অভিমান নিয়ে চলেই গেলেন প্রবীর মিত্র
‘কেউ আমার খবর নেয় না। যেন কারোরই খবর নেওয়ার দরকার নেই। শুধু ভাবি, কেউই তো আমার খোঁজখবর নেয় না। আমিও কারও খোঁজখবর নিই না। কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে জীবনটা।’ বছর দুয়েক আগে প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এভাবেই অভিমান ঝরেছিল গুণী অভিনেতা প্রবীর মিত্রর কণ্ঠে।
গতকাল রোববার রাতে যেন অভিমান নিয়েই চলে গেলে তিনি। রাতে গোসল শেষে ফ্রিজার গাড়িতে প্রবীর মিত্রর মরদেহ ধানমন্ডির বাসায় রাখা হয়। আজ সোমবার জোহরের নামাজের পর এফডিসিতে প্রথম জানাজা হবে। দুপুর সাড়ে ১২টায় এফডিসিতে নেওয়া হবে। এরপর চ্যানেল আইয়ে দ্বিতীয় জানাজা শেষে আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হবে খ্যাতিমান এ অভিনেতাকে।
বেশ কিছু শারীরিক জটিলতা ছিল। ১৩ দিন ধরে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। শরীরে অক্সিজেন–স্বল্পতাসহ বেশ কিছু অসুস্থতায় গত ২২ ডিসেম্বর তাঁকে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অবস্থার অবনতি হয় তাঁর।
প্রথম আলোকে তাঁর পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, অভিনেতার উন্নত চিকিৎসার জন্য সরকারের সহায়তা চান তাঁরা। শনিবার সন্ধ্যায় প্রবীর মিত্রর শারীরিক অবস্থা নিয়ে তাঁর ছোট ছেলে সিফাত ইসলামের সঙ্গে প্রথম আলোর প্রতিবেদকের কথা হয়।
সেদিন সিফাত বলেছিলেন, ‘সরকার থেকে শিল্পী সমিতি—আমরা কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছি না। সমিতির মাধ্যমে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছি, কিন্তু সমিতির কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারিনি। আমরা চাই, বিষয়টি রাষ্ট্র দেখুক। তাঁর উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করুক। মেডিকেল বোর্ড গঠন করার সুযোগ থাকলে তা হোক। এই চলচ্চিত্রের জন্য উনি অনেক দিয়েছেন। আমরা চাই, জীবিত থাকা অবস্থায় তিনি সেই সম্মানটা পান।’
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টার বিষয়ে গত শনিবার তিনি বলেন, ‘আজ অঞ্জনা আন্টি মারা গেলেন। তাঁর জানাজায় এফডিসিতে অনেকেই এসেছেন। এমন অনেকের মাধ্যমে শিল্পী সমিতির সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি আমরা। আর বাবার সঙ্গে যাঁদের যোগাযোগ ছিল, তাঁদের অনেকেই দেশের বাইরে, দেশে যাঁরা আছেন, তাঁদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ নেই।’
শেষ পর্যন্ত কারও সঙ্গেই আর যোগাযোগের প্রয়োজন হয়নি। শিল্পীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কারও উপস্থিতি দেখা যায়নি হাসপাতালে। রোববার রাতে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় চিরবিদায় নিলেন শিল্পী। পারিবারিক সূত্র জানায়, গত কয়েক দিন প্রবীর মিত্রর শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা কমতে থাকে। ভেতরে রক্তক্ষরণের সঙ্গে কমতে থাকে প্লাটিলেটও। শনিবার অক্সিজেনের মাত্রা বাড়লেও প্লাটিলেট আরও কমে যায়। তবে রোববার সকাল থেকেই প্লাটিলেটের সঙ্গে অক্সিজেনের মাত্রা কমতে থাকে। কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাসের ব্যবস্থার আগেই এ অভিনেতার মৃত্যু হয়। রাত ১০টা ১০ মিনিটে কর্তব্যরত চিকিৎসকেরা প্রবীর মিত্রকে মৃত ঘোষণা করে।
কয়েক বছর ধরে হাঁটুর হাড়ক্ষয় রোগে ভুগছিলেন প্রবীর মিত্র। মাঝে অস্ত্রোপচার করা হলেও পুরোপুরি সেরে ওঠেননি, রুটিনমাফিক ফিজিওথেরাপি নিতে হতো। স্বাভাবিক হাঁটাচলা করতে পারতেন না, চলাচলের জন্য তাঁর ভরসা ছিল হুইলচেয়ার। বাসার বাইরে খুব একটা যাওয়া হতো না। পত্রিকা পড়ে কিংবা টিভি দেখে, শুয়েবসে সময় কাটত দিন তাঁর। সেই সাক্ষাৎকারে প্রথম আলোকে প্রবীর মিত্র বলেছিলেন, ‘আমি ভালো নেই। কী করব বুঝতে পারি না। কিছুই ভালো লাগে না। বেকার হয়ে বসে আছি। কেউ কাজের জন্য ডাকে না। পারলে আজ থেকেই কাজ করি। কিন্তু পাই না।’
পরিবার জানিয়েছে, ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেই বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হন প্রবীর মিত্র। অভিনেতার পুত্র বলেন, ‘মাকে বিয়ে করার আগে বাবা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন।’
প্রবীর মিত্রর তিন ছেলে ও এক মেয়ে—মিথুন মিত্র, ফেরদৌস পারভীন, সিফাত ইসলাম ও সামিউল ইসলাম। এর মধ্যে সামিউল মারা গেছেন। প্রবীর মিত্রর স্ত্রী অজন্তা মিত্র প্রয়াত হয়েছেন ২০০০ সালে।
১৯৪১ সালের ১৮ আগস্ট চাঁদপুরের নতুনবাজারের গুয়াখোলায়, মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন প্রবীর মিত্র। তাঁর পুরো নাম প্রবীর কুমার মিত্র। পুরান ঢাকায় বড় হওয়া প্রবীর মিত্র স্কুলজীবন থেকেই নাট্যচর্চার সঙ্গে যুক্ত হন। স্কুলজীবনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ডাকঘর’ নাটকে অভিনয় করেছিলেন তিনি।
১৯৬৯ সালে প্রয়াত এইচ আকবরের ‘জলছবি’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য প্রথম প্রবীর মিত্র ক্যামেরার সামনে দাঁড়ান। যদিও চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায় ১৯৭১ সালের ১ জানুয়ারি। ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে প্রবীর মিত্র ‘নায়ক’ হিসেবে কয়েকটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। পরে চরিত্রাভিনেতা হিসেবে কাজ করেও তিনি দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছেন। ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, ‘দুই পয়সার আলতা’, ‘বড় ভালো লোক ছিল’, ‘বেদের মেয়ে জোসনা’র মতো চলচ্চিত্রে অভিনয় করে দর্শকদের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন। অভিনয় করেছেন ‘জীবন তৃষ্ণা’, ‘সেয়ানা’, ‘জালিয়াত’, ‘ফরিয়াদ’, ‘রক্ত শপথ’, ‘চরিত্রহীন’, ‘জয় পরাজয়’, ‘অঙ্গার’, ‘মিন্টু আমার নাম’, ‘ফকির মজনু শাহ’, ‘মধুমিতা’, ‘অশান্ত ঢেউ’, ‘অলংকার’, ‘অনুরাগ’, ‘প্রতিজ্ঞা’, ‘তরুলতা’, ‘গাঁয়ের ছেলে’, ‘পুত্রবধূ’সহ চার শতাধিক চলচ্চিত্রে।