তিনি নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান
ছবির মাধ্যমে গ্রামবাংলাকে তিনি সবার কাছে তুলে ধরেছেন। ছবিতে মাটি ও মানুষের কথা বলতেন তিনি। ছিলেন রাজনীতিসচেতন। তিনি বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের প্রখ্যাত পরিচালক আমজাদ হোসেন। শুধু পরিচালনা নয়, লেখালেখি আর অভিনয়েও ছিলেন তিনি অনন্য। বেঁচে থাকলে আজ তাঁর ৮০ বছর পূর্ণ হতো। তাঁকে ঘিরে থাকত নানা আয়োজন। কিন্তু সেসব আজ অতীত। ৭৬ বছর বয়সে ব্যাংককে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২০১৮ সালের ১৪ ডিসেম্বর মারা যান আমজাদ হোসেন। ১৯৪২ সালের আজকের দিনে জামালপুরে জন্মগ্রহণ করেন আমজাদ হোসেন।
শৈশব থেকেই ছিলেন সাহিত্যানুরাগী। কিশোর বয়স থেকেই সাহিত্যচর্চা শুরু করেন। ক্লাস থ্রিতে প্রথম ছড়া লেখেন, যা প্রকাশিত হয়েছিল ‘আজাদ’ পত্রিকায় শিশুদের পাতায়। ম্যাট্রিক পাস করে কলেজে ভর্তি হওয়ার পর কাউকে না জানিয়ে গোপনে কলকাতার ‘দেশ’ পত্রিকায় কবিতা লিখে পাঠান। প্রকাশের আগেই ‘দেশ’ পত্রিকা থেকে সম্পাদক সাগরময় ঘোষ আমজাদ হোসেনকে একটি চিঠি পাঠান। পঞ্চাশের দশকে ঢাকায় এসে সাহিত্য ও নাট্যচর্চার সঙ্গে জড়িত হন। বিনোদন অঙ্গনে কাজের শুরুটা ছিল মহিউদ্দিন পরিচালিত ‘তোমার আমার’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে। এরপর তিনি অভিনয় করেন মুস্তাফিজ পরিচালিত ‘হারানো দিন’ ছবিতে।
একজন সাহিত্যিক হিসেবে উপন্যাস, ছোটগল্প ছাড়াও আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থও লিখেছেন। মুক্তিযুদ্ধ–পূর্বকালীন যে সিনেমা স্বাধীনতা আন্দোলনে গণজোয়ার এনেছিল, সেই ‘জীবন থেকে নেয়া’র কাহিনিকার, সংলাপ রচয়িতাও ছিলেন আমজাদ হোসেন। গ্রামবাংলার ভালোবাসার ছবি হিসেবে যেই ছবিটি সবচেয়ে বেশি পরিচিত, সেই ‘সুজন সখী’রও কাহিনিকার, সংলাপ রচয়িতা তিনি। পৌরাণিক কাহিনি নিয়ে নির্মিত জনপ্রিয় ছবি ‘বেহুলা’র সংলাপও তাঁর লেখা। এ ছাড়া ‘ধারাপাত’, ‘আনোয়ারা’, ‘আবার তোরা মানুষ হ’, ‘জয়যাত্রা’, ‘আকাশ ছোঁয়া ভালোবাসা’র মতো জনপ্রিয় ছবিগুলোর কাহিনিকার তিনি।
অভিনেতা আমজাদ হোসেনও বেশ জনপ্রিয়। ‘জীবন থেকে নেয়া’র আলোচিত চরিত্র ‘মধু ভাই’ রূপে অনবদ্য অভিনয় করে দর্শকদের হৃদয়ে তিনি গেঁথে আছেন। এ ছাড়া ‘হারানো দিন’, ‘আগুন নিয়ে খেলা’, ‘বেহুলা, ‘প্রাণের মানুষ’, ‘প্রেমী ও প্রেমী’সহ অনেক সিনেমায় তিনি অভিনয় করেছেন। একসময়কার বাংলাদেশিদের ঈদ বিনোদনের অন্যতম অনুষঙ্গ জনপ্রিয় টিভি সিরিজ ‘জব্বর আলী’র নাম ভূমিকায় তিনিই অভিনয় করেছেন। ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’, ‘সুন্দরী’ সিনেমার সেই কালজয়ী গানগুলোর রচয়িতাও তিনি। আমজাদ হোসেনের লেখা নাটক ‘ধারাপাত’ নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন সালাহউদ্দিন। এতে আমজাদ হোসেন নায়ক হিসেবে অভিনয় করেন। এরপর তিনি জহির রায়হানের ইউনিটে কাজ শুরু করেন। এভাবেই দীর্ঘদিন কাজ করতে করতে ১৯৬৭ সালে নিজেই চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন, নাম ‘জুলেখা’। তাঁর পরিচালিত দর্শকপ্রিয় চলচ্চিত্রের মধ্যে আছে ‘বাল্যবন্ধু’, ‘পিতাপুত্র’, ‘এই নিয়ে পৃথিবী’, ‘বাংলার মুখ’, ‘নয়নমনি’, ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’, ‘সুন্দরী’, ‘কসাই’, ‘জন্ম থেকে জ্বলছি’, ‘দুই পয়সার আলতা’, ‘সখিনার যুদ্ধ’, ‘ভাত দে’, ‘হীরামতি’, ‘প্রাণের মানুষ’, ‘সুন্দরী বধূ’, ‘কাল সকালে’, ‘গোলাপী এখন ঢাকায়’ ‘গোলাপী এখন বিলেতে’ ইত্যাদি।
১৯৭৮ সালে আমজাদ হোসেন ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ নির্মাণ করেন। নিজের লেখা ‘ধ্রুপদী এখন ট্রেনে’ উপন্যাস অবলম্বনে সিনেমাটি বানিয়েছিলেন তিনি। ববিতা, ফারুক, আনোয়ারা, রওশন জামিল, আনোয়ার হোসেন, আব্দুল্লাহ আল–মামুন, তারানা হালিম, রোজী আফসারী, এ টি এম শামসুজ্জামান অভিনীত ছবিটি সেই সময় দারুণ ব্যবসাসফল হয়। সঙ্গে কালজয়ী ছবি হিসেবেও স্থান করে নেয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে। ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ সেই সময় ১১টি শাখায় পুরস্কার পেয়ে ভীষণ আলোচিত হয়, পরিচালক নিজেই পাঁচটি পুরস্কার পেয়ে চমকে দেন।
‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ ও ‘ভাত দে’ চলচ্চিত্রের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ পরিচালক হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। শিল্পকলায় অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান একুশে পদক (১৯৯৩) ও স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করেছে। এ ছাড়া সাহিত্য রচনার জন্য তিনি ১৯৯৩ ও ১৯৯৪ সালে দুবার অগ্রণী শিশু সাহিত্য পুরস্কার ও ২০০৪ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন।
চলচ্চিত্র–সংশ্লিষ্ট অনেকের মতে, বাংলাদেশের চলচ্চিত্রশিল্পে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের সঙ্গে গ্রামের যোগাযোগটা অতটা গভীর নয়। কিন্তু আমজাদ গ্রামের মানুষকে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে জানতেন, যার জন্য চলচ্চিত্রে তাঁর চরিত্রগুলো জীবন্ত হয়ে উঠেছে। তাঁর দেখার ভঙ্গিটা ছিল অন্যদের থেকে আলাদা, ছবিগুলোতেও তাঁর স্বাতন্ত্র্যের ছাপ স্পষ্ট। তাঁর অনেক ছবিতে লোকজ সংগীতকে ভেঙে আধুনিকীকরণ করা হয়েছে, যা অনেক বড় কাজ বলে মনে করেন অনেকেই। ওই সময় বলিউডের ছবি ও ছবির গান নকলের প্রবণতা ছিল। তার বিপরীতে দাঁড়িয়ে আমজাদ দেশজ গানগুলোকে আধুনিকায়ন করে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন, যেগুলো আজও গাওয়া হয়। তিনি খুব বড় মাপের গীতিকারও ছিলেন। যখন শুধু বিটিভি ছিল, তখন তাঁর নাটক ছাড়া ঈদ হতো না।
অসাধারণ সব চলচ্চিত্র উপহার দিয়ে আমজাদ হোসেন বাংলা চলচ্চিত্রকে করে গেছেন সমৃদ্ধ। তাঁর পরিচালনায় অভিনয় করে কয়েকজন অভিনয়শিল্পী নিজেদের অনন্য করে তুলেছেন। জন্মদিনে তাই আমজাদ হোসেনকে নিয়ে কথা বলতে গিয়ে তাঁর দুই ছবি ‘গোলাপী এখন বিলাতে’ ও ‘আদরের সন্তান’–এর অভিনয়শিল্পী মৌসুমী বললেন, ‘আমজাদ হোসেন আমাদের চেয়ে অনেক বড়। ঘনিষ্ঠভাবে মেশার সুযোগ হয়নি। এরপরও বন্ধুত্বসুলভ ব্যবহার করতেন। কাজের ক্ষেত্রে দূরদর্শিতা তাঁর লেখার মতোই ছিল। একবার ‘গোলাপী এখন বিলাতে’ ছবির শুটিং করার সিদ্ধান্ত হয় কমলাপুর রেলস্টেশনে। আমি স্টেশনে না গিয়ে কীভাবে কাজটি করা যায়, সে চিন্তা করছিলাম। কিন্তু আমজাদ ভাই এমনভাবে বলেন যে আর না করতে পারিনি। তবে মোটেও জোর করেননি। ধমকও দিতেন না। শিল্পীর মন বুঝতে পারতেন। কমলাপুর রেলস্টেশনে মেইল ট্রেনে আমাদের শুটিং শুরু হয়। ক্যামেরাম্যান জেড এইচ মিন্টু ভাই আমার গাড়িটি ময়মনসিংহ নিয়ে আসতে বলেছিলেন। এক দিনের শুটিং চার দিনে শেষ হয়েছিল। এরপরে ঢাকায় ফিরি।’
মানিকগঞ্জের নদীর তীরবর্তী এক গ্রামে ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ সিনেমার শুটিং হচ্ছিল। সেখানে সারা দিন অপেক্ষায় ছিলেন ববিতা। অন্য শিল্পীরা শুটিংয়ে অংশগ্রহণ করলেও ববিতার ডাক আসে না। যখন ডাক আসে, তখন রাত দুইটা। কনকনে শীতের মধ্যে ওই রাতে আনন্দচিত্তেই সংলাপ দিতে দাঁড়িয়েছিলেন ববিতা। ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’, ‘নয়নমনি’, ‘সুন্দরী’, ‘কসাই’, ‘বড় বাড়ির মেয়ে’ ছবির কথা তুলে ববিতা বলেন, ‘আমজাদ হোসেন বাংলাদেশে একজনই। তাঁর অনেক ছবিতে অভিনয় করেছি। তাঁর অনেক ছবি মাইলস্টোন হয়ে আছে। গ্রামবাংলাকে তিনি ছবির মাধ্যমে সবার কাছে তুলে ধরেছেন। কাজের ধারা “অদ্ভুত সুন্দর”। তাঁর ছবিতে যে শিল্পীরা কাজ করতেন, সবাই বেশ তৃপ্তি পেতেন। এমন হতো, একটি দৃশ্যের শুটিং হবে। সকাল থেকে বসে আছি। সন্ধ্যায় তিনি তা ধারণ করলেন। আমরা মোটেও বিরক্ত হতাম না। তবে কোনো কিছু তিনি চাপিয়েও দিতেন না।’
লেখালেখি, অভিনয় এবং চলচ্চিত্র নির্মাণ—প্রত্যেক ক্ষেত্রেই তিনি সাফল্যের পরিচয় রেখেছেন এবং বাংলাদেশের অন্যতম কিংবদন্তি রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন তিনি। ফারুকের মতো করে বলতে হয়, ‘একজন আমজাদ হোসেন আমাদের বাঙালি জাতির অহংকার, আমাদের চলচ্চিত্রের গর্ব, প্রবীণ শিল্পীদের অহংকার। একজন আমজাদ হোসেন নিজেই একটি ইন্ডাস্ট্রি, যাকে নিয়ে নতুন প্রজন্ম গবেষণা করলে হয়তো নিজেদের মেধার বিকাশে তা কাজে লাগাতে সক্ষম হবেন। সৃষ্টিশীল এই মানুষটি চলচ্চিত্রের জন্য কতটা গৌরবের, তা সত্যিই অকল্পনীয়।’