বরবাদ, দাগি ও জংলি— চাহিদা সত্ত্বেও শো বাড়াচ্ছে না সিনেপ্লেক্স
দেশের বড় মাল্টিপ্লেক্স চেইন স্টার সিনেপ্লেক্সে ছয়টি বাংলা সিনেমা মুক্তির মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল এবারের ঈদ উৎসব। এখন দেশের প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শিত হচ্ছে পাঁচটি চলচ্চিত্র। এর মধ্যে তিনটি সিনেমায় দর্শকের আগ্রহ বেশি। প্রেক্ষাগৃহে টিকিটের সংকট দেখা দিয়েছে। কোনো ছবির টিকিট দর্শক দুই দিন আগে কিনে রেখেছেন, আবার কোনোটির এক দিন আগে। বাংলাদেশি সিনেমার এমন দর্শক চাহিদায় মুগ্ধ সংশ্লিষ্ট চলচ্চিত্রের প্রযোজক-পরিচালক ও অভিনয়শিল্পীরা। পাশাপাশি রয়েছে আক্ষেপ, ক্ষোভ ও মনঃকষ্ট। ঈদের ছবির প্রযোজক-পরিচালকদের মতে, সিনেপ্লেক্স কর্তৃপক্ষ তাঁদের সিনেমার যে পরিমাণ প্রদর্শনী দিয়েছে, তা আরও বাড়ালে দর্শকের এই আগ্রহ ঠিকই বাড়বে, কমবে না।
স্টার সিনেপ্লেক্সে এবার ঈদুল ফিতরে মুক্তি পাওয়া ছয়টি সিনেমা হচ্ছে ‘বরবাদ’, ‘দাগি’, ‘জংলি’, ‘চক্কর ৩০২’, ‘অন্তরাত্মা’ ও ‘জ্বীন ৩’। এর মধ্যে শুক্রবার থেকে ‘অন্তরাত্মা’ বাদে বাকি পাঁচটি ছবি প্রদর্শন করছে স্টার সিনেপ্লেক্স কর্তৃপক্ষ। মুক্তির সপ্তম দিনেও এখানে ঈদের সিনেমার প্রায় সব শো-ই হাউসফুল। টিকিট পেতে রীতিমতো হুড়োহুড়ি করছেন দর্শক। অনলাইন থেকে কাউন্টার, মুহূর্তের মধ্যে শেষ হয়ে যাচ্ছে টিকিট। ভোগান্তি এড়াতে অনেকে আগেভাগে টিকিট কেটে রাখছেন। আবার মানুষ টিকিট না পেয়ে বলছেন, হলমালিকেরা শো বাড়ালেই কিন্তু হয়।
ঈদের ছুটি শেষ হয়েছে গতকাল। স্কুল-কলেজ-ব্যাংক-অফিস-আদালত সব খুলেছে। স্টার সিনেপ্লেক্সে যেসব শাখায় বাংলাদেশি ছবি প্রদর্শিত হচ্ছে, সব কটির ফলাফল ভালো। তবে ‘বরবাদ’, ‘দাগি’ ও ‘জংলি’ নিয়ে দর্শকের চাপ অনেক বেশি। স্টার সিনেপ্লেক্সে দর্শকের আগ্রহে থাকা ছবিগুলোর কোনটির কতটি প্রদর্শনী চলছে জানতে চাইলে আজ রোববার বিকেলে প্রতিষ্ঠানটির জ্যেষ্ঠ বিপণন কর্মকর্তা মেজবাহ আহমেদ বলেন, ‘বরবাদ’–এর ৪০টি, ‘দাগি’র ২৬টি ও ‘জংলি’র ৭টি করে প্রদর্শনী চলছে। এ ছাড়া ‘জ্বিন ৩’ ও ‘চক্কর’–এর তিনটি করে প্রদর্শনী চলছে।
‘বরবাদ’ ছবির প্রযোজক রিয়েল এনার্জি প্রোডাকশনের স্বত্বাধিকারী শাহরিন আক্তার আজ দুপুরে বলেন, ‘আমরা একটা ভালো মানের ছবি বানিয়েছি। নির্মাণে যা যা প্রয়োজন সবই করেছি, বিন্দুমাত্র কোথাও আপস করিনি। মুক্তির পর দেখলাম, আমরা ঠিক পথেই ছিলাম। মানুষ আমাদের ছবি দারুণভাবে গ্রহণ করেছেন। তাঁরা বলছেন, এ ধরনের ছবি তাঁরা আগে দেখেননি। কেউ বলছেন, ৩০ বছর পর পরিবার নিয়ে সিনেমা হলে এসেছেন। সিঙ্গেল স্ক্রিন ও মাল্টিপ্লেক্স—সব জায়গায় আমাদের ছবিটির বেশ চাহিদা রয়েছে। দর্শকের চাহিদার কারণে তো ১৫টির বেশি সিনেমা হলে মধ্যরাতেও শো হয়েছে, হলমালিকেরা আমাকে ফোন করে তাঁদের খুশির কথা জানিয়েছেন। স্টার সিনেপ্লেক্সেও চাহিদা অনেক। আমার কাছে প্রতিদিনই খবর আসছে, দুই দিনের টিকিট অগ্রিম সোল্ড আউট। আবার সরাসরি গিয়েও মানুষ টিকিট পাচ্ছে না। এ অবস্থায় শো বাড়ালে যে শুধু আমাদের লাভ, তা কিন্তু নয়। এতে হলমালিকের লাভটাও অনেক। আমি তো মনে করি, “বরবাদ” নিয়ে মানুষের যে আগ্রহ, বর্তমানের ৪০টি শোর সঙ্গে আরও ২০টা শো–ও যদি বাড়ায়, তবু হাউসফুল যাবে।’
কথা প্রসঙ্গে প্রযোজক শাহরিন আক্তার জানান, ‘বরবাদ’ মুক্তির আগে থেকে তিনি নানা প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের এখানে যে সিস্টেম, এতে করে সবারই এই প্রতিকূলতা মোকাবিলা করতে হয়। আমি চাইব, ভবিষ্যতে যেন প্রযোজকেরা এগুলো আর ফেস না করেন। চেষ্টা করব সবাই মিলে এই সিস্টেমের পরিবর্তনের। “বরবাদ” দিয়ে আমরা প্রমাণ করেছি, আমরাও ভালো কিছু বানাতে পারি, দরকার শুধু সহযোগিতা।’
‘দাগি’ সিনেমার প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান এসভিএফ আলফা আই এন্টারটেইনমেন্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহরিয়ার শাকিল প্রথম আলো বলেন, ‘আমাদের প্রথম দিকে শো ছিল ২১টা, পরে তা বাড়িয়েছে। আমি মনে করি, আরও ১০টা শো যদি বাড়ানো হয় তাহলেও হাউসফুল যাবে। আমি দেখছি, ছুটির দিনে সব শো হাউসফুল যাচ্ছে। আজকে সরকারি ছুটি শেষ হওয়ার পরও সব শো হাউসফুল যাচ্ছে। শোর সংখ্যা “বরবাদ” আর আমাদেরই তো বেশি। আমি এটা দেখছি, অবিশ্বাস্য রকম সাড়া। আমরা যে ধরনের গল্পনির্ভর চমৎকার একটা ছবি বানিয়েছি, সেখানে বাণিজ্যিক উপাদানও অবশ্যই আছে এবং সেটার উপস্থাপনও ভিন্ন রকম। সেই জায়গা থেকে এ ধরনের সিনেমা দর্শক গ্রহণ করেছে, দেখছে—এটা তো খুবই আশাব্যাঞ্জক।’
ঈদে মুক্তি পাওয়া বাংলাদেশের ছবি নিয়ে যেখানে মাতামাতি চলছে, সেখানে হলিউডের পুরোনো ছবি প্রদর্শন করছে স্টার সিনেপ্লেক্স। এ বিষয় নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন প্রেক্ষাগৃহে সিনেমা দেখতে আসা দর্শকেরা। চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন গ্রুপেও স্টার সিনেপ্লেক্সের এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে সমালোচনা করেছেন কেউ কেউ। এ বিষয়টি নিয়ে শাহরিয়ার শাকিলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, ‘সিনেপ্লেক্স কর্তৃপক্ষ ভালো বলতে পারবেন, কোন যুক্তিতে তাঁরা এখন হলিউডের ছবি চালাচ্ছেন। তবে আমি বলব, অবশ্যই বাংলাদেশের ছবিগুলোকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত। কমপক্ষে ঈদের প্রথম তিনটা সপ্তাহ তো আমরা চাইতেই পারি। তা ছাড়া ছবিগুলোর দর্শক সাড়াও অভাবনীয়। বিষয়টা তো মোটেও এমন নয়, বাংলা ভাষার ছবিগুলো চলছে না। যদি না চলত তাহলে একটা কথা ছিল। উৎসবের সময়টায় তিনটা সপ্তাহ তো বাংলাদেশের ছবিকে প্রাধান্য দিতে হবে।’
কথা হয় ‘জংলি’ ছবির প্রযোজক ও টাইগার মিডিয়ার কর্ণধার জাহিদ হাসানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আজকের বাস্তবতায় যদি বলি, একমাত্র “বরবাদ” ছাড়া “জংলি”র সব শো হাউসফুল আছে। দর্শকেরা আমার কাছে অভিযোগ করছে। জানতে চাইছে, কীভাবে তারা টিকিট পাবে? এটা ঠিক, একদিকে টিকিটের ক্রাইসিস আমরা উপভোগ করছি। মুখে মুখে এটা ছড়াচ্ছে। কিন্তু আফসোস লাগছে, প্রেক্ষাগৃহে ধারণক্ষমতা আড়াই শ, কিন্তু মানুষ ফেরত যাচ্ছে আড়াই হাজার! সে ক্ষেত্রে আমি মনে করি, স্টার সিনেপ্লেক্সের সাত শাখায় আমাদের ছবিটি তিনটা করে মোট ২১টি শো ডিজার্ভ করে। আমার বাবার ৩৩ বছরের চলচ্চিত্র ব্যবসার অভিজ্ঞতা, আমার ১২ বছরের অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, এত এত মানুষের টিকিটের যে সংকট, এটা কিন্তু ক্ষতিও। তাই দর্শক চাহিদায় থাকার ছবির শো সিনেপ্লেক্সের আরও বাড়ানো উচিত। অন্যদিকে যে ছবিটির সব শো হাউসফুল হচ্ছে না, সেটার শো কমিয়ে দেওয়াও যেতে পারে।’
প্রদর্শনী না বাড়ানো নিয়ে স্টার সিনেপ্লেক্সের জ্যেষ্ঠ বিপণন কর্মকর্তা মেজবাহ আহমেদ বলেন, ‘আমরা আসলে সবাইকে শো দিচ্ছি, যেন সব ধরনের ছবি দর্শক দেখেন। আমাদের এখানে “বরবাদ”, “দাগি” ও “জংলি”—এ তিনটি মুভির দর্শক চাহিদা বেশি। প্রতিটি মুভি হাউসফুল যাচ্ছে। আমাদের হলিউডের কিছু সিনেমাও দিতে হয়। তাই শো বাড়ানো কমানো হয়। হলিউডের সিনেমার গ্লোবাল একটা ব্যাপার থাকে। তবে বাংলা ছবি তো আছে। এটা ঠিক, মুক্তির প্রথম দিন থেকে বাংলা সিনেমার দর্শক বেশি, তাই শো বাড়িয়েছি-কমিয়েছি।’
ঈদে মুক্তি পাওয়া চলচ্চিত্রের প্রযোজক-পরিচালকেরা এমনটাও বলছেন, এখন যেহেতু বাংলাদেশের বাংলা ছবি নিয়ে দর্শকের আগ্রহ তুঙ্গে, এ সময়টায় হলিউড কিংবা বাইরের দেশের ছবির প্রদর্শনী না রেখে দেশের ছবির প্রদর্শনী বাড়ানো যেত। এ বিষয়ে মেজবাহ আহমেদ বলেন, ‘আমরা যেহেতু মাল্টিপ্লেক্স, তাই বৈচিত্র্য রাখতে হয়, তা বাংলা বলি, অন্য ভাষার ছবি—যা–ই বলি। আমরা মনে করি, বাজারে যদিও চাহিদা থাকে, আর তখন যদি সংকট তৈরি হয়—এই চাহিদা আরও বাড়ে। মানুষ যে সিনেমা হলে এসে ফিরে যাচ্ছে, তার মানে তাদের আগ্রহটা ভালোভাবে টের পাওয়া যায়। বিষয়টা মোটেও এমন নয়, তারা সিনেমা দেখবে না। তারা কিন্তু সিনেমা দেখবে। এই যে এসে টিকিট না পেয়ে ফিরে যাচ্ছে, এতে মুখে মুখে মার্কেটিং ভালোই হচ্ছে। অনেক প্রচারণা হচ্ছে। এটা আমাদের ব্যবসায়িক কৌশলও বলতে পারেন। তবে এমনও হচ্ছে, বাংলা সিনেমার চাপে হলিউডের সিনেমা নামিয়েও ফেলছি।’
‘বরবাদ’ সিনেমার প্রযোজক বলছেন, তাঁদের যদি ২০টি শো বাড়ানো হয়, তবু দর্শক হাউসফুল থাকবে। অন্যদিকে ‘দাগি’র প্রযোজক বলছেন, তাঁদের ছবির শো আরও ১০ টি বাড়ালেও হাউসফুল থাকবে। অন্যদিকে ‘জংলি’ সিনেমার প্রযোজক মনে করছেন, তাঁদের ছবিটি স্টার সিনেপ্লেক্সের সাত শাখায় তিনটি করেও যদি শো দেওয়া হয়, তবু হাউসফুল যাবে। এমন প্রসঙ্গ মনে করিয়ে দিলে মেজবাহ আহমেদ বলেন, ‘একটা বিষয় দেখবেন, ক্রাইসিস রাখলে দর্শকের চাহিদা বাড়ে। আমরা অনেকটা ইচ্ছা করে এমনটা করে থাকি। তবে আমরা কিন্তু কোনো হল খালি রাখছি না। অন্য ছবিও দিচ্ছি। আমরা চাইছি, দর্শকের একটা চাপ থাকুক। আজকে ঈদের সপ্তম দিন পর্যন্ত ঈদের সব সিনেমার একটা চাপ আছে। এমনটাই চাইছি আমরাও। আমরা এমনভাবে শো ডিজাইন করছি, যাতে ছবিগুলো দীর্ঘ সময় পর্যন্ত মানুষ দেখে। আমরা আশাবাদী—“বরবাদ”, “দাগি” ও “জংলি” যেভাবে চলছে তাতে দেড় মাসের মতো দর্শকের ভিড় এমনই যাবে। আমাদের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় এমনটা বলতে পারি।’