নায়ক সোহেল রানার ৫২ বছরের চলচ্চিত্র জীবনে দেখা ভালো মানুষ শফি বিক্রমপুরী
অভিনেতা, পরিচালক ও প্রযোজক মাসুদ পারভেজ, যাঁর পরিচিতি সোহেল রানা নামে। ৭৭ বছর বয়সী এই অভিনেতা এখন আর অভিনয় করেন না। শরীরে বেঁধেছে নানা অসুখ–বিসুখ। তাই কখনো হাসপাতাল আর বাকি সময়টা বাসাতেই কাটে তাঁর। চলচ্চিত্রে কাজ করতে গিয়ে অনেকের সঙ্গে তাঁর পারিবারিক সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। কেউ হয়েছেন বন্ধু, কেউবা স্বজন ও শুভাকাঙ্ক্ষী। দেশের চলচ্চিত্রের এই অভিনেতা, পরিচালক ও প্রযোজক তাঁর দীর্ঘ চলচ্চিত্র জীবনে তিনি এমন একজন মানুষের দেখা পেয়েছেন, যাঁকে তিনি ভালো মানুষ হিসেবে মনে করছেন। একমাত্র ভালো মানুষ মনে করছেন। তিনি কোনো নায়িকা কিংবা নায়ক নন। তাহলে কে? তিনি আর কেউ নন, চলচ্চিত্র প্রযোজক শফি বিক্রমপুরী।
আজ বুধবার সকালে শফি বিক্রমপুরী পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছেন। বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের নির্মাতা, প্রযোজক ও পরিবেশক শফি বিক্রমপুরী ব্যাংককের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আজ ভোরে মারা যান। শফি বিক্রমপুরীর মৃত্যুর খবর শুনে নিজের ফেসবুকে সোহেল রানা লিখেছেন, ‘না ফেরার দেশে চলে গেল শফি বিক্রমপুরী। ৫২ বছরের চলচ্চিত্রে দেখা মানুষের মধ্যে ও ছিল একমাত্র ভালো মানুষ। আল্লাহ তোমাকে বেহেস্ত নসিব করুন।’
সোহেল রানার সঙ্গে বয়সের তারতম্য থাকলেও দুজনের সঙ্গে সম্পর্কটা ছিল খুবই চমৎকার। অনেকটা বন্ধুর মতো। এটাকে সোহেল রানা এভাবেও বললেন, হি ওয়াজ পার্ট অব মাই হার্ট। কী কী কারণে সোহেল রানার দৃষ্টিতে ৫২ বছরের দৃষ্টিতে চলচ্চিত্রে একমাত্র ভালো মানুষ, তা জানতে যোগাযোগ করা হয় তাঁর সঙ্গে।
প্রথম আলোকে আজ বুধবার দুপুরে বললেন, ‘ভালো মানুষ অনেকে আছে। কিন্তু শফি বিক্রমপুরী হচ্ছে বেস্ট। চা–সিগারেট কিন্তু অনেকে খায়। যারা খায় তারা খারাপ, তা বলছি না। আমাদের এই অঙ্গনে চা–সিগারেট খাওয়াটা যেন খুবই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। কিন্তু এত বছরের জীবনে কোনো দিন শফি বিক্রমপুরীকে চা–সিগারেট খেতে দেখিনি। মদ কোনো দিন ছুঁয়েও দেখেনি। মানুষের সঙ্গে উচ্চকণ্ঠে কখনো কথা বলতে শুনিনি। তার কথা শুনতে হলে কাছে গিয়ে শুনতে হতো। প্রভাব খাটাতেও দেখিনি। প্রযোজক–পরিচালক হিসেবে জোর খাটানো, নিজেদের বাহাদুর ভাবাতেও দেখিনি। ৫২ বছরের সম্পর্কের জীবনে কারও সঙ্গে ঝগড়া হতে দেখিনি। কারও ক্ষতি করেছে, এই ৫২ বছরে এমন কাউকে খুঁজেও পাইনি। বরং বাংলাদেশ চলচ্চিত্র জগতে শিল্পী–কলাকুশলী তার কাছে গিয়ে কোনো সাহায্য–সহযোগিতা চেয়ে ফিরে এসেছে, এমন নজিরও নেই।’
কথায় কথায় সোহেল রানা জানালেন, কারও কোনো সহযোগিতা করলেও কখনো প্রচারণা করতেন না শফি বিক্রমপুরী। বললেন, ‘প্রচারবিমুখ হয়ে এভাবে সাহায্য–সহযোগিতা করা এমন কাউকে আমার জীবনে দেখিনি। একসঙ্গে কাজ করেছি, ব্যক্তিগতভাবে আমাকে খুব সম্মান করত। বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের সুপার ডুপার হিট যত চলচ্চিত্র আছে, তার ৮০ ভাগ যমুনা ফিল্মসের। অনেক সময় একজন প্রযোজকের অনেক দুর্নাম থাকে, ছবি বানানোর সময় অনেকর প্রভাব খাটায়। এটা চায়, ওটা চায়—নিজেদের অনেক বাহাদুর ভাবাতে চায়। এটা কখনো আমি শফি বিক্রমপুরীর মধ্যে দেখিনি। আমার শুটিংয়ের বাইরে অন্য কোনো শুটিং সেটে না গেলেও শফি বিক্রমপুরীর সেটে যেতাম। যমুনা ফিল্মসের বেশির ভাগ ছবিতে কাজ করেছে ওয়াসিম। সব সময় হাসিখুশি থাকতেন, প্রাঞ্জল হাসি যাকে বলে।’
সাধারণ প্রযোজক–পরিচালকদের নায়িকাদের নিয়ে নানা ধরনের গুঞ্জন হতো। কিন্তু এত বড় বড় ছবি বানানোর পরও তাঁকে নিয়ে কোনো দিন কোনো গুঞ্জন হয়নি। আজ পর্যন্ত হয়নি বলে জানালেন সোহেল রানা। তিনি বলেন, ‘সব নায়িকারাই তাঁকে হয় আপন রক্তের বড় ভাই মনে করতেন, না হয় পিতৃতুল্য একজন মনে করতেন। এটা অকল্পনীয় ব্যাপার। শফির গুণের কথা বলে শেষ করা যাবে না। অনেকে আমাদের বলেন, সোহেল রানা একজন ভালো লোক, কিন্তু তারপরও আমাদের নিয়ে কিছু গুঞ্জন হয়েছে। কিন্তু ওকে নিয়ে কোনো দিন কোনো গুঞ্জন হয়নি।’
শফি বিক্রমপুরীর পুরো নাম শফিউর রহমান। শফি বিক্রমপুরী নামে চলচ্চিত্র পরিচালনা ও প্রযোজনা করেছেন তিনি। ১৯৪২ সালের ১৫ জানুয়ারি বিক্রমপুরে জন্ম হয় তাঁর। শফি বিক্রমপুরী ১৯৭৮ সালে প্রথম ‘রাজদুলারি’ ছবি পরিচালনা করেন। এরপর ‘আলাদিন আলিবাবা সিন্দাবাদ’, ‘দেনমোহর’সহ কয়েকটি ছবি পরিচালনা করেন শফি বিক্রমপুরী। তাঁর প্রযোজিত ও পরিবেশিত সিনেমার মধ্যে রয়েছে ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’, ‘ডাকু মনসুর’, ‘বাহাদুর’, ‘বন্দুক’, ‘সবুজ সাথী’।
শফি বিক্রমপুরী স্ত্রী নাসিমা সুলতানা, ছেলে হাফিজুর রহমান ও মেয়ে যমুনাকে রেখে যান। মেয়ের নামে তিনি যমুনা ফিল্মস লিমিটেড প্রতিষ্ঠা করেন। পাশাপাশি রাজনীতিতেও সক্রিয় ছিলেন শফি বিক্রমপুরী।