সালমান, মৌসুমীসহ অনেক বড় তারকার শুরু সোহানের হাত ধরে
পর্দায় মূলত ভালোবাসার গল্পই বলেছেন তিনি। ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’, ‘আমার ঘর আমার বেহেশত’, ‘অনন্ত ভালোবাসা’—তাঁর সিনেমায় রোমান্টিক আবেদন ছুঁয়ে গেছে নব্বইয়ের তরুণদের। জনপ্রিয় হিন্দি সিনেমার কয়েকটি রিমেকও করেছেন তিনি। তবে সেসব রিমেকে ছিল বাড়তি কিছু, মূল গল্প ঠিক রেখে সিনেমাগুলোতে যেভাবে দেশি মসলা যোগ করেছেন, তাতে পরিচালক হিসেবে তাঁর দক্ষতার ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠত। ঢাকাই চলচ্চিত্রের রোমান্টিক সিনেমা নির্মাতাদের অন্যতম সোহানুর রহমান সোহান চিরকালের মতো বিদায় নিয়েছেন গত বছরের ঠিক এই দিনে, ১৩ সেপ্টেম্বর। এ সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৪ বছর।
সেদিন ছিল বুধবার। বিকেলে উত্তরার বাসায় ঘুমিয়ে ছিলেন সোহান। অনেক ডাকাডাকি করেও তাঁর সাড়া পাননি গৃহকর্মী। পরে অচেতন অবস্থায় সন্ধ্যা ৬টা ৪৪ মিনিটে উত্তরা ক্রিসেন্ট হাসপাতালে নেওয়া হয় তাঁকে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চিকিৎসকেরা জানান, হাসপাতালে নেওয়ার আগে ঘুমের মধ্যেই মৃত্যু হয়েছে সোহানের। তিনি দীর্ঘদিন ধরে ডায়াবেটিসে ভুগছিলেন। তবে সোহানের মৃত্যুর কারণ নিশ্চিত হতে পারেননি চিকিৎসকেরা। তিনি তিন মেয়ে রেখে গেছেন। আগের দিন জীবনসঙ্গীকে হারিয়ে শোকে কাতর ছিলেন ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ নির্মাতা সোহানুর রহমান সোহান।
সোহানের স্ত্রী প্রিয়া রহমান মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে ঠিক আগের দিন অথ্যাৎ মঙ্গলবার সন্ধ্যায় মারা গেছেন। স্ত্রীর মৃত্যুর ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে সোহানও বিদায় নেন। স্ত্রীর কবরের পাশেই তাঁকে সমাহিত করার ইচ্ছা পোষণ করে গেছেন সোহান। তাই পরদিন বৃহস্পতিবার সকালে টাঙ্গাইলের পুরোনো বাসস্ট্যান্ড মসজিদে জানাজা শেষে টাঙ্গাইল কেন্দ্রীয় কবরস্থানে দাফন করা হয় তাঁকে।
সত্তরের দশকের শেষভাগে নির্মাতা শিবলী সাদিকের সহকারী পরিচালক হিসেবে ঢালিউডে আসেন সোহান। ১৯৮৮ সালে ‘বিশ্বাস অবিশ্বাস’ সিনেমা দিয়ে পরিচালনায় নাম লেখান। ১৯৯৩ সালে ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ নির্মাণ করে খ্যাতি পান। চার দশকের ক্যারিয়ারে রোমান্টিক সিনেমা নির্মাণ করে পরিচিতি পেয়েছেন সোহান। ‘অনন্ত ভালোবাসা’, ‘আমার জান আমার প্রাণ’, ‘কোটি টাকার প্রেম’, ‘সে আমার মন কেড়েছে’সহ বহু সিনেমা নির্মাণ করেছেন সোহান। ১৯৫৯ সালের ১৫ অক্টোবর বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার ফুলবাড়ীতে জন্মগ্রহণ করেন সোহান। বগুড়া ও জয়পুরহাটে স্কুল ও কলেজজীবন শেষে ঢাকায় আসেন তিনি।
‘আগাগোড়া সিনেমার মানুষ ছিল’
সোহানুর রহমান সোহান নির্মাতা কাজী হায়াতের চেয়ে বয়সে কিছুটা ছোট হলেও প্রায় একই সময়ে সহকারী হিসেবে সিনেমায় কাজ শুরু করেন তাঁরা। সময়টা সম্ভবত ১৯৭৬ বা ’৭৭ হবে। সোহানের মৃত্যুর পর সেদিন যোগাযোগ করা হয়েছিল পরিচালক কাজী হায়াতের সঙ্গে। কাজী হায়াৎ ফোনে ধরতেই ফিরে গেলেন চার দশক আগে, ‘আমি আলমগীর কুমকুমের “সীমানা পেরিয়ে” দিয়ে কাজ শুরু করি। সোহান তখন শিবলী সাদিকের ছবিতে সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করে। তবে ওর প্রথম সহকারী হিসেবে কাজের সিনেমার কথা আমার মনে নেই। পরে সে এ জে মিন্টুরও সহকারী ছিল। ওই সময়ই আমাদের বেশ সখ্য হয়।’
সোহান সব সময়ই রোমান্টিক, প্রেমের ছবি তৈরি করতে খুব পছন্দ করতেন। কাজী হায়াৎ জানান, ব্যক্তিজীবনেও দারুণ রোমান্টিক মানুষ ছিলেন তিনি। তাঁর মতে, মানুষ হিসেবে রোমান্টিক হওয়ার কারণেই হয়তো রোমান্টিক ছবির প্রতি তাঁর আলাদা ঝোঁক ছিল। সোহানের সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতা স্মরণ করে কাজী হায়াৎ বলেন, ‘তার “কেয়ামত থেকে কেয়ামত” ছবিটি আমার দেখা হয়েছে। যদিও ছবিটি রিমেক ছিল, কিন্তু তার নির্মাণ ছিল কী দারুণ, কী দুর্দান্ত। সে সিদ্ধহস্তে সিনেমা বানাত। সিনেমায় তার হাত খুব পাকা ছিল।’
একটা সময় দুজনের খুব একটা যোগাযোগ ছিল না। কাজী হায়াৎ অসুস্থ হয়ে দুবার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। পরে জেনেছেন, তাঁকে দেখতে দু-এক দিন পরপরই হাসপাতালে যেতেন সোহান, করিডরে দাঁড়িয়ে থাকতেন।
কাজী হায়াৎ বলেন, ‘এসব আমি জানতাম না, আজ (সোহানের মৃত্যুর পর) আমার মেয়ে ও স্ত্রীর কাছে শুনলাম। এ কথা শুনে সোহানের মুখটা ভেসে উঠে বেদনায় ভরে গেল মনটা।’
তাঁর হাত ধরে শুরু
তাঁর সিনেমা ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ দিয়েই চলচ্চিত্রে অভিনয় হয় মৌসুমী ও সালমান শাহর। কেবল এই দুই তারকাই নন, ঢাকাই সিনেমার অনেক বড় তারকারও অভিষেক হয় সোহানুর রহমান সোহানের হাত ধরে। ১৯৯৭ সালে তাঁর সিনেমা ‘আমার ঘর আমার বেহেশত’ দিয়ে রুপালি পর্দায় যাত্রা শুরু করেন শাকিল খান। ১৯৯৮ সালে ‘অনন্ত ভালোবাসা’ দিয়ে বড় পর্দায় পথচলা শুরু হয় এই সময়ে বাংলা সিনেমার অন্যতম শীর্ষ তারকা শাকিব খানের। সিনেমাটিতে তাঁর নায়িকা ছিলেন মৌসুমীর ছোট বোন ইরিন জামান। এটি ছিল ইরিনেরও প্রথম সিনেমা।