রাজ্জাক, সুচন্দারা সেদিন শহীদ মিনারেই শুটিং করেছিলেন
পরাধীন পাকিস্তানে ১৯৬৫ সালে জহির রায়হান নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন একুশ নিয়ে চলচ্চিত্র। কিন্তু পাকিস্তান সরকার এ ধরনের সিনেমা নির্মাণের অনুমতি দেয়নি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জহির রায়হান যদি বেঁচে থাকতেন, তাহলে হয়তো এই আক্ষেপে পুড়তে হতো না। তবে ১৯৭০ সালে ‘জীবন থেকে নেয়া’ চলচ্চিত্রে জহির রায়হান একুশে ফেব্রুয়ারির দৃশ্য সংযোজন করে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। তিনি ‘জীবন থেকে নেয়া’ চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রসংগীত ‘আমার সোনার বাংলা’ ব্যবহার করেছিলেন। এ ছাড়া ব্যবহার করেছেন ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটিও। ছবির একটি অংশে প্রভাতফেরি ও শহীদ মিনারে ফুল দেওয়ার দৃশ্যও রয়েছে।
১৯৭০ সালে একুশের মিছিলের দৃশ্য সরাসরি ক্যামেরাবন্দী করে জহির রায়হান গণ–আন্দোলনের পটভূমিতে নির্মিত তাঁর ‘জীবন থেকে নেয়া’ চলচ্চিত্রে সংযোজন করেন। সেই দিনের শুটিংয়ের গল্প বিভিন্ন সময়ে স্মৃতিচারণা করেছিলেন প্রয়াত চিত্রনায়ক রাজ্জাক, চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব আমজাদ হোসেন, সুচন্দাসহ সংশ্লিষ্ট শিল্পীরা।
এক স্মৃতিচারণায় রাজ্জাক বলেছিলেন সেদিনের কথা। রাজ্জাকের বক্তব্য ছিল এমন, ‘১৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৭০। এফডিসিতে শুটিং করছিলাম। অনেক রাত পর্যন্ত শুটিং হলো। শুটিং শেষে জহির ভাই আমাদের ডেকে বললেন, আগামীকাল ২০ ফেব্রুয়ারি আমরা সকালের শিফটের শুটিং করব। এরপর রাত ১২টার পর শুটিং ইউনিট চলে যাবে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। লাইভ শুটিং হবে। জহির ভাইয়ের কথা প্রথমে বুঝতে পারলাম না। পরে তিনি বুঝিয়ে বললেন, আমার “জীবন থেকে নেয়া” ছবিতে ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর যে দৃশ্যটি আছে, তা আমরা শহীদ মিনারেই করব।
‘জহির রায়হান বলেই হয়তো সেদিন এমন সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিলেন। বাংলা ভাষায় এখন পর্যন্ত যত ছবি হয়েছে, তার মধ্যে “জীবন থেকে নেয়া” ছবিটিই একুশে ফেব্রুয়ারিকে স্পর্শ করেছিল দারুণভাবে। পরদিন ২০ ফেব্রুয়ারি সকাল শিফটের শুটিং শেষে আমরা সব শিল্পী জহির ভাইয়ের কাছ থেকে কস্টিউম সম্পর্কে জেনে নিয়ে বাড়ি চলে গেলাম। রাত আটটার মধ্যেই ফিরে এলাম এফডিসিতে। আমি ছাড়াও সেদিন শুটিংয়ে অংশ নিলেন আনোয়ার হোসেন, সুচন্দা, রোজী আফসারীসহ ছবির অন্য শিল্পীরা। জহির ভাইকে একজন জিজ্ঞেস করলেন, লাইটের কী ব্যবস্থা থাকবে? তিনি বললেন, ওসব আগে থেকেই ভেবে রেখেছি। আমাদের কয়েকজনের গাড়ির হেডলাইটের আলোয় শুটিং হবে। ক্যামেরাম্যান আগেই চলে যাবেন। আর আমাদের শিল্পীদের বললেন, না বলা পর্যন্ত কেউ গাড়ি থেকে বের হবে না।
‘আমরা রাত ১২টার পর রওনা হলাম শহীদ মিনারের উদ্দেশে। তাঁর কথামতো আমরা গাড়ি নিয়ে একটি নির্দিষ্ট স্থানে অপেক্ষায় থাকলাম। চারদিক থেকে লোকের ঢল নামতে শুরু করল। বুঝতে পারছিলাম না, ক্যামেরা আসলে কোথায়। জহির ভাই বললেন, সে নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। ক্যামেরাই তোমাদের খুঁজে নেবে। কিছুক্ষণ পর জহির ভাই আবার এসে বললেন, যাত্রাবাড়ীর দিক থেকে একটি মিছিল আসছে।
মিছিলটি আমাদের কাছাকাছি আসামাত্র আমরা যেন মিছিলের অগ্রভাগে গিয়ে মিছিলের লোকজনের সঙ্গে মিশে যাই। মনে মনে ভাবলাম, যদি লোকজন আমাদের নিয়ে টানাহেঁচড়া শুরু করে, তখন কী হবে। কিন্তু চিন্তায় ছেদ পড়ল। মিছিলটি আমাদের কাছাকাছি চলে এল। গাড়িতেই জুতা রেখে মিছিলের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। মিছিলকারীরা তো আমাদের দেখে হতবাক! আমরা তাদের অনুরোধ করে বললাম, ভাই, আমরা “জীবন থেকে নেয়া” ছবির শুটিং করতে এসেছি। আপনাদের সঙ্গে গিয়ে শহীদ মিনারের বেদিতে পুষ্প অর্পণ করব। দয়া করে কেউ পেছন থেকে ধাক্কাধাক্কি করবেন না। এর মধ্যেই দেখলাম কয়েকটি গাড়ির হেডলাইটের আলো জ্বলে উঠল। আমরা “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/ আমি কি ভুলিতে পারি...” গানটি কোরাস গাইতে গাইতে আস্তে আস্তে এগিয়ে চললাম। মুহূর্তের মধ্যে সবাই জেনে গেল, আমরা এসেছি এবং এখানে শুটিং করছি। আস্তে আস্তে হুড়োহুড়ি বেড়ে গেল। তখন তো আসলে রাজ্জাক, আনোয়ার হোসেন, সুচন্দা, রোজী আফসারী এ নামগুলো ছিল মানুষের কাছে স্বপ্নের মতো। দ্রুত শহীদ মিনারের দিকে এগিয়ে গেলাম। ফুল দেওয়া শেষ হতেই শুরু হলো আমাকে নিয়ে টানাহেঁচড়া। সে কী হুলুস্থুল কাণ্ড। কোনোমতে এসে গাড়িতে উঠে বসলাম। ভাবলাম, বাঁচা গেল। কিন্তু জানানো হলো এখনো কাজ শেষ হয়নি। যেতে হবে সালাম-বরকতের কবরে। সেখানেও গেলাম শুটিং করতে। তখন আকাশ ফরসা হতে শুরু করেছে। একটু একটু ঘুম পাচ্ছিল। ওই অবস্থার মধ্যেই শুটিং করলাম। সকাল হয়ে গেল। সুর্য উঁকি দিল। আমাদের শুটিং প্যাকআপ হলো। মনে হচ্ছিল না যে ভালোভাবে কাজটি শেষ করতে পেরেছি। যেদিন ছবিটি দেখলাম সেদিন বিস্মিত হয়েছি যে এত সুন্দরভাবে একুশে ফেব্রুয়ারিতে শহীদ মিনারে ফুল দেওয়ার দৃশ্যটিতে আমরা কীভাবে কাজ করলাম!’
সুচন্দা তাঁর স্মৃতিচারণায় বলেছেন, ‘“জীবন থেকে নেয়া” ছবিটির কাহিনি প্রথমে জহির রায়হান ঠিক করেছিলেন একটি সংসারের প্রতীকী গল্পের ওপর। তবে এর মধ্যে তিনি একুশে ফেব্রুয়ারিকে একটি অংশ হিসেবে তুলে ধরেছিলেন। ছবিতে স্বাধীনতার কথা চমৎকারভাবে তুলে ধরা হয়েছিল। জহির রায়হান একুশে ফেব্রুয়ারির বিষয়টি তুলে ধরে জনতাকে বোঝাতে চেয়েছেন, এমনিতেই পাকিস্তানিরা আমাদের কিছুই দেবে না। আন্দোলন করেই সবকিছু আদায় করে নিতে হবে। যেটা হয়েছিল ১৯৫২ সালে একুশে ফেব্রুয়ারি। “জীবন থেকে নেয়া” ছবিতে একুশকে তিনি এমন চমৎকারভাবে তুলে ধরেছিলেন যে ছবি দেখার সময় মনেই হয়নি এটা আরোপিত কিছু। আর এ বিষয়টি কিন্তু মানুষের মনে বিস্ফোরকের মতো কাজ করেছে ওই সময়।
‘জহির রায়হান যখন ছবিটির শুটিং করছিলেন, তখনই আমরা বুঝতে পারছিলাম তিনি এমন কিছু একটা করতে যাচ্ছেন, যা অনেককেই ভাবাবে। হয়েছেও তাই। যেমন এফডিসিতে শুটিং করছিলাম আমরা ফেব্রুয়ারি মাসে। ১৯ তারিখের দিকে জহির বললেন, ছবিতে প্রভাতফেরির দৃশ্য দেখানো হবে। আমরা মনে করলাম সম্ভবত এফডিসিতেই শহীদ মিনার বানিয়ে শুটিং করা হবে। কিন্তু ২০ তারিখে জানতে পারলাম, না, সরাসরি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শুটিং করা হবে।’
প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে স্মৃতিচারণা করে আমজাদ হোসেন বলেছিলেন, ‘“জীবন থেকে নেয়া” ছবির স্ক্রিপ্টের কাজ শুরু করেছিলাম দুই বোনকে নিয়ে। সেখান থেকে জহির রায়হানের সঙ্গে পরামর্শ করেই গল্প এগিয়েছে। একসময় একুশে ফেব্রুয়ারির প্রভাতফেরির বিষয়টি এসেছে। আমাদের সবারই একটা কথা ছিল, আমরা যা-ই করি, কৃত্রিম কিছু করব না। জহির রায়হান সিদ্ধান্ত দেন, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারেই শুটিং করা হবে।
সে লক্ষ্যে এমনভাবে কাজ শুরু করলাম যে একুশে ফেব্রুয়ারির দিনেই শহীদ মিনারে শুটিংয়ের তারিখ নির্ধারণ করা হলো। কিন্তু এ নিয়ে আগে থেকে আমরা সবাইকে জানাইনি। তবে আমরা যেন সেখানে ভালোভাবে শুটিং করতে পারি, এ জন্য সাহায্য নিই রাশেদ খান মেননসহ আরও অনেকেরই। তাঁরাই ওই মিছিলটিতে আমাদের শামিল হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। যাহোক, রাত বাড়তেই সবাই তৈরি হয়ে নিলাম। নুরুল হক বাচ্চু একটি ক্যামেরা নিয়ে আগেভাগে শহীদ মিনারে পৌঁছে অবস্থান নিলেন। আরেক ক্যামেরা নিয়ে জহির রায়হান নিজেই নেমে পড়লেন। একটি ক্যামেরা রইল আমাদের ইউনিটের সঙ্গে। আমাদের নির্দেশমতো একসময় ছবির শিল্পীরা মিছিলের সঙ্গে একাকার হয়ে গেলেন। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/ আমি কি ভুলিতে পারি...” গানের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের শিল্পীরা এগিয়ে চলছেন আর জহির রায়হান একের পর এক শট নিচ্ছেন। আমার তো মনে হয়, যত শট নিয়েছিলেন, তার চার ভাগের এক ভাগ দৃশ্য ছবিতে দেখা গেছে। এমনিভাবে “জীবন থেকে নেয়া” ছবিতে উঠে এসেছে মহান একুশে ফেব্রুয়ারি।’