ধুঁকতে থাকা ঢাকাই সিনেমায় কাজ হারিয়ে নাটকে টুকটাক অভিনয় করে টেনেটুনে সংসার সামলাচ্ছিলেন একসময়ের জনপ্রিয় অভিনেত্রী রঞ্জিতা। জীবনসংগ্রামে টানাপোড়েনের মধ্যেই সপ্তাহখানেক আগে বেঁকে বসেছে তাঁর শরীর, জেঁকে ধরেছে একের পর এক রোগ। প্রথমে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ, পরে শরীরের বাঁ অংশ পক্ষাঘাতগ্রস্ত হওয়ায় চলাফেরার সক্ষমতা হারিয়েছেন তিনি।
ঢাকার মুগদা জেনারেল হাসপাতালে সপ্তাহখানেক ধরে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন রঞ্জিতা। শিল্পী সমিতি ও কয়েকজন সহকর্মীর আর্থিক সহায়তায় চিকিৎসার ব্যয়ভার সামলালেও এখন আর পারছেন না তিনি। বাধ্য হয়ে শুক্রবার রাতে হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরেছেন রঞ্জিতা।
প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার কাছে এখন আর চিকিৎসা করানোর মতো কোনো টাকা নেই। সহযোগিতা পেলে চিকিৎসা হবে, না পেলে ওপারে চলে যাব।’
চিকিৎসকেরা তাঁকে আগামী তিন মাস ওষুধ ও ফিজিওথেরাপি চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। তবে তা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে কি না, এ নিয়ে শঙ্কায় দিন কাটছে তাঁর।
চিকিৎসার ব্যয়ভার সামলাতে হিমশিমের মধ্যে খাওয়া-পরা নিয়েও চিন্তায় আছেন রঞ্জিতা। হাত-পা না চালালে দুই বেলা রুটিরুজির সংস্থান হয় না তাঁর, তার ওপর চলাচলের সক্ষমতা হারিয়ে চোখে অন্ধকার দেখছেন তিনি।
আশির দশকের শেষ ভাগে নায়করাজ রাজ্জাকের পরিচালনায় ‘ঢাকা ৮৬’ সিনেমায় বাপ্পারাজের নায়িকা হয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন রঞ্জিতা, প্রথম সিনেমা দিয়েই পাদপ্রদীপের আলোয় আসেন তিনি। সিনেমার ‘পাথরের পৃথিবীতে কাচের হৃদয়’ গানে ঠোঁট মিলিয়ে আলোচিত হয়েছিলেন তিনি।
রঞ্জিতা জানান, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি, অভিনেত্রী অরুণা বিশ্বাস, রত্না ও শাহনূর তাঁকে চিকিৎসার জন্য আর্থিক সহায়তা করেছেন। তবে সেই অর্থ চিকিৎসায় ব্যয় করা হয়েছে, হাতে আর কোনো অর্থ না থাকায় হাসপাতাল ছাড়তে হয়েছে তাঁকে। ‘নানা পরীক্ষা ও ফিজিওথেরাপিতে টাকা লাগছে। যে টাকা পেয়েছিলাম, সেটা শেষ। চিকিৎসার বিল বাকি থাকছে, তাই হাসপাতাল ছেড়ে চলে এলাম,’ বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়লেন রঞ্জিতা।
রঞ্জিতার চলচ্চিত্রের ক্যারিয়ার প্রথম দিকে ঝলমলে ছিল, প্রথম সিনেমায় নজর কাড়ার পর নায়করাজের পরিচালনায় ‘রাজা মিস্ত্রী’ ও ‘জ্বীনের বাদশা’ সিনেমায় অভিনয় করেন। প্রায় ৩০টি সিনেমার এ অভিনেত্রীকে ২০০৫ সালের পর আর সিনেমায় পাওয়া যায়নি।
শারীরিক প্রতিবন্ধী ভাইকে নিয়ে ঢাকার বনশ্রীর বাসায় ভাড়া থাকেন রঞ্জিতা। রঞ্জিতার ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। মধ্যে করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে তাঁদের অর্থকষ্ট বেড়েছে। নিয়মিত বাসাভাড়া পরিশোধ করতে পারেন না।
হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরলেও কত দিন থাকতে পারবেন, সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাননি রঞ্জিতা। তিনি বলেন, ‘টুকটাক কাজ করতাম, সেটা দিয়েই চলতাম। এখন জানি না বাসা ভাড়া দিতে পারব কি না। আমার গন্তব্য কবরস্থান হবে কি না, তা-ও জানি না।’
সিনেমার নায়িকা রঞ্জিতার জীবন অনেকটা ট্র্যাজিক সিনেমার মতো। তাঁর বাবা ছিলেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। পাশাপাশি তাঁদের নানা রকম ব্যবসা ছিল। রঞ্জিতার বোনের স্বামী ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে শোধ করতে পারেননি। তাঁদের বাড়ি নিলামে ওঠে। সে খবর শুনে রঞ্জিতার মা স্ট্রোক করে মারা যান। এর মধ্যে ভাই সংগীতশিল্পী জুয়েলও মারা যান।
হারানো বাড়ি ফিরে পেতে সরকারের সহযোগিতার অনুরোধ করেছেন এ অভিনেত্রী। সেই বাসা ভাড়া দিয়েই বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে পারবেন বলে আশা করছেন তিনি। তবু তিনি বারবার মানুষের কাছে হাত পাততে চান না। রঞ্জিতা অভিনয়ের পাশাপাশি ছবি প্রযোজনা করতেন। তিনি ১৮টি ছবি প্রযোজনা করেছেন। যার মধ্যে রয়েছে ‘কুংফু কন্যা’, ‘মরণ লড়াই’, ‘ক্যারাটি মাস্টার’, ‘প্রেমিক রংবাজ’ ইত্যাদি।