ফিরে এসেই বাজিমাত তাঁদের
তাঁরা কেউ গানে, কেউ অভিনয়ে; একটা সময় কাজে নিয়মিত ছিলেন। তবে নানা কারণেই বিরতি পড়েছিল, পরিবার ও ব্যবসায়িক কারণে কেউ ছিলেন প্রবাসে। কারও দূরে থাকার কারণ আবার পারিবারিক। তবে চলতি বছর যখন ফিরেছেন, নিজেদের জাত চিনিয়েছেন। বিরতির পর তাঁদের আলোচিত প্রত্যাবর্তন নিয়ে এই প্রতিবেদন।
সাংবাদিকতা ছেড়ে অভিনয়ে আসা মাহফুজ আহমেদ অভিনয়ে তিন দশকের বেশি সময় পার করেছেন। নাটকের পাশাপাশি চলচ্চিত্র আর বিজ্ঞাপনচিত্রেও কাজ করেছেন। মাঝখানে আট বছর সব ধরনের কাজ থেকে দূরে ছিলেন। চলতি বছরের কোরবানি ঈদে মুক্তি পাওয়া ‘প্রহেলিকা’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করে প্রশংসিত হন। এরপর যুক্ত হন ওয়েব সিরিজেও। অক্টোবরে এসে অদৃশ্য নামের ওয়েব সিরিজ দিয়ে বাজিমাত করেন। মাহফুজ আহমেদকে এর আগে শেষবার ‘জিরো ডিগ্রি’ চলচ্চিত্রে দেখা গিয়েছিল। এরপর আর কোথাও ছিলেন না তিনি। ক্যামেরার সামনেই দাঁড়াননি আট বছর!
তাই ‘প্রহেলিকা’ নিয়ে কিছুটা শঙ্কায় ছিলেন। কী হবে, কীভাবে দর্শক তাঁকে গ্রহণ করবেন—ছিল এসব ভাবনা। তবে ফেরাটা যেমন ভেবেছিলেন, তার চেয়ে বেশি উজ্জ্বলতা ছড়িয়েছে। এই ছবিতে মাহফুজ অভিনয় করেন ‘মনা’ চরিত্রে। চরিত্রটি মানুষের মনে জায়গা করে নিতে বেশি সময় লাগেনি। বিরতির পর ফেরা মাহফুজকে ছবির ‘মেঘের নৌকা’ গানে প্রথম দেখা যায়। টেলিভিশন নাটকের রোমান্টিক বয় এই গানে যেন সেই মুগ্ধতাই ছড়ালেন। ছবিটি মুক্তির পর প্রেক্ষাগৃহের দর্শক যেন বিরতির পর ফেরা মাহফুজকে সাদর বরণ করে নিলেন।
মাহফুজের সমসাময়িক অনেক পরিচালক, প্রযোজক ও শিল্পী ছবিটি দেখে বলেন, মাহফুজের ফিরে আসাটা রাজকীয় হয়েছে। এমন একটা গল্পের ছবি দিয়েই তাঁর ফেরা দরকার ছিল। সবার এমন ভালোবাসা মাথায় তুলে রাখতে চান এই অভিনেতা। তাঁদের সম্মানে আর লম্বা বিরতিতে যেতে চান না বলেও জানান তিনি। সম্প্রতি ঘোষিত হয়েছে, শাবনূরের সঙ্গে নতুন আরেকটি ছবি দিয়ে ফিরতে যাচ্ছেন মাহফুজ।
প্রিন্স মাহমুদ
আশির দশকে ‘দ্য ব্লুজ ব্যান্ড’–এর ভোকাল ও গিটারিস্ট ছিলেন প্রিন্স মাহমুদ। নব্বইয়ের শুরুতে ‘ফ্রম ওয়েস্ট’ নামে একটি ব্যান্ড গড়েন তিনি। সেই ব্যান্ডেও ভোকালিস্ট হিসেবে ছিলেন, তবে গানে তাঁর কণ্ঠ খুব বেশি দিন পাওয়া যায়নি। পরে গানের কথা ও সুরে মন দেন। ‘মা’, ‘বাবা’, ‘জন্মদিন’, ‘বাংলাদেশ’, ‘এত কষ্ট কেন ভালোবাসায়’, ‘বেলা শেষে’, ‘সোনার মেয়ে’, ‘ফেরানো গেল না কিছুতেই’, ‘হয়নি যাবার বেলা’, ‘শেষ দেখা’র মতো গানে পাওয়া গেছে তাঁকে। ‘সে যে এখন আমায় ভালোবাসে না’, ‘মাটি হব মাটি’, ‘দুনিয়া তোর সঙ্গেতে নাই’, ‘ছিপ নৌকো’র মতো জনপ্রিয় গানও করেছেন প্রিন্স মাহমুদ।
আইয়ুব বাচ্চুর ‘বেলা শেষে ফিরে এসে’; জেমসের ‘মা’, ‘বাবা’, ‘বাংলাদেশ’ কিংবা হাসানের ‘এত কষ্ট কেন ভালোবাসায়’, ‘এত দিন পরে প্রশ্ন জাগে’—যেখানে হাত দিয়েছেন, সোনা ফলিয়েছেন প্রিন্স মাহমুদ। নব্বইয়ের প্রজন্মের পাশাপাশি এ প্রজন্মের শ্রোতাদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছেন প্রিন্স মাহমুদ। ক্যারিয়ারের বেশির ভাগ সময় ব্যান্ডের গান করলেও একটা সময় এসে চলচ্চিত্রের গানেও তাঁকে পাওয়া গেছে। ‘জিরো ডিগ্রি’, ‘থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার’, ‘ভয়ংকর সুন্দর’সহ কিছু ছবির জন্য তিনি গান করেছেন। বেশ কয়েক বছর বিরতির পর এ বছর তিনি কাজ করেন হিমেল আশরাফ পরিচালিত প্রিয়তমা সিনেমায়।
এই সিনেমার ‘ঈশ্বর’ গানটি সব শ্রেণির শ্রোতার কাছে তাঁকে নতুন করে আলোচনায় এনেছে। তরুণ গায়ক রিয়াদের গাওয়া ‘ঈশ্বর’ গানের কথা লিখেছেন সোমেশ্বর অলি। গানটি প্রকাশের পর প্রিন্স মাহমুদকে নিয়ে চলচ্চিত্র প্রযোজক ও পরিচালকদের আগ্রহ বাড়ে। তবে বরাবরের মতোই মানের ক্ষেত্রে আপসহীন প্রিন্স মাহমুদ বুঝেশুনে নতুন একাধিক ছবির কাজ শুরু করেছেন। সংগীত ও চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট সবার মতে, সিনেমার গানে এমন সফলতা এর আগে তিনি পাননি।
তানিয়া আহমেদ
অভিনয়জীবন কয়েক দশকের হলেও এ বছর অভিনয়ের নতুন মাধ্যম ওটিটিতে অভিষেক ঘটে তানিয়া আহমেদের। চরকিতে ‘উনিশ ২০’ দিয়ে যেমন প্রশংসা কুড়িয়েছেন, তেমনি হইচইয়ে মুক্তি পাওয়া ‘বুকের মধ্যে আগুন’ সিরিজ দিয়েও প্রশংসিত হন। তবে ‘বুকের মধ্যে আগুন’–এ তাঁর অভিনীত চরিত্র নিয়ে অনেক দর্শক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মন্তব্য করেন যে তানিয়া আহমেদের চরিত্রটির সঙ্গে সালমান শাহর মায়ের চরিত্রের মিল পেয়েছেন। তানিয়া আহমেদ শুধু বলেন, ‘কাজ দুটি দিয়ে দর্শকের প্রত্যাশা পূরণ করতে পেরেছি, এটাই আমার জন্য সুখবর। কারণ, আমি পকেট ভারী করার জন্য কাজ করি না।’
তানিয়া আহমেদকে সিরিজে দেখা গেছে দুই বয়সের চরিত্রে অভিনয় করতে। তরুণ ও মধ্যবয়স–পরবর্তী সময়টা পর্দায় তুলে ধরেছেন। আর এই দুই চরিত্রেই প্রয়াত অভিনেতা সালমান শাহর মায়ের সঙ্গে মিল খুঁজে পেয়েছেন দর্শক। এ প্রসঙ্গে তানিয়া বলেন, ‘আমি একটি চরিত্রে অভিনয় করেছি। যেখানে চরিত্রের নানা বাঁকবদল, চড়াই–উতরাই ও গভীরতা রয়েছে। এটি একটি ফিকশন। সেখানে লেখক যেভাবে চরিত্রটিকে দেখেছেন, সেটাকেই পর্দায় রূপ দিয়েছি। অন্য কিছু ভাবিনি। তার চেয়ে বরং আমার মেকআপ–গেটআপ এসব নিয়ে ভেবেছি। কীভাবে কাজটি ভালো করা যাবে, সেটা নিয়ে ভেবেছি। যার ফল এখন পাচ্ছি।’
বালাম
২০০৭ সালে গানের অঙ্গনে বালামের ছিল দাপুটে বিচরণ। একের পর এক হিট গান উপহার দিয়েছেন। টানা কয়েক বছর এভাবেই চলতে থাকে। হঠাৎ চেনা ছন্দ হারান তিনি। বেশ কিছুদিন পরপর একটি করে গান প্রকাশ করলেও হিট-সুপারহিটের দেখা পাচ্ছিলেন না তিনি। ভক্তদেরও এ নিয়ে মন খারাপ ছিল। শেষ ২০১৯ সালে ‘তুমি রূপকথায়’ শিরোনামে গান প্রকাশ করলেও আলোচনায় আসেনি। ২০২৩ সালে এসে যেন বালাম তা সুদ-আসলে পুষিয়ে দিলেন। বছরের মাঝামাঝি সময়ে নবজন্ম হয় তাঁর। কারও মতে, বিরতির পর দুর্দান্ত প্রত্যাবর্তন। শিল্পী নিজেও মনে করেন, এর চেয়ে আর অসাধারণভাবে ফিরে আসা যায় না। ‘প্রিয়তমা’ ছবির ‘ও প্রিয়তমা’ শিরোনামের দ্বৈত কণ্ঠের এই গানের মাধ্যমে রাজকীয়ভাবে ফিরে আসেন তিনি।
আসিফ ইকবালের কথা ও আকাশ সেনের সুর–সংগীতে গানটি দ্বৈতভাবে গেয়েছেন বালাম ও কোনাল। গতকাল বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত গানটি অফিশিয়াল ইউটিউব প্ল্যাটফর্মে ১৩০ মিলিয়নের বেশি ভিউ হয়েছে, যা রীতিমতো রেকর্ড। ‘ও প্রিয়তমা’ প্রকাশের পর থেকেই ভক্তরা তাঁকে নিয়ে মেতে ওঠেন। সবার ভালোবাসায় বালামও ছিলেন উচ্ছ্বসিত। স্টেজ শো করতে ছুটে গিয়েছেন এক দেশ থেকে আরেক দেশে। ‘ও প্রিয়তমা’র মুক্তি থেকে একের পর এক চলচ্চিত্রের গানে কণ্ঠ দেওয়ার প্রস্তাব পাচ্ছেন তিনি। গানটির শ্রোতাপ্রিয়তা তাঁকে নতুন গানে কণ্ঠ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে ভাবাচ্ছে।
অপি করিম
জীবনের প্রথম চলচ্চিত্র ‘ব্যাচেলর’–এ অপি করিম যখন অভিনয় করেন, সময়টা ২০০৪ সাল। টিভি নাটকে নিয়মিত অভিনয় চলতে থাকে। একটা সময় এসে নাটকে অভিনয় কমিয়ে দেন। কয়েক বছর ধরে কাজ যেহেতু কম করছেন, নিজের আর্কিটেকচার ফার্মে সময় দিচ্ছেন। এর বাইরে যে সময় পান, পরিবারকে দেন। বই পড়েন, ওটিটির কনটেন্ট দেখেন। এ বছর তাঁকে মঞ্চেও দেখা গেছে। নন্দিত এ অভিনয়শিল্পীকে এ বছরই দ্বিতীয়বারের মতো চলচ্চিত্রের পর্দায় দেখা গেল। বাংলাদেশ-ভারত যৌথ প্রযোজনার ছবি ‘মায়ার জঞ্জাল’ পরিচালনা করেন ইন্দ্রনীল রায় চৌধুরী।
হন প্রশংসিত। দ্বিতীয় ছবিতে অভিনয় করতে এতটা সময় কেন নিলেন, সে প্রসঙ্গে অপি বলেন, সে রকম কোনো চিত্রনাট্য পাননি। যা–ও পেয়েছেন, সময়ের কারণে করা হয়নি। পড়ালেখা, শিক্ষকতায় সময় দিয়েছেন। এ বছর অদৃশ্য নামের একটি ওয়েব সিরিজে দেখা গেছে তাঁকে।
অদৃশ্য দিয়ে মাহফুজের সঙ্গে প্রথমবার ওয়েব সিরিজে জুটি হয়েছেন অপি করিম। এর আগে হইচইয়ের ‘ঢাকা মেট্রো’ সিরিজে দেখা গেছে অপিকে। তিনি বলেন, ‘এই সিরিজে বেশ কয়েকজন প্রতিভাবান অভিনেতা রয়েছেন, যাঁদের আমি খুব পছন্দ করি। এটা নিঃসন্দেহে সম্মানের বিষয়। আমি আশা করছি, দর্শক শেষ পর্যন্ত সিরিজটি উপভোগ করবেন।’
তানজিকা আমিন
২০০৪ সালের লাক্স আনন্দধারা মিস ফটোজেনিক প্রতিযোগিতায় প্রথম রানারআপ হন তানজিকা আমিন। ১৯ বছরের অভিনয়জীবনে কাজের সংখ্যা তুলনামূলক কম। পেশাদার অভিনয়শিল্পী হিসেবে অনেক নাটকে অভিনয় করেছেন। কিন্তু নিজেকে প্রমাণের সুযোগ সেভাবে পাননি। এ বছর যেন জ্বলে উঠলেন। নিজেকে প্রমাণ করলেন। ‘মহানগর ২’ ওয়েব সিরিজে ‘মিতু’ চরিত্রে অভিনয় করে অভিনয়প্রেমীদের মনে জায়গা করে নিয়েছেন তানজিকা। আশফাক নিপুণ পরিচালিত এই সিরিজে তানজিকা আমিন অভিনয় করেছেন দিব্য জ্যোতির বড় বোনের চরিত্রে। সিরিজটি মুক্তির পর সবার ‘আপা’ হয়ে ওঠেন তিনি।
এই অভিনয়শিল্পী বলেন, ‘আমি এখন সবার আপা হয়ে গেছি। ফেসবুক ইনবক্সে অপরিচিত অনেকেই বলছেন, “আপনাকে আমার আপার মতো লাগছে।” তার মানে, মিতু চরিত্রটি সবার মনে ধরেছে। আরও ১০ বছর আগে যদি এভাবে পরিচালকেরা আমাকে নিয়ে ভাবতেন, তাহলে হয়তো বাংলাদেশের দর্শক এ রকম আরও ভালো কাজ পেতেন। আমি শুধু আমার কথা বলছি না, আমার মতো আরও অনেকেই আছেন, যাঁরা সত্যিকার অর্থেই ভালো অভিনয় করেন, তাঁদের বেশি বেশি সুযোগ করে দেওয়া উচিত। তাঁদের নিয়ে ভাবলেই চিত্রটা পাল্টে যেত। আজকে নিপুণ ভাই যদি “মহানগর”-এ আমাকে না ভাবতেন, এভাবে আলোচনায় আসতে পারতাম না। আমাকে নিয়ে কেউ হয়তো কথাও বলতেন না।’