সেন্সর বোর্ড থেকে বিতর্কিতদের বাদ দেওয়া হবে

রায়হান রাফী পরিচালিত ‘অমীমাংসিত’ চলচ্চিত্রটি সেন্সর বোর্ডে আটকে আছে। ছবি: প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান

শেষ গত ২৮ জুলাই তানভীর হাসানের ‘মধ্যবিত্ত’ ছবিটিকে চূড়ান্ত সেন্সর সনদ দেয় বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড। তার পর থেকে আর কোনো ছবি দেখছে না বোর্ড। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ বিভাগ গতকাল বুধবার জানিয়েছে, সেন্সর বোর্ডের আগের কমিটির বিতর্কিত ব্যক্তিদের বাদ দেওয়া হবে। একটা জাতীয় পরামর্শক কমিটি হবে। তাদের পরামর্শে নতুন কমিটি গঠন করা হবে। এর কার্যক্রম চলমান আছে। পুনর্গঠনের পরই নতুন করে ছবির প্রিভিউ শুরু হবে।
৫ আগস্ট ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হলে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে রদবদল হচ্ছে; সেই ধারাবাহিকতায় সেন্সর বোর্ডের কমিটিতে আসছে পরিবর্তন। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের পুনর্গঠন হতে যাচ্ছে। আগামী সপ্তাহে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় থেকে এমন একটি নির্দেশনা আসতে পারে। সেন্সর বোর্ডের একটি সূত্র প্রথম আলোকে খবরটি নিশ্চিত করেছে।

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সচিব ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে প্রথম বৈঠকেও এমন ইঙ্গিত দিয়েছিলেন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম। বৈঠকে সে সময় বলা হয়েছিল, চলচ্চিত্রের স্বার্থে এফডিসি, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড নতুনভাবে সাজানো হবে। সেটি নিয়ে তাঁরা ভাবছেন।

বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড

সেন্সর বোর্ড পুনর্গঠনের ব্যাপারটি এখনো জানেন না বর্তমান বোর্ডের অন্যতম সদস্য পরিচালক কাজী হায়াৎ। তিনি গতকাল দুপুরে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত মাসের শেষের দিকে মধ্যবিত্তর পর আর কোনো ছবি দেখা হয়নি। আমিও সেভাবে সেখানে যাইনি। শুধু একদিন একটি বিলে স্বাক্ষর করতে গিয়েছিলাম। সেন্সর বোর্ড থেকে আমাকে কিছুই জানায়নি। জানতে ইচ্ছুকও নই।’ তবে এই নির্মাতারও ধারণা, দ্রুতই সেন্সর বোর্ড নতুন করে গঠিত হবে। তাঁর ভাষ্য, ‘সরকারের পরিবর্তন হয়েছে। চারপাশের পরিস্থিতি দেখে বোঝাই যাচ্ছে যে এখানেও পরিবর্তন হবে। তবে এ ব্যাপারে আমাকে কিছু বলেনি। এটি আমার ধারণা থেকে বলছি।’

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ও সচিবের নেতৃত্বে একটি মিটিং হয়েছিল, সেখানে তাঁরা বলেছিলেন, চলচ্চিত্রকে এগিয়ে নিতে প্রয়োজনে এফডিসি ও সেন্সর বোর্ডকে নতুন করে সাজানো যেতে পারে। সিনেমার ভালোর স্বার্থে যা করার, তাঁরা করবেন। যতটুকু জানি, এটা নিয়ে তাঁরা কাজ করছেন। পুনর্গঠনের নির্দেশনা সেখান থেকেই আসবে।
আবদুল জলিল, ভাইস চেয়ারম্যান সেন্সর বোর্ড

কাজী হায়াৎ মনে করেন, অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ই সেন্সর বোর্ডকে দলবাজি মুক্ত করার ভালো সুযোগ। চলচ্চিত্র যাঁরা ভালো বোঝেন, সমাজের বিবেকবানদের নিয়ে দল–মতের ঊর্ধ্বে থেকে সেন্সর বোর্ডটি সাজানো যেতে পারে বলেও মত দেন তিনি।
সেন্সর বোর্ডের পুনর্গঠন কখন হচ্ছে, তা এখনো জানেন না বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল জলিল। তিনি বলেন, ‘এটি তো তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ও সচিব সিদ্ধান্ত নেবেন। তবে এটুকু জানি যে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ও সচিবের নেতৃত্বে একটি মিটিং হয়েছিল, সেখানে তাঁরা বলেছিলেন, চলচ্চিত্রকে এগিয়ে নিতে প্রয়োজনে এফডিসি ও সেন্সর বোর্ডকে নতুন করে সাজানো যেতে পারে। সিনেমার ভালোর স্বার্থে যা করার, তাঁরা করবেন। যতটুকু জানি, এটা নিয়ে তাঁরা কাজ করছেন। তবে কাজটি কতটুকু এগিয়েছে, তা জানি না। পুনর্গঠনের নির্দেশনা সেখান থেকেই আসবে।’

কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর সেন্সর বোর্ড নতুন কোনো সিনেমা দেখছে না। মন্ত্রণালয় থেকে এ ব্যাপারে কোনো নির্দেশনা আছে কি? জানতে চাইলে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘না এ ব্যাপারে কোনো নির্দেশনা নেই। নতুন সরকার আসার পর ছবিও জমা পড়ছে না। এখন কেবল বিপ্লব হায়দারের ভয়াল ছবিটি সেন্সর বোর্ডে জমা আছে। ১ আগস্ট ছবিটি জমা পড়ে।’

সেন্সর বোর্ডের আরেক সদস্য খোরশেদ আলম বলেন, ‘আমি যতটুকু জানি, সেন্সর বোর্ডের পুনর্গঠন না হওয়া পর্যন্ত আর ছবি দেখা হবে না। যতটুকু শুনেছি, এক সপ্তাহের মধ্যেই পুনর্গঠন হয়ে নতুন কমিটি আসতে পারে। এবার বোর্ডে চমক হিসেবে বেশ কয়েকজন তরুণ জনপ্রিয় নির্মাতা থাকতে পারেন।’

নির্মাতা রায়হান রাফী বলেন, ‘সেন্সর বোর্ড পুনর্গঠনে এবার যেন স্বচ্ছ মানুষ থাকেন। আমাদের এখানে সব ধরনের সিনেমা তৈরি হয়। তাই এই জায়গায় বিচার–বিশ্লেষণের জন্য যেন সব ঘরানার মানুষ থাকেন। অনেক সময় হয় কি, বাণিজ্যিক সিনেমার মানুষ, একটি আর্ট ঘরানার ছবি দেখতে বসে ভালো লাগে না। তাহলে কি ওই ছবি বাদ দিতে হবে? আর এ জন্যই সিনেমা বোঝেন—এমন সব ঘরানার মানুষ এই জায়গায় থাকতে হবে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনের সিনেমার সঙ্গে যাঁদের পরিচয় আছে, নিয়মিত দেখেন, এমন মানুষ চাই আমরা।’ তাঁর মতে, ‘সেন্সর বোর্ড শুধু সিনেমার বিচার-বিশ্লেষণের জায়গা নয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কী ধরনের সিনেমা চলছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের এখানে কী ধরনের সিনেমা তৈরি হবে, তার বিশ্লেষণও করতে হবে।’

বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের পুনর্গঠনে বেশির ভাগ সমসাময়িক নির্মাতা ও চলচ্চিত্র–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন, অবশ্যই বোর্ডকে যুগোপযোগী করতে হবে। অর্থাৎ, বৈশ্বিক আদর্শ মেনে সার্টিফিকেশন, এটি নির্ধারণ করবে কোন কনটেন্ট কোন বয়সের মানুষ দেখবে। এটা পুরো দুনিয়ায় অনুসরণ করা হয়। তাঁদের মতে, পৃথিবীর কোথাও সেন্সর বোর্ড নেই। সেন্সর বোর্ড ঠিক করে দিতে পারে না দর্শকেরা কী দেখবে আর কী দেখবে না। বিভিন্ন দেশে সার্টিফিকেশন বোর্ড আছে। সার্টিফেকশন বোর্ড থেকে সিনেমার গ্রেডিং দিয়ে দেওয়া হয়, আমাদের এখানেও সেই চর্চাই হওয়া উচিত। সার্টিফিকেশন বোর্ড ঠিক করবে, কোন সিনেমা কোন বয়সের উপযুক্ত।