কবরী-সোহেল রানার যৌনশিক্ষামূলক ছবিটি ‘অ্যাডাল্ট’ সনদ পেয়েছিল

‘অ্যাডাল্ট’ (১৮ ‍+) ক্যাটাগরিতে ‘গোপন কথা’ সিনেমাকে সেন্সর সনদ পেয়েছিলকোলাজ

‘গোপন কথা’ নিয়ে সেন্সর বোর্ডের সদস্যদের সঙ্গে পরিচালক আজাদ রহমানের বচসা হয়েছিল। ছবিটি নিয়ে সেন্সর বোর্ডের সদস্যরা রীতিমতো গোঁ ধরে ছিলেন। এটিকে কিছুতেই ‘আনরেস্ট্রিক্টেড’ (সর্বজনীন) সনদ দেবে না বোর্ড।

বোর্ডের দাবি, সিনেমাটি প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য উপযোগী। ফলে ১৯৭৬ সালে ‘অ্যাডাল্ট’ (১৮ ‍+) ক্যাটাগরিতে সিনেমাটিকে সেন্সর সনদ দিয়েছিল সেন্সর বোর্ড।

চলচ্চিত্র বিশ্লেষকেরা বলছেন, সত্তর-আশির দশকে ঢাকাই সিনেমার রমরমা সময়ে কোনো সিনেমার অ্যাডাল্ট সনদ পাওয়ার ঘটনা ছিল নজিরবিহীন। সেই সময়ে সেন্সর পাওয়া প্রায় সব ছবিই ছিল ‘আনরেস্ট্রিক্টেড’ (সর্বজনীন)। এর বাইরে কয়েকটি ছবিকে নিষিদ্ধ করেছিল বোর্ড।

আরও পড়ুন
‘গোপন কথা’ সিনেমায় অভিনয় করেছেন কবরী-সোহেল রানা
কোলাজ
সেই সময়ে আর কোনো ছবি অ্যাডাল্ট ক্যাটাগরিতে সেন্সর সনদ পায়নি।
মতিন রহমান, চলচ্চিত্র–গবেষক

সোহেল রানা ও কবরী জুটির সিনেমাটি অ্যাডাল্ট সনদ পাওয়ার ঘটনা ঢালিউডে আলোড়ন তুলেছিল। অ্যাডাল্ট ছবি নিয়ে দর্শক তো বটেই, ঢাকাই সিনেমার নির্মাতা–প্রযোজকদের খুব একটা ধারণা ছিল না।

‘গোপন কথা’ বাদে সত্তর থেকে নব্বইয়ের দশকে আর কোনো ছবি অ্যাডাল্ট সনদ পেয়েছিল কি না, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

তবে চলচ্চিত্র–গবেষক ও নির্মাতা মতিন রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সেই সময়ে আর কোনো ছবি অ্যাডাল্ট ক্যাটাগরিতে সেন্সর সনদ পায়নি। ফলে ‘গোপন কথা’ নিয়ে বিস্তর চর্চা হয়েছিল।

এর মধ্যে প্রায় সাড়ে পাঁচ দশক ধরে গেঁড়ে থাকা সেন্সর বোর্ডের ইতি ঘটেছে। ২০২৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন বোর্ড’ গঠন করেছে সরকার। সার্টিফিকেশন বোর্ডের প্রস্তাবিত বিধিমালায় ১৮‍+ (অ্যাডাল্ট), ইউনিভার্সালসহ (সর্বজনীন) পাঁচটি ক্যাটাগরি রয়েছে।

সার্টিফিকেশন বিধিমালার রেটিং নিয়ে আলোচনার মধ্যে পাঁচ দশকের পুরোনো ‘গোপন কথা’ ছবিটি আলোচনায় এসেছে। চলচ্চিত্র সেন্সরশিপ আইন, ১৯৬৩ অনুসারে ১৯৭৬ সালে ছবিটিকে এই সনদ দিয়েছিল বোর্ড।

১৯৭৬ সালের ৫ নভেম্বর দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক বাংলাসহ বেশ কয়েকটি পত্রিকায় প্রকাশিত চলচ্চিত্রটির পোস্টার
সংগ্রামের নোটবুক

পুরোনো পত্রিকা ঘেঁটে জানা গেছে, ১৯৭৬ সালের ৫ নভেম্বর ঢাকার মধুমিতা, লায়ন, বলাকা, অভিসার, জোনাকি, স্টার, লায়নসহ বেশ কয়েকটি প্রেক্ষাগৃহে ‘গোপন কথা’ মুক্তি পেয়েছিল। তখন পত্রিকায় সিনেমার বিজ্ঞাপন দেওয়ার চল ছিল।

মুক্তির দিনে দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক বাংলাসহ বেশ কয়েকটি পত্রিকায় প্রকাশিত চলচ্চিত্রটির পোস্টারে বলা হয়, ‘বাংলা ভাষায় উপমহাদেশের প্রথম যৌনশিক্ষামূলক ছবি।’ সেন্সর বোর্ডের নির্দেশনা মেনে পোস্টারে লেখা হয়, ‘ছবিটি কেবলমাত্র প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য।’ ১৮ বছরের নিচে কোনো দর্শকের সিনেমাটি দেখার সুযোগ ছিল না।

সিনেমাটি পরিচালনা করেছেন পরিচালক আজাদ রহমান। তবে তিনি সুরকার ও সংগীত পরিচালক হিসেবেই অধিক সমাদৃত। ‘জন্ম আমার ধন্য হলো মা গো’সহ বহু জনপ্রিয় গানের সুরস্রষ্টা আজাদ রহমান। তাঁর ‘গোপন কথা’ সিনেমায় জুটি বেঁধেছিলেন সোহেল রানা ও কবরী। কল্পনা, বেবী জামানসহ আরও অনেকে অভিনয় করেন।

ছবিতে কী আছে

ছবির মূল বিষয়বস্তু—জন্মনিরোধ। ১৯৭৬ সালে জিয়াউর রহমান ঘোষণা দেন, জনসংখ্যাই বাংলাদেশের ‘এক নম্বর সমস্যা’। ফলে জন্মনিরোধ নিয়ে দেশে ব্যাপক প্রচার শুরু হয়। বিষয়টি নিয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরির জন্য ছবিটি নির্মাণ করেন আজাদ রহমান।

ছবিটির সঙ্গে সরকারের সরাসরি যোগসূত্র ছিল কি না, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। সিনেমায় গনোরিয়া-সিফিলিসের মতো যৌনরোগ নিয়ে ধারণা দেওয়া হয়। বলা হচ্ছে, ‘বাংলা ভাষায় উপমহাদেশের প্রথম যৌনশিক্ষামূলক ছবি।’

‘অ্যাডাল্ট’ সনদ পেয়েছিল কেন

চলচ্চিত্র বিশ্লেষকেরা বলছেন, আজাদ রহমান সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকা পরিচালক ছিলেন। ফলে দর্শকের মধ্যে সচেতনতা তৈরিতে যৌনশিক্ষামূলক ছবিটি নির্মাণ করেছিলেন। তবে সেন্সর বোর্ড বিষয়টিকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করেছিল।

সিনেমার নির্মাতা ও শিল্পীদের মধ্যে আজাদ রহমান, কবরী থেকে বেবী জামান—কেউই বেঁচে নেই। জীবিত শিল্পীদের মধ্যে চিত্রনায়ক সোহেল রানার সঙ্গে কথা ছবিটি নিয়ে বলেছে প্রথম আলো।

অ্যাডাল্ট সনদ পেয়েছিল কেন—এমন প্রশ্নের জবাবে স্মৃতি হাতড়ে সোহেল রানা বলেন, ছবিটির সেন্সর নিয়ে একটু গন্ডগোল হয়েছিল। এটা খুবই সাধারণ একটা সিনেমা। ছবিতে এমন কোনো দৃশ্য ছিল না, যেটার জন্য অ্যাডাল্ট সনদ দেওয়া হবে।

সোহেল রানা
ছবি: সংগৃহীত

তাহলে সেন্সর বোর্ডের আপত্তি কোথায় ছিল? সোহেল রানার ভাষ্যে, ‘তখন সেন্সর বোর্ড অনেকটা ব্যাকডেটেড (পশ্চাৎপদ) ছিল। আমি যতটুকু শুনেছি, সিনেমার এক খল চরিত্রের সিফিলিস বা গনোরিয়া হয়েছিল। বিষয়টি শিক্ষণীয়ভাবে তুলে ধরা হয়েছিল। ওরা (সেন্সর বোর্ডের সদস্য) ভেবেছিল, ছবিটি তরুণদের পতিতালয়ে যাওয়াটাকে উৎসাহিত করবে। সেই জায়গা থেকে হয়তো অ্যাডাল্ট সনদ দেওয়া হয়েছিল।’

‘আজাদকে যতটুকু জানি, ও খুবই রুচিশীল মানুষ। আমার ও কবরী—কারও সঙ্গেই এসব জিনিস যায় না। তারা ছবিটিকে যে কারণে অ্যাডাল্ট বলতে চেয়েছিল, সেসব জিনিস আমাদের সঙ্গে যায় না। মাঝে অশ্লীল ছবির জোয়ার এসেছিল, আমি কিংবা কবরী—কেউই সেসব ছবি করিনি। “গোপন কথা” শিক্ষামূলক সিনেমা, মানুষের মাঝে একটা বার্তা দেওয়ার জন্য সিনেমাটি করা হয়েছিল।’ যোগ করলেন সোহেল রানা।

তখন সেন্সর বোর্ড অনেকটা ব্যাকডেটেড (পশ্চাৎপদ) ছিল।
সোহেল রানা, চিত্রনায়ক

ছবিটি দর্শক দেখেছিল?

সিনেমাটি মুক্তির দুই দিন পর ইত্তেফাকে এক কলামে বিজ্ঞাপন চোখে পড়েছে। তাতে দাবি করা হয়েছে, ‘হাউসফুল। দর্শকের প্রশংসাধন্য।’ তবে চলচ্চিত্র–গবেষক থেকে সিনেমার অভিনয়শিল্পী তা মানতে নারাজ। তাঁরা বলছেন, ছবিটি আসলে খুব একটা চলেনি।

সোহেল রানা বলছেন, ‘ছবিটা মুক্তির পর খুব একটা চলেনি। অ্যাডাল্ট সনদ দিয়ে ব্যবসাটা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। আমার ও কবরীর নাম শুনলেই যে ব্যবসাটা হতো, অ্যাডাল্ট শোনার পর আর সেই ব্যবসাটা হয়নি।’

মধুমিতা হলেও মুক্তি পেয়েছিল ‘গোপন কথা’
ছবি: প্রথম আলো

সিনেমাটি ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে ১৩টি হলে মুক্তি পেয়েছিল। সিনেমাটি নিয়ে মধুমিতা, লায়নসহ বেশ কয়েকটি হল মালিকদের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। লায়ন সিনেমাসের কর্ণধার মির্জা খালেক প্রথম আলোকে জানান, সোহেল রানা ও কবরীর মতো তারকা থাকার পরও ছবিটি খুব একটা চলেনি।

সত্তর-আশির দশকের দর্শক মূলত পারিবারিক গল্প, ফোক-ফ্যান্টাসি ঘরানার সিনেমা দেখতে ভিড় করতেন। পরিবার নিয়ে সিনেমা দেখতে হলে ভিড় করতেন দর্শকেরা।

দর্শকের মধ্যে একটা ধারণা ছিল, ছবিটি দেখতে যাব, কেউ যদি দেখে ফেলে! ফলে অনেকে ছবিটি দেখতে আসেনি।’
মির্জা খালেক, লায়ন সিনেমাসের কর্ণধার

রমরমা সময়েও ‘গোপন কথা’ না চলার কারণ হিসেবে সোহেল রানা বলছেন, ‘তখন আমাদের মনমানসিকতা অনেকটা রক্ষণশীল ছিল।’ আর মির্জা খালেক বলছেন, ‘তখন অ্যাডাল্ট ছবি নিয়ে দর্শকের কিছুটা অনীহা ছিল। দর্শকের মধ্যে একটা ধারণা ছিল, ছবিটি দেখতে যাব, কেউ যদি দেখে ফেলে! ফলে অনেকে ছবিটি দেখতে আসেনি।’

ফলে বাংলা চলচ্চিত্রের রমরমা সময়েও ছবিটি ব্যবসা করতে পারেনি। চিত্রপরিচালক ও চলচ্চিত্র-গবেষক মতিন রহমান প্রথম আলোকে জানান, সেই সময়ে দর্শক পরিবার নিয়ে বাংলা সিনেমা দেখতেন। ফলে অ্যাডাল্ট সিনেমার তুলনায় পরিবার নিয়ে দেখার মতো সর্বজনীন সিনেমা নিয়েই দর্শকের আগ্রহ বেশি ছিল।