‘পরাণ’ও ‘হাওয়া’য় সিনেমায় সুবাতাস
গত ২৯ জুলাই ২৩টি হলে মুক্তি পায় মেজবাউর রহমান সুমনের ‘হাওয়া’ সিনেমা। দ্বিতীয় সপ্তাহে এসে প্রায় দ্বিগুণ—৪২টি হলে মুক্তি পাচ্ছে ছবিটি। অন্যদিকে গত ঈদে মুক্তি পাওয়া তিন সিনেমার মধ্যে সবচেয়ে কম—১১ হলে মুক্তি পায় ‘পরাণ’। পঞ্চম সপ্তাহে এসেও প্রায় ৫০টি হলে চলছে ছবিটি। বলা যায়, প্রায় সমান গতিতে দুটি ছবি ঝড় তুলেছে প্রেক্ষাগৃহে।
করোনা, প্রেক্ষাগৃহের অব্যবস্থাপনাসহ নানা কারণে দীর্ঘদিন ধরে ঢাকাই সিনেমা ছিল স্থবির। এতে আটকে যায় বড় বাজেটের প্রায় দেড় ডজন সিনেমা। করোনা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও দর্শক আসবেন কি না, এমন শঙ্কায় সিনেমা মুক্তি নিয়ে দ্বিধায় ছিলেন পরিচালকেরা। গত ঈদুল ফিতরে মুক্তি পাওয়া ‘শান’ ও ‘গলুই’ দিয়ে ইঙ্গিত পাওয়া যায় দেশীয় সিনেমার ঘুরে দাঁড়ানোর। এরপর ঈদুল আজহায় বাংলা সিনেমা নিয়ে রীতিমতো উন্মাদনা তৈরি হয়। ঈদের তিন ছবি ‘পরাণ’, ‘দিন দ্য ডে’ ও ‘সাইকো’ দেখতে বন্ধুবান্ধব ও পরিবার নিয়ে ভিড় করতে থাকেন দর্শক।
কয়েক সপ্তাহ পর অন্য দুটি ছবি পিছিয়ে পড়লে পঞ্চম সপ্তাহেও পরাণ–এর জয়রথ চলছেই। এরপর গত ২৯ জুলাই মুক্তির পর হাওয়া তৈরি করে বাংলা সিনেমার নতুন রেকর্ড।
মুক্তির আগেই সিনেমাটির অগ্রিম টিকিট নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে যায়, কয়েকটি মাল্টিপ্লেক্সে প্রথম দিনের টিকিট বিক্রি হয়ে যায়, বাংলা সিনেমা নিয়ে দর্শকের ব্যাপক আগ্রহের কারণে বহুল আলোচিত হলিউড ছবি ‘থর: লাভ অ্যান্ড থান্ডার’–এর প্রদর্শনী স্থগিত করা হয়।
যা প্রযোজক ও পরিচালকদের মধ্যে নতুন আশার সঞ্চার করেছে। যাঁরা এত দিন সিনেমা মুক্তি দিতে ভয় পাচ্ছিলেন, তাঁরা নড়ে চড়ে বসেছেন। এরই মধ্যে বেশ কয়েকজন পরিচালক তাঁদের ছবির মুক্তির তারিখ ঘোষণা করেছেন। শুধু তাই-ই নয়, দ্রুত শুটিং শেষ করে সেন্সর বোর্ডে ছবি জমা দিচ্ছেন কোনো কোনো পরিচালক। নতুন পরিচালকেরাও প্রস্তুতি নিচ্ছেন বড় পর্দার চ্যালেঞ্জ নিতে। পরাণ ও হাওয়ার সাফল্যে ছোট পর্দার সাগর জাহান, কাজল আরেফিনসহ বেশ কয়েকজন সিনেমা তৈরির ঘোষণা দিয়ে ফেসবুকে পোস্ট করেছেন।
চলতি আগস্ট মাসসহ সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে বেশ কয়েকটি ছবি মুক্তির ঘোষণা এসেছে। ১২ আগস্ট শাহিন সুমনের মাফিয়া ফোর মুক্তি পাওয়ার কথা। ১৯ আগস্ট মুক্তি পাচ্ছে মোস্তাফিজুর রহমানের সরকারি অনুদানের ছবি ‘আশীর্বাদ’। ১৬ সেপ্টেম্বর মুক্তি পাবে একই পরিচালকের ‘স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা’। মাহমুদ দিদারের বহুপ্রতীক্ষিত ‘বিউটি সার্কাস’ মুক্তি পাওয়ার কথা ২৩ সেপ্টেম্বর। একই দিনে দীপংকর দীপনের ‘অপারেশন সুন্দরবন’–এর মুক্তি চূড়ান্ত হয়েছে।
সাইদুল ইসলামের ‘বীরত্ব’ আসবে ৩০ সেপ্টেম্বর। ৭ অক্টোবর মুক্তি পাবে দুটি ছবি—মোস্তাফিজুর রহমানের ‘যাও পাখি বল তারে’ ও ইস্পাহানি আরিফ জাহানের ‘হৃদিতা’। অক্টোবরে আরও দুই ছবির মুক্তিও চূড়ান্ত। বেলাল সানির ডেঞ্জারজোন মুক্তি পাবে ১০ অক্টোবর এবং ২৮ অক্টোবর আসবে সুজন বড়ুয়ার ‘বান্ধব’।
একের পর এক ছবি মুক্তির ঘোষণাকে ভীষণ ইতিবাচকভাবে দেখছেন চলচ্চিত্র–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। অনেকে বলছেন, বাংলা সিনেমার চাকা ঘুরতে শুরু করেছে। তবে এই যাত্রা অব্যাহত রাখতে সতর্ক থাকতে হবে। পরপর ভালো ছবি না দিলে দর্শক আবার হলবিমুখ হতে পারেন।
দর্শক যে হলে গিয়ে বাংলা সিনেমা দেখতে এভাবে আগ্রহী হয়ে উঠবেন, সেটা পরিচালক দীপংকর দীপনও ভাবতে পারেননি। তিনি বলেন, ‘ভালো সিনেমা দেখতে যে দর্শকের জোয়ার উঠবে, এটা জানতাম। কিন্তু এত দ্রুতই যে উঠবে, বুঝিনি। আমাদের তরুণেরা হলে গিয়ে ভালো সিনেমা দেখতে চান। পরাণ ও হাওয়া তার প্রমাণ। দেশীয় সিনেমার কারণে বিদেশি সিনেমাও নামিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছে হল কর্তৃপক্ষ। এটা প্রমাণ করে যে দেশীয় সিনেমার সম্ভাবনা কত বেশি। এ কারণে সিনেমা মুক্তি দিতে প্রযোজক–পরিচালকদের মধ্যে আস্থা ফিরে এসেছে।’
নিজের ছবি অপারেশন সুন্দরবন নিয়েও আশাবাদী দীপন বলেন, ‘পরাণ ও হাওয়া দেখতে এমন অনেক দর্শকই হলে গেছেন, যাঁরা কখনোই সিনেমা হলে সিনেমা দেখেননি। নতুন দর্শক আসার অভ্যাস তৈরি হয়েছে। আমার ছবিতেও এমন অনেক নতুন দর্শক পাব, এটাই প্রত্যাশা।’
মুক্তির মিছিলে আছে ‘পরাণ’ পরিচালক রায়হান রাফির নতুন ছবি ‘দামাল’ও। এর মধ্যেই সেন্সর বোর্ডে জমা পড়েছে ছবিটি। পরিচালক বলেন, ‘আগেই ঠিক করে রেখেছিলাম পরাণ–এর পরপরই এ ছবিটি মুক্তি দেব। সে পরিকল্পনা থেকেই সেন্সর বোর্ডে জমা দিয়েছি। হলে দর্শক আসা শুরু হয়েছে। তাঁদের যে ভালো সিনেমা দেখার ক্ষুধা আছে, তা পরাণ দিয়েই টের পেয়েছি।’
পরাণ–এর পর পরিচালকের কাছে দর্শকদের প্রত্যাশা বেড়ে গেছে। পরের ছবিতেও কি সেই ধারাবাহিকাতা থাকবে? রাফি বলেন, ‘দামাল আরও বড় ধামাকা হবে। এ ছবিতে পরাণ–এর দুই তারকা শরীফুল রাজ ও মিমের সঙ্গে সিয়ামও আছে। তিনজনের আলাদা ভক্ত-দর্শক আছেন। সবমিলে দর্শকের জন্য আরও বড় চমক নিয়ে আসছে দামাল।’
চলতি বছর মুক্তির মিছিলে আছে মোস্তাফিজুর রহমানের তিনটি সিনেমা। বাংলা ছবি নিয়ে দর্শকদের মধ্যে আগ্রহ তৈরি হওয়াতেই তিন ছবি মুক্তি দিচ্ছেন বলে জানালেন তিনি। পরিচালক বলেন, ‘চলচ্চিত্রে দর্শকখরা চলছিল। কয়েকটি মৌলিক সিনেমার কারণে আবারও দর্শক হলে আসছেন। দর্শকের দেখার অভ্যাস ধরে রাখতে একের পর এক ভালো সিনেমা দরকার। সে ভাবনা থেকেই ছবিগুলো মুক্তি দিচ্ছি।’ এই পরিচালক জানালেন, তাঁর আরেকটি ছবি আনন্দ অশ্রু নভেম্বরে মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনা আছে।
তবে কেবল একের পর এক ছবি মুক্তি পেলেই হবে না, ভালো গল্প, ভালো নির্মাণের দিকে জোর দিতে বলেছেন প্রবীণ পরিচালক মতিন রহমান। তিনি বলেন, ‘ভালো গল্প, ভালো নির্মাণ হলে দর্শক হলে গিয়ে সিনেমা দেখবেন, এটাই স্বাভাবিক। দেশে সিনেমার প্রচুর দর্শক আছে। ভালো সিনেমার অভাবে দর্শকের আকাল তৈরি হয়েছিল। এখন দর্শক ফিরেছেন। দর্শক রাখতে হলে মাথায় রাখতে হবে গল্প ও নির্মাণটা যেন ঠিকঠাক থাকে।’