আওয়ামী দুঃশাসনের এক্স-রে রিপোর্ট ‘৮৪০’, বললেন ফারুকী
১৭ বছর আগে ২০০৭ সালে মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বানিয়েছিলেন ধারাবাহিক নাটক ‘৪২০’। এ নাটকের মাধ্যমে ছোট পরিসরে বাংলাদেশের রাজনীতির উত্থান-পতনের গল্প বলার চেষ্টা করে তিনি। ওই সময় বানানো ফারুকীর সেই নাটক চ্যানেল আইয়ে প্রচারের পর জনপ্রিয়তা পায়। ২০২৪ সালে এসে ‘৮৪০’ ওরফে ‘ডেমোক্রেসি প্রাইভেট লিমিটেড’ বানালেন এই পরিচালক। নির্মাতার ভাষায়, এটি ‘৪২০’-এর ডাবল আপ ‘৮৪০’। ফেসবুক পোস্টের ক্যাপশনে পরিচালক ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী লিখেছেন, ‘ডেমোক্রেসি প্রাইভেট লিমিটেড। এখন মুক্তি পাচ্ছে সিনেমা হলে, এরপর পর্যায়ক্রমে টেলিভিশন ও ওটিটিতে মুক্তি পাবে।’ গত শুক্রবার ট্রেলার প্রকাশের পর এমনটাই জানান নির্মাতা।
১৩ ডিসেম্বর ঢাকাসহ সারা দেশের প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাচ্ছে ‘৮৪০’। পাশাপাশি দেশের বাইরের প্রেক্ষাগৃহেও মুক্তির পরিকল্পনা চলছে বলে গতকাল রোববার সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে জানিয়েছেন প্রযোজক নুসরাত ইমরোজ তিশা।
‘৮৪০’–এর প্রধান চরিত্র মেয়র ডাবলু হয়ে পর্দায় হাজির হবেন নাসির উদ্দিন খান। ট্রেলারে তাঁর উপস্থিতি ও সংলাপে ছিল চমক, ‘আমি এত ভালো উন্নয়ন করছি, তবু একটা লোকও আমারে ভালোবাসল না কেন...?’ ফারুকী আগেই জানিয়েছিলেন, এটি রাজনৈতিক বিদ্রূপধর্মী কাজ। গত শুক্রবার সন্ধ্যায় নিজের ফেসবুকে ‘৮৪০’-এর ট্রেলার পোস্ট করেন নির্মাতা। এ প্রসঙ্গে আগে দেওয়া ফেসবুক পোস্টে ফারুকী লিখেছিলেন, ‘আগের অন্তর্বর্তী সরকারের সময় বানাই ‘৪২০’। প্রকৃতির কী বিচিত্র খেয়াল, আবার আসছে সে রকম একটা দুষ্টু কিছু, তাও আরেক অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে। যেটার শুটিং করেছি ফ্যাসিবাদের কালে। খোদার কসম, এটা মুক্তি পাওয়ার পর তোমরা ভেবো না আমি আগেই জানতাম, এই সময়ে অন্তর্বর্তী সরকার থাকবে! তা না হলে এটা কোন সাহসে বানালাম?’
ট্রেলার দেখে অনেকেই বলছেন, অনেক দৃশ্য এমনকি সংলাপেও হুবহু মিল আছে আগের সরকারের নানা কর্মকাণ্ডের সঙ্গে। এতটা মিল কীভাবে হলো? প্রশ্ন করতেই ফারুকী প্রথম আলোকে বলেন, ‘সিনেমার কাজ তো বাস্তব থেকে মধু আহরণ করে পর্দায় উপস্থাপন করা। এটার শুটিং করেছি ২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে, তখন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায়। তার সব ফ্যাসিবাদী যন্ত্রও ক্ষমতায়। এটা ঠিক যে শুটিং করার সময় আমরা আশঙ্কার মধ্যে থাকতাম। আমরা যে চিত্রনাট্য নিয়ে শুটিং করছি, এটা যদি কেউ টের পেয়ে যায়, তাহলে আমাদের কী হবে!’
‘৮৪০’–এর শুটিং হয়েছে নওগাঁ, ঢাকার দিয়াবাড়ি, তেজগাঁও, চট্টগ্রামের ফয়’স লেক ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে। নওগাঁয় শুটিংয়ের ঘটনা উল্লেখ করে ফারুকী বলেন, ‘একদিন শুটিংয়ের সময় বলেছিলাম যে জেলা পর্যায়ের ডিসি অফিসে সাধারণত কোন ধরনের মানুষ থাকেন, তাঁদের আনা হোক। প্রবীণ বেশ কয়েকজন মানুষকে আনা হয়। আমরা শুটিং করছি। শুটিংয়ে সংলাপ ছিল, “নির্বাচন ছাড়াই মেয়র ডাবলুকে আরও পাঁচ বছর রেখে দেওয়া হোক”। এই সংলাপ শুনে পাশে বসা ওই শহরের এক প্রবীণ ব্যক্তি হঠাৎ করে কাউকে কিছু না বলে গোমড়া মুখে উঠে চলে গেলেন। আমি মনিটর দেখে আতঙ্কিত হলাম, কী ব্যাপার! কিছুক্ষণ পর জানতে পারলাম, যিনি উঠে গেছেন, তিনি আওয়ামী লীগের সঙ্গে খুবই ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। যাওয়ার সময় একজনকে বলে গেছেন, “উনি ( মোস্তফা সরয়ার ফারুকী) কি চালাক? উনি মনে করছে আমরা বোকা, আমরা বুঝি না উনি কী নিয়ে শুটিং করছেন!” (হাসি) এর পর থেকে সত্যি আমি আশঙ্কায় ছিলাম, কবে না জানি আবার ফাঁস হয়ে যায় সবকিছু। যা–ই হোক ঠিকঠাকমতো শুটিং করতে পেরেছিলাম।’
কথা প্রসঙ্গে ফারুকী বলেন, ‘এটা ঠিক যে ট্রেলার দেখে দর্শক যেমন বুঝতে পারছেন, বিগত সরকারের আমলে বাংলাদেশটা কেমন ছিল, এটা একটা জেলা শহরের মধ্য দিয়ে আমরা দেখাতে পেরেছি। এটাকে আমরা বলতে পারি, আওয়ামী দুঃশাসনের এক্স-রে রিপোর্ট। আমি বিশ্বাস করি, এই দুঃশাসন নিয়ে আরও এক্স-রে রিপোর্ট সামনে হবে।’
ফারুকীর কাছে প্রশ্ন ছিল, আপনি লিখেছেন, ‘৮৪০’ বানানোর সময় জানতেন না, এটা মুক্তি পাবে কি না। আপনার সিনেমা আগের সরকার মুক্তি পেতে দেয়নি। তারপরও কেন এমন একটা প্রকল্প বেছে নিলেন?
উত্তরে তিনি বলেন, ‘আগের সরকার ২০১৭ সাল থেকে টানা ৫ বছর আমার ছবি আটকে রেখেছিল। ২০১৫ সালে তাদের কেন্দ্রীয় তদন্ত দল দিয়ে হয়রানি করেছিল। ফলে আমি জানতাম যে তাদের একধরনের আক্রমণের রাডারের মধ্যে আছি। কিন্তু ফিল্ম মেকার তো...কত আর দিন দিন পাখি গান না গেয়ে থাকতে পারে? আমি ‘সামথিং লাইক অ্যান অটোবায়োগ্রাফি’ নামে একটা ছবি বানিয়েছি, যেটা চরকিতে আছে। এই ছবির মধ্যে আমি দেখিয়েছি, ফিল্ম মেকার তার কথা বলতে গিয়ে কতটা সংকটের মধ্যে পড়ে। আমি যে সংকটের মধ্যে আছি, এটা আওয়ামী লীগের আমলেও দেখিয়েছি। তবে এটা যখন শুটিং করছি, এর মধ্যে এত বিস্ফোরক সব জিনিস আছে, ফলে আমার একটা আশঙ্কা সারাক্ষণ ছিল, আমরা যে একটা কনটেন্ট কষ্ট করে বানাচ্ছি, আমরা কি আদৌ দেখাতে পারব? এই আশঙ্কা আমাকে সারাক্ষণ মানসিক চাপ দিত। প্রতিদিন শুটিংয়ের মধ্যে ভাবতাম, আজকে কি কেউ বুঝে ফেলবে, আমরা কী নিয়ে শুটিং করছি? শুটিং লোকেশনের ডানে–বাঁয়ে সারাক্ষণ তাকাতাম। তবে ফিল্ম মেকারকে কখনো কখনো ঝুঁকি নিতে হয়। একটা সিনেমা আটকে আছে, আরেকটা নাহয় আটকে দেবে—এর বেশি তো আর কিছু হবে না। নাহয় আমাকে একসময় ফিল্ম মেকিংই ছেড়ে দিতে হবে।’
আপনি বলছিলেন, ‘৮৪০’ আওয়ামী দুঃশাসনের এক্স-রে রিপোর্ট, এটা কি আপনার অভিনয়শিল্পীরা বুঝতে পেরেছিলেন? ফারুকী বলেন, অভিনয়শিল্পীরা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছিলেন। কিন্তু তাঁরা কাজটার মধ্যে এতটা ডুবে গিয়েছিলেন, তাই হয়তো কাউকে বিষয়টা বলেননি।
‘৮৪০’–এর ট্রেলারে নাসির উদ্দিন খান ছাড়া দেখা গেছে ফজলুর রহমান বাবু, বিজরী বরকতুল্লাহ, নাদের চৌধুরী, জয়, মারজুক রাসেল, মমসহ আরও অনেককে। গতকাল দুপুরে কথা হয় কেন্দ্রীয় চরিত্র নাসির উদ্দিন খানের সঙ্গে। ট্রেলার প্রকাশের পর প্রতিক্রিয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সবাই বলছে, খুব দারুণ হয়েছে। ফাটাইয়ে দিয়েছে। তবে কিছু পোস্টে নেতিবাচক মন্তব্যও পাচ্ছি, যেমনটা হয়ে থাকে আরকি।’
জানা গেছে, ২০২৩ সালের মে মাসে ‘৮৪০’–এ যুক্ত হন নাসির উদ্দিন খান। সে বছর নভেম্বর থেকে শুটিং শুরু হয়। এর আগপর্যন্ত পরিচালকের সঙ্গে সময় কেটেছে তাঁর। কখনো পরিচালকের বাসায়, কখনো অফিসের আড্ডায় কিংবা টেলিফোনে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, চরিত্রের মনস্তত্ত্ব, দর্শন নিজের মধ্যে ধারণ করতে এসব আড্ডা দারুণ কাজে দিয়েছে। বাকিটা বডি ল্যাঙ্গুয়েজ। শুটিং নভেম্বরে শুরু হলেও কস্টিউমসহ মহড়া করেছেন তারও এক মাস আগে থেকে। ফারুকীর সঙ্গে এবারই প্রথম কোনো কাজের অংশ হলেন এই অভিনেতা। এই পরিচালকের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে তাঁর মনে হয়েছে, কাজের কষ্ট তুলনামূলক কম। তিনি বলেন, পরিচালক নিজে অনেক কৌশল শিখিয়ে দিয়েছেন। চরিত্রের অনেক বিশ্লেষণও দিয়েছেন, যা ভালো লাগার বিষয়।
কাজটা করতে গিয়ে নতুন উপলব্ধি হয়েছে নাসিরের। বিষয়টা বললেন এভাবে, পরিচালকের প্রতি যত বেশি শিল্পীকে সঁপে দেওয়া যায়, অভিনয়শিল্পীদের তত বেশি লাভ। পরিচালকই তখন তাঁর মতো করেই অভিনয়শিল্পীকে গড়ে তুলবেন। তবে এ ক্ষেত্রে ইম্প্রোভাইজেশনের মাধ্যমে অভিনয়শিল্পীরা তো তাৎক্ষণিকভাবে অলংকরণ যোগ করবেনই।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ‘৮৪০’–এর যাবতীয় শুটিং শেষ হয় বলে জানান প্রযোজক নুসরাত ইমরোজ তিশা।
১৩ ডিসেম্বর দেশের প্রেক্ষাগৃহে মুক্তির পর ‘৮৪০’ টেলিভিশন ও ওটিটিতেও মুক্তি পাবে। তবে কবে ও কখন, তা সময়মতো জানিয়ে দেওয়া হবে। ‘৮৪০’ সিনেমার প্রযোজনায় আছেন নুসরাত ইমরোজ তিশা ইন অ্যাসোসিয়েশন উইথ ইমপ্রেস টেলিফিল্ম। চিত্রগ্রহণে ছিলেন শেখ রাজিবুল ইসলাম, সংগীত পরিচালনায় পাভেল আরীন এবং সম্পাদনায় তাহসিন মাহিম।