। তাঁরা দ্রুতই চিঠি দিয়ে জানাবেন। কিন্তু আমাদের চিঠি না দিয়ে এখন আবারও আপিল কমিটির সভা ডাকা হলো, যে সভা তিন বছর আগেই একবার হয়ে গেছে!
প্রশ্ন :
২১ জানুয়ারি সভায় কমিটির কাছে আপনার কী বলার আছে?
কমিটির সদস্যদের মধ্যে অনেক খ্যাতিমান মানুষ আছেন। আমরা তাঁদের বিচক্ষণতা দেখার অপেক্ষায় আছি। বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি রক্ষার দায়িত্ব এখন আপিল কমিটির কাঁধে এসে পড়েছে। আমরা কি বাংলাদেশকে বিশ্বের কাছে এমন দেশ হিসেবে পরিচিত করতে চাই, যেখানে শিল্পের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে? এ ছাড়া বলতে চাই, আমার দেশের একটা ঘটনার ছায়া অবলম্বনে ছবি আমি ছবি বানিয়েছি। বিদেশি একজন চলচ্চিত্রকার তো সে ঘটনারই চিত্রায়ণ করেছেন। ফেব্রুয়ারি মাসের ৩ তারিখে সেটা বিশ্বব্যাপী মুক্তি পাবে। এটা শুধু আমাদের দেশের চলচ্চিত্রকারদের আত্মমর্যাদার প্রশ্ন নয়, বাংলাদেশেরই আত্মমর্যাদার ভার। আপিল কমিটি নিশ্চয়ই ব্যাপারটা গুরুত্ব দিয়ে দেখবে।
প্রশ্ন :
ছবিটি চার বছর ধরে আটকে আছে। পরিস্থিতি দেখে কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন, ছবিটি হয়তো ছাড়পত্র না–ও পেতে পারে।
অ্যাকটিভিজম আমার কাজ নয়। আমি সবচেয়ে ভালো থাকি, যখন সোফায় শুয়ে শুয়ে স্ত্রিপ্ট লিখি, শুটিংয়ের ফ্লোরে থাকি, অভিনয়শিল্পীদের সঙ্গে কমিউনিকেট করি, সম্পাদনার টেবিলে থাকি। সেটাই আমার যুদ্ধক্ষেত্র। আমি বা আমরা পরিচালক ও শিল্পীরা সে কাজেই ব্যস্ত থাকতে চাই। কিন্তু আমাদের ছবি নিয়ে ষড়যন্ত্র হলে বাধ্য হয়েই অ্যাকটিভিজমে নামতে হবে। আমি শুধু এটুকুই বলতে চাই, যা কিছুই ঘটুক না কেন, বাংলাদেশের মানুষ ৩ ফেব্রুয়ারির আগেই ‘শনিবার বিকেল’ দেখবে। এক ঘণ্টা আগে হলেও দেখবে।