‘আবেগ ও ভয়ে কাঁদছিলাম, উঁকি দিচ্ছিলাম, কখন সন্তানের মুখটা দেখব’
অপারেশন থিয়েটারের দিকে নার্স নিয়ে যাচ্ছেন নায়ক জিয়াউল রোশানের স্ত্রী তাহসিনা এশাকে। ঢোকার ঠিক আগমুহূর্তে স্ত্রীর মাথায় চুমু দিলেন। হাত বুলিয়ে দিলেন মাথায় ও পিঠে। দরজা বন্ধ হওয়ার আগপর্যন্ত ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন। এদিক-ওদিক পায়চারি শেষে কোনায় থাকা সোফায় গিয়ে বসলেন। কাঁদতে লাগলেন। বোরকা পরা এক নারী রোশানকে কাছে টেনে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। তারপরও কাঁদছেন। চোখ মুছছেন। আবার পায়চারি করতে থাকেন। উঁকি দিচ্ছিলেন থাই গ্লাসে। অপেক্ষার এক পর্যায়ে নার্স ট্রলিতে করে নিয়ে এলেন নবজাতককে। তোয়ালে জড়ানো নবজাতককে কোলে নেওয়ার পর কান্নাটা যেন বেড়ে গেল রোশানের। চুমু এঁকে দিলেন নবজাতককে। একটা সময় হাসতে দেখা গেল নায়ককে। স্ত্রীর পরামর্শে ঢালিউড তারকা রোশানের সন্তান পৃথিবীতে আসার দিনের সেই ভিডিও তাঁর অজান্তে ভিডিও করে রেখেছিলেন তাঁদেরই এক নিকটাত্মীয়। হাসপাতালের মুহূর্ত স্মৃতি হিসেবে ধরে রাখতেই এমনটা করা হয়েছে বলে জানালেন রোশান।
ভিডিওর সূত্র ধরে কথা হয় রোশানের সঙ্গে। কথা প্রসঙ্গে জানা গেল সন্তান আগমনের এই দিনে কান্নার কারণ। জানা গেল, আবেগ ও ভয়ে কাঁদছিলেন, উঁকি দিচ্ছিলেন, কখন সন্তানের মুখটা দেখবেন। রোশান বললেন, ‘আমার তো এমনিতে আবেগটা বেশি। পরিবারের সবাইও এমনটা বলে। তা ছাড়া এশাকে নিয়ে একটু টেনশনও ছিল। অপারেশন থিয়েটারে ঢোকার আগে বলছিল, “আমি যাব না। আমার ভয় লাগছে।” আমি তো ওর হ্যাভিটগুলো জানি। তা ছাড়া বাবুরে প্রথমবার দেখা, এটা নিয়েও অন্য রকম একটা আবেগ কাজ করছিল।’
আড়াই বছর আগে বিয়ে করেন ঢালিউড তারকা জিয়াউল রোশান। স্ত্রী তাহসিনা এশাকে নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেনও। বিয়ের খবরটি জানতেন তাঁর খুব কাছের বন্ধুবান্ধব। আরও জানতেন তাঁর আত্মীয়স্বজনের মধ্যে কেউ কেউ। জানতেন না শুধু তাঁর শ্বশুর। এ মাসের শুরুতে একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আত্মীয়স্বজনসহ সবাইকে জানায় দুই পরিবার। তত দিনে রোশানের স্ত্রী এশা ৯ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। চিকিৎসক যখন বাবা হওয়ার খবরটি রোশানকে জানান, তখন থেকে স্ত্রীর প্রতি বাড়তি যত্ন নেওয়া শুরু করেন। শুটিংয়ের সময়ের বাইরে পুরোটাই পরিবারকে দিতেন।
রোশান বললেন, ‘বাবু যখন ওর মায়ের পেটে ছিল, তখন থেকে বাবুকে বেশি অনুভব করতাম। প্রতিটা দিন মায়ের পেটে মাথা দিয়ে অস্তিত্ব অনুভব করতাম। কথা বলতাম। সন্তানের মুখ দেখব সেই মুহূর্তের জন্য আসলে অনেক দিন অপেক্ষা করছিলাম। প্রথমবার কোলে নেব। আমি যখন “বাবু বাবু” বলে কথা বলছিলাম, মনে হচ্ছিল, আমার সব কথা বুঝছে, উপলব্ধি করছে। অপলক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। হাসছিলও মনে হয়।’
২৫ মে সকালে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে রোশানের স্ত্রী তাহসিনা এশা কন্যাসন্তান জন্ম দিয়েছেন। এ সময় রোশানসহ দুই পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। তবে রোশানের মা–বাবা দুজনই গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ছিলেন। একমাত্র বড় বোন ছিলেন ঢাকায় তাঁর বাসার কাছে। তাই তো ছোট ভাইয়ের সন্তান পৃথিবীতে আগমনের দিনে পাশে ছিলেন। রোশান জানালেন, বোরকা পরা যে নারী তাঁর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন, তিনি তাঁরই আপন বড় বোন।
সন্তান জন্মের আগের দিন রাত সাড়ে তিনটায় বাসায় ফেরেন রোশান। সেদিন তিনি ঢাকার কাছেই একটি রিসোর্টে ‘রিভেঞ্জ’ নামে অসমাপ্ত ছবির শুটিং করছিলেন। বৃষ্টির কারণে সেদিন শুটিং দেরি হয়। চিকিৎসকের কাছ থেকে আগেই জানানো হয়েছিল, সন্তান জন্মের সম্ভাব্য তারিখ জুনের প্রথম সপ্তাহে। তাই ১ তারিখ থেকে শুটিং বন্ধ রাখার কথাও জানিয়েছিলেন পরিচালক ও প্রযোজককে।
রোশান বললেন, ‘আমরা দুজনই প্ল্যান করেছিলাম, ১ তারিখে হাসপাতালে ভর্তি করাব এশাকে। কিন্তু ২৪ তারিখ দিবাগত রাতে বাসায় ফিরলে এশা বলতে থাকে, তার খারাপ লাগছে। অস্থির লাগছে। আমি ফ্রেশ হয়ে ওর পাশেই বসে ছিলাম। রাতের খাবারও খাইনি। ভালো লাগছিল না। ভেবেছি, ওর পাশে থাকলে হয়তো ভালো লাগবে। ওর অস্থিরতা দেখে ঘুমও আসছিল না। ও খালি বলছিল, মনে হচ্ছে, বাবুটা পৃথিবীতে আসতে চাচ্ছে। এসব করতে করতে ভোর হয়ে যায়। এরপর ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলি। ডাক্তার বললেন, হাসপাতালে যাওয়ার পর প্রাথমিক চেকআপ করতে। এরপর ভর্তির পরামর্শ দিলেন। নয়টায় অপারেশন, তা–ও জানালেন। আমার আবার মা–বাবাও দুজনই সেদিন ঢাকায় ছিলেন না। তাঁরা হোমটাউন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। বোন ছিল বাসার পাশে। বোন সকালেই হাসপাতালে পৌঁছালেও মা–বাবা বিকেলে পৌঁছায়।’
পৌনে ১১টায় চিকিৎসক এসে জানালেন কন্যাসন্তানের বাবা হয়েছেন রোশান। চিকিৎসকের কাছে তখনই জানতে চাইলেন, সন্তানের মা কেমন আছেন। রোশান বললেন, ‘দুজনের জন্যই একইভাবে আবেগ কাজ করছিল। যখন ডাক্তার এসে আমাকে বললেন, মাশাআল্লাহ আপনার ফুটফুটে একটা মেয়ে হয়েছে। আমি জাস্ট জিজ্ঞেস করলাম, ও (এশা) কেমন আছে। বলল, দুজনই আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছে। এরপর বাবুকে দেখার অপেক্ষায় ছিলাম। উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিলাম। কান্নার শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। বাবু পৃথিবীতে আসার পর অনেক জোরে জোরে কাঁদছিল। কান্না শুনতে পাচ্ছিলাম। এটা অন্য রকম ইমোশন। এমন ইমোশনাল অভিজ্ঞতার মুখোমুখি জীবনে প্রথমবার হলাম। এই অনুভূতির কথা কাউকে বোঝানোও সম্ভব না আসলে।’
কথায়–কথায় রোশান বললেন, ‘আমি যখনই বাবুর দিকে তাকাই, সে–ও আমার দিকে তাকায়—অদ্ভুত রকমের ইমোশন কাজ করে। এই ইমোশনটা আসলে বাউন্ডলেস হ্যাপিনেস। ব্যাক অব মাইন্ডে বাবা-মায়ের কথাও মনে পড়ে। আমি যখন নামাজে বসি, কনটিনিউ ওর জন্য দোয়া করছি এবং দোয়া করি আমাকে যাঁরা জন্ম দিয়েছেন, তাঁদের জন্যও। আমার এখন এই উপলব্ধিও হচ্ছে, আমার যেমন বাবুর জন্য এমন আবেগ কাজ করছে, একইভাবে আমার মা–বাবার মধ্যে একই রকম আবেগ কাজ করে।’