দেরিতে শুটিং করাটাই যেন নিয়ম

সরকারি অনুদানের কোনো ছবি আগেই মুক্তি পাচ্ছে কোনোটার শুটিং-ই শুরু হচ্ছে নাকোলাজ : প্রথম আলো

প্রতিবছর অনুদানের সিনেমার ঘোষণা আসে। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় শর্ত সাপেক্ষে ছবির আহ্বান করে। নিয়ম মেনে প্রযোজকেরাও চিত্রনাট্য জমা দেন। অনুদানপ্রাপ্তির পরই যেন অনেক প্রযোজক ভুলে যান সব নিয়ম। ব্যতিক্রম থাকলেও বেশির ভাগ প্রযোজকই যেন নিয়মের তোয়াক্কা করছেন না। গত দুই অর্থবছরের অনুদান পাওয়া সিনেমাগুলোর দিকে তাকালে সে চিত্র দেখা যায়। গত দুই বছরে করোনার অজুহাত দেখিয়ে অনেক প্রযোজক ও পরিচালক বিলম্বে শুটিং শুরু করেন। পরিস্থিতি ভালো হলেও অনেক সিনেমার অগ্রগতি হতাশাজনক। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি দেওয়া হলেও প্রযোজকেরা সময় চেয়ে পাল্টা চিঠি দিচ্ছেন। মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, অনুদানের সিনেমা সঠিক সময়ে জমা পাচ্ছে না তারা। আইনের আশ্রয় নেওয়ার কথাও ভাবছে।

২০১৯-২০ অর্থবছরে সাধারণ শাখায় ১১টি, মুক্তিযুদ্ধে ৩টি ও শিশুতোষ শাখায় ২টি সিনেমা অনুদানের ঘোষণা আসে। এসব সিনেমায় বরাদ্দ হয় ৮ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। তখন করোনায় সব থমকে গেলে থমকে যায় সিনেমাও। তবে করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও কেউ শুটিং শুরু করেন। ঘোষণার পরের বছর ২০২১ সালেও আটটি সিনেমার প্রযোজক শুটিং শুরু করতে ব্যর্থ হন। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরের অনুদানের ছবিগুলো গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্তও তারা বুঝে পায়নি।

শাকিব খানের বিপরীতে ‘গলুই’-এ অভিনয় পূজা চেরীকে অনেক বেশি স্পটলাইটে নিয়ে আসে বলেও জানান তিনি্ সরকারি অনুদান তৈরি এই ছবিটি মুক্তি পেয়েছে
ছবি : সংগৃহীত

২০২১ সালের জুন থেকে দেশে করোনার প্রভাব কমতে শুরু করে। সিনেমা অঙ্গন আবার চাঙা হতে থাকে। সুযোগ বুঝে ২০২১ সালে ২০১৯-২০ অর্থবছরে অনুদান পাওয়া ১০ সিনেমার শুটিং শুরু হয়। কিন্তু সেবারের অনুদান পাওয়া ‘যোদ্ধা’, ‘ফুটবল-৭১’ সিনেমার শুটিং আজ পর্যন্ত শুরুই হয়নি। যোদ্ধা সিনেমার পরিচালক এস এ হক অলিক বলেন, ‘আমাদের সিনেমার জন্য দরকার ছিল শীতকাল। করোনার প্রথম বছরে শীতের মধ্যে লকডাউন ছিল। পরে অনুদানের আরেকটি সিনেমা ‘গলুই’ এর কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাই। এখন আমরা পুরো প্রস্তুতি নিয়েছি। আগামী অক্টোবরে শুটিং শুরু করব। আমরা দেরির বিষয়ে তথ্য মন্ত্রণালয়কে অবগত করেছি।’

‘মুখোশ’ চলচ্চিত্রে জিয়াউল রোশান ও পরীমনি, ছবিটি মুক্তি পেয়েছে
ছবি: সংগৃহীত

‘ফুটবল-৭১’ সিনেমাটির পরিচালক অনম বিশ্বাস জানালেন, সিনেমাটির পরিসর অনেক বড়। শুটিং করতে আরও অনেক টাকা দরকার উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘করোনার কারণে দুই বছর চলে গেল। দেড় বছর তো ঘর থেকে বের হতেই পারিনি। আমাদের সিনেমার ফলোআপ সব সময়ই মন্ত্রণালয়ে জানিয়েছি। শিল্পী ও কলাকুশলী চূড়ান্তের পথে, চেষ্টা করছি সময় বাড়িয়ে আগামী ডিসেম্বরে শুটিং করতে।’

এদিকে একই অর্থবছরের অনুদান পাওয়া ‘গাঙকুমারী’, ‘ফিরে দেখা’সহ কয়েকটি সিনেমার কাজ গত বছর শুরু হলেও এখনো শেষ হয়নি। ‘গাঙকুমারী’র প্রযোজক ও পরিচালক ফজলুল কবীর বলেন, ‘আমাদের সিনেমাটির ৭০ শতাংশ শুটিং শেষ করেছি। ৩০ শতাংশ কাজ বাকি আছে। আমরা এ বছরই শুটিং শেষ করে মন্ত্রণালয়ে জমা দেব। করোনা, আর্থিক সমস্যা, শিডিউল জটিলতাসহ বেশ কিছু যৌক্তিক কারণে সিনেমার শুটিং শেষ করতে পারিনি।’ এদিকে অনুদান পাওয়ার পর থেকেই ‘বিলডাকিনী’ সিনেমার বরাদ্দ অর্থ, চিত্রনাট্য পরিবর্তনকে ঘিরে প্রযোজক–পরিচালকের দ্বন্দ্বে দীর্ঘদিন আটকে ছিল শুটিং। সিনেমাটির প্রযোজক আবদুল মমিন খান বলেন, ‘কিছু সমস্যার কারণে আমরা দেরিতে শুটিংয়ে যাই। পরে টানা কাজ করে শেষ করেছি। পোস্টপ্রোডাকশনের কাজ শেষ হলেই জমা দেব।’

রওনক হাসান ও রুনা খান অভিনীত ‘একটি না বলা গল্প’ ছবি মুক্তির অপেক্ষায় রয়েছে
ছবি: সংগৃহীত

এদিকে চলতি বছরের মে মাসে শুরু হয়েছিল গিয়াস উদ্দিন সেলিমের ‘কাজলরেখা’, আগস্টে শুরু হয়ে এখনো চলছে বদরুল আনাম সৌদের ‘শ্যামা কাব্য’র শুটিং। গিয়াস উদ্দিন সেলিম বলেন, ‘আমাদের লোকেশন ও গল্পের কারণে শুটিংয়ে সময়ের প্রয়োজন হয়েছে। অনেক দিন তো করোনার জন্য শুটিং শুরু করতে পারিনি। এখন ৮০ শতাংশের বেশি অংশের শুটিং করেছি। শিগগিরই বাকি অংশের শুটিং শুরু করব।’ এদিকে ২০১৯-২০ অর্থবছরের সিনেমা ‘মুখোশ’, ‘আশীর্বাদ’ এরই মধ্যে মুক্তি পেয়েছে। সেন্সর পেয়ে মুক্তির অপেক্ষায় রয়েছে ‘হৃদিতা’, ‘একটি না বলা গল্প’, ‘ছায়াবৃক্ষ’ সিনেমাগুলো।

২০২০-২১ অর্থবছরে সরকারি অনুদান পায় ২০ চলচ্চিত্র। এর মধ্যেই আবার ২০২১-২২ অর্থবছরে সরকারি অনুদানের ঘোষণা হয়েছে। ঠিকমতো নিয়ম মানা হলে, গত বছরের সিনেমাগুলোর কাজ এরই মধ্যে শেষ হওয়ার কথা। এসব সিনেমারও কাজ শেষ করার জন্য মন্ত্রণালয় থেকে একের পর এক চিঠি দেওয়া হয়েছে। তারপরও নেই কাজের অগ্রগতি। সবাই নিজেদের সুবিধামতো সময় বাড়িয়ে নিচ্ছেন। খবর নিয়ে জানা যায়, ‘রইদ’, ‘দাওয়াল’, ‘সাড়ে তিন হাত ভূমি’ সিনেমাগুলো এখনো শুটিংয়েই যেতে পারেনি। ‘সাড়ে তিন হাত ভূমি’র প্রযোজক ও পরিচালক নঈম ইমতিয়াজ নেয়ামুল বলেন, ‘অনুদানের কাজটি ভালোভাবে করার জন্য গল্প ও চিত্রনাট্যের কিছুটা পরিবর্তন করেছি। এটা মন্ত্রণালয়ে জমা দেব। সব ঠিক থাকলে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি শুটিংয়ে যাব।’ ‘দাওয়াল’–এর পরিচালক পিকলু চৌধুরী বলেন, ‘১৯৪৮ সালের ফুড কর্ডন নিয়ে আমার গল্প। ঐতিহাসিক কিছু বিষয় থাকায় আমরা মন্ত্রণালয়ে আদেশ অনুযায়ী সংশোধন করছি।’

‘ছায়াবৃক্ষ’ চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্যে নিরব ও অপু বিশ্বাস, সরকারি অনুদানে তৈরি এই ছবিটি মুক্তির অপেক্ষায়
ছবি : সংগৃহীত

এদিকে ‘বলী’, ‘শ্রাবণ জ্যোৎস্নায়’, ‘চাঁদের অমাবস্যা’, ‘জলে জ্বলে’, ‘দেশান্তর’, ‘অসম্ভব’, সিনেমার শুটিং এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। সেন্সর শেষে মুক্তির অপেক্ষায় রয়েছে ‘জয় বাংলা’, ‘ভাঙন’। তবে সবার আগে কাজ শেষ হয় ‘গলুই’ সিনেমার। শাকিব খান অভিনীত ছবিটি মুক্তিও পেয়েছে। ‘জামদানি’, ‘জলরঙ’সহ ছয়টির শুটিং চলছে। একটি সিনেমার কিছু অংশের শুটিং বন্ধ থাকার কারণে পরিচালক ও প্রযোজকের দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সিনেমাটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, যেভাবে শর্ত ছিল, সেভাবে কাজটি হচ্ছে না। প্রযোজক নিজেই সব কাজ করতে চাইছেন, কিন্তু সময় দিচ্ছেন না। প্রযোজক ১০ টাকার কাজ ৫ টাকা দিয়ে শেষ করতে চান। এটিই প্রযোজক ও পরিচালকের দ্বন্দ্বের মূল কারণ বলে জানায় সূত্রটি।

অনুদানের সিনেমার শুটিং দেরিতে করা এখন যেন নিয়ম হয়ে গেছে। সময়ের মধ্যে শেষ করতে বলে বারবার চিঠি দিয়েও কোনো লাভ হচ্ছে না। নানা সমস্যা দেখিয়ে প্রযোজকেরা চিঠি দিচ্ছেন। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (চলচ্চিত্র-১) মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘করোনা শুরু হওয়ার পর অনেক প্রযোজক ঠিক সময়ে কাজ করতে পারেননি। তাঁরা সবাই এখন শুটিংয়ে হাত দিয়েছেন। কেউ শেষ করে মুক্তি দিয়েছেন। কেউ শেষ করছেন। আমরা প্রতিনিয়ত প্রযোজকদের তাড়া দিচ্ছি। কিন্তু প্রযোজকেরা যৌক্তিক কারণ দেখিয়ে সমস্যার কথা বললে তখন আমাদের তেমন কিছু বলার থাকে না। তবে আমরা অনুদানের সিনেমা নিয়ে এখন আইনগত ব্যবস্থার কথা ভাবছি।’