‘অঞ্জনদা চলে গিয়ে অভাবটা বাড়িয়ে দিলেন’

পরিচালক জাহিদুর রহিম অঞ্জন। ফেসবুক

কয়েক বছর ধরে লিভারের জটিলতায় ভুগছিলেন জাহিদুর রহিম অঞ্জন। সুস্থতার আশায় কয়েক মাস ধরে বেঙ্গালুরুর স্পর্শ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন এই পরিচালক ও শিক্ষক। গত সপ্তাহে লিভার প্রতিস্থাপনের সিদ্ধান্ত নেন চিকিৎসকেরা। অস্ত্রোপচারের পর তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়। ছিলেন লাইফ সাপোর্টে। সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল সোমবার রাত সাড়ে আটটায় মারা যান এই গুণী নির্মাতা।

এই নির্মাতার মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে আসে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে। কেউ কেউ ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, বিশুদ্ধ শিল্পচর্চার মানুষ ছিলেন জাহিদুর রহিম। সেটাই তাঁর সিনেমায় ফুটে উঠেছে। কেউ লিখেছেন, হাসিমুখের এই নির্মাতার অকালপ্রয়াণে অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল।

শুটিংয়ের ফাঁকে জাহিদুর রহিম অঞ্জন। ফেসবুক

জাহিদুর রহিম অঞ্জনকে স্মরণ করে চলচ্চিত্র সমালোচক ও শিক্ষক ফাহমিদুল হক ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘অঞ্জনদা খুচরো কথার মাধ্যম ফেসবুকে এসে বিশুদ্ধ আর্ট ফর্ম নিয়ে আলাপ করতেন। খুবই বিরল ঘটনা। তিনি বাংলাদেশে চলচ্চিত্র আন্দোলনের পুরোধা এক ব্যক্তিত্ব। তিনি চলচ্চিত্রের শিক্ষক, চলচ্চিত্র নির্মাতা। তিনি আর্ট হাউস সিনেমার প্রমোটার। তিনি ফেসবুকে সব সময় শৈল্পিক চলচ্চিত্র বিষয়ে লিখতেন বা পোস্ট দিতেন। তাঁর টাইমলাইনে ঘুরলে দেখতে পাবেন, তিনি তারকোভস্কি, ঋত্বিক বা ব্রেসোঁ নিয়ে লিখছেন বা তাঁদের কথা উদ্ধৃতি আকারে তুলে ধরছেন।’

ফাহমিদুল হক শৈল্পিক চর্চার এই পরিচালককে নিয়ে আরও লিখেছেন, ‘আর দেখা যাবে, তাঁর ছবি “মেঘমল্লার” নির্মিত হয় ২০১৪ সালে। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের গল্প অবলম্বনে তৈরি। বা নতুন চলচ্চিত্র সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর উপন্যাস অবলম্বনে “চাঁদের অমাবস্যা” নিয়ে পোস্ট। আমি “মেঘমল্লার” নিয়ে রিভিউ লিখেছিলাম। অনুমান করি, “চাঁদের অমাবস্যা”র কাজ প্রায় শেষই। অপেক্ষা করব পরিবার বা বন্ধুজনেরা ছবিটির অসমাপ্ত কাজ শেষ করে মুক্তি দেবেন। তাঁর প্রস্থান অপূরণীয় ক্ষতির কারণ হবে। এই প্রস্থান অকস্মাৎ ও আগাম।’

জাহিদুর রহিম অঞ্জন। ছবি: ফেসবুক

জাহিদুর রহিম অঞ্জনের প্রয়াণে আরেক পরিচালক ফাকরুল আরেফিন খান লিখেছেন, ‘জহির রায়হান, আলমগীর কবির, তারেক শাহরিয়ার ও তারেক মাসুদের মতোই অঞ্জনদাও চলে গেল, সৃষ্টির কাছে অনেক অনেক ঋণ রেখে। একজন জাহিদুর রহিম অঞ্জন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সৃষ্টি হওয়া বিরল ও ব্যতিক্রম। অনেক যাত্রা শেষে যখন একজন সৎ চলচ্চিত্র নির্মাতা নির্মাণ হয়, অনেক প্রত্যাশা থাকে তাকে ঘিরে। হাসিমুখ চির অম্লান থাকুক, প্রিয় অঞ্জনদা।’

নির্মাতা হাসান মাসুদ উজ্জ্বল এই নির্মাতার স্মরণে লিখেছেন, ‘অঞ্জনদার সঙ্গে আড্ডা হতো বিসিটিআইতে ক্লাস নিতে গিয়ে। দেশে তো ফিল্মমেকারের অভাব নাই, ফিল্ম কালচার বোঝা ফিল্ম মেকারের অনেক বেশি অভাব। অঞ্জনদা চলে গিয়ে অভাবটা বাড়িয়ে দিলেন। শান্তিতে থাকুন, অঞ্জনদা।’

জাহিদুর রহিম অঞ্জন
ছবি: ফেসবুক

সিনেমা অন্তপ্রাণ মানুষ ছিলেন জাহিদুর রহিম। তিনি যেমন সিনেমা শিখিয়েছেন, তেমনি সিনেমা বানিয়েছেন। তুলে ধরেছেন তাঁর বক্তব্য। যে সিনেমায় খুঁজে পাওয়া যায় তাঁর স্বাত্যন্ত্র। নাট্য নির্মাতা গৌতম কৈরী এই পরিচালককে স্মরণ করে লিখেছেন, ‘যে জীবন সিনেমার, বাংলাদেশের চলচ্চিত্র আন্দোলনের অন্যতম কর্মী, শিক্ষক ও পরিচালক জাহিদুর রহিম অঞ্জন, চিকিৎসাধীন অবস্থায় ভারতের বেঙ্গালুরুর একটি হাসপাতালে মৃত্যু বরণ করেছেন। “চাঁদের অমাবস্যা” তাঁর সর্বশেষ সিনেমা। অঞ্জনদা সিনেমাটা না দেখেই চলে গেলেন!’

অভিনেতা কচি খন্দকার লিখেছেন, ‘আহ, আমাদের প্রিয় চলচ্চিত্র পরিচালক অঞ্জনদার প্রতি শ্রদ্ধা। আপনার সঙ্গে আর দেখা হবে না। এটা বেদনার।’

কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘রেইনকোট’ গল্প অবলম্বনে পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা ‘মেঘমল্লার’ নির্মাণ করেন অঞ্জন। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে মুক্তি পায় সিনেমাটি। এটি ছিল তাঁর প্রথম ফিচার ফিল্ম। প্রথম ছবির জন্যই তিনি ‘শ্রেষ্ঠ পরিচালক’ ও ‘শ্রেষ্ঠ সংলাপ রচয়িতা’ হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। সরকারি অনুদানে সর্বশেষ তিনি নির্মাণ করেন ‘চাঁদের অমাবস্যা’। শুটিং সম্পন্ন করে গত বছরই সিনেমাটি মুক্তির পরিকল্পনা থাকলেও দেশের সার্বিক অবস্থা এবং নিজের অসুস্থতার কারণে মুক্তি দিতে পারেননি। জাহিদুর রহিম অঞ্জনের ছোট ভাই সাজ্জাদুর রহিম গতকাল রাতে প্রথম আলোকে জানান, আগামীকাল বুধবার এই পরিচালকের লাশ দেশে নিয়ে আসার প্রস্তুতি চলছে।

আরও পড়ুন