এখনো ছবি আটকে আছে কেন

সেন্সর বোর্ডে আটকে থাকা ছবি সার্টিফিকেশন যুগে এসেও ছাড়পত্র পাচ্ছে না কেন? খোঁজখবর করলেন মকফুল হোসেন

গত দেড় দশকে ‘অন্যদিন...’ ‘শনিবার বিকেল’, ‘মাই বাইসাইকেল’, ‘অমীমাংসিত’সহ অন্তত নয়টি ছবি আটকে রেখে গেছে বিগত সরকারগ্রাফিকস: প্রথম আলো

সেন্সর বোর্ডের ইতি ঘটিয়ে ২০২৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন বোর্ড’ গঠন করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। পাঁচ মাসে ঢাকা চলচ্চিত্র উৎসবের সিনেমাসহ সাড়ে তিন শতাধিক নতুন সিনেমাকে সার্টিফিকেশন সনদ দিয়েছে বোর্ড। নতুন ছবির পাশাপাশি আটকে থাকা সিনেমাগুলোর ছাড়পত্র দেওয়ার দায়িত্বও সার্টিফিকেশন বোর্ডের।

গত দেড় দশকে ‘অন্যদিন...’, ‘নমুনা’, ‘শনিবার বিকেল’, ‘মাই বাইসাইকেল’ (মর থেংগারি), ‘অমীমাংসিত’, ‘মেকাপ’, ‘রানা প্লাজা’সহ অন্তত নয়টি সিনেমা আটকে রেখে গেছে বিগত সরকার। এর মধ্যে কোনো সিনেমা দেড় দশক, কোনোটি এক দশক ধরে সেন্সরের ঘেরাটোপে আটকে ছিল, এখনো আছে।

আরও পড়ুন

মুক্তি পেলে চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে দর্শকের মধ্যে বিরূপ ধারণা তৈরি হবে, এ যুক্তিতে প্রায় চার বছর ধরে আটকে ছিল ‘মেকাপ’।

আটকে থাকা সিনেমার মধ্যে প্রথম সিনেমা হিসেবে অনন্য মামুনের ছবিটিকে ছাড়পত্র দিয়েছে সার্টিফিকেশন বোর্ড। একজন সুপারস্টারের জীবনের গল্প নিয়ে নির্মিত সিনেমাটি অবশেষে গত ১০ জানুয়ারি মুক্তি পেয়েছে।

কোন সিনেমা কোথায় রয়েছে

আটকে থাকা সিনেমাগুলোর কোনোটি সার্টিফিকেশন বোর্ড, কোনোটি আপিল কমিটিতে রয়েছে। আর আদালতে রয়েছে দুটি সিনেমা। সার্টিফিকেশন বোর্ডে আছে ‘অন্যদিন...’ ও ‘মাই বাইসাইকেল’ (মর থেংগারি)।

দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, নির্বাচনী পরিবেশ, রাজনীতি নিয়ে প্রশ্ন তোলায় ‘অন্যদিন...’ নিয়ে আপত্তি তুলেছিল বিগত সরকার। বিশ্বের কয়েকটি চলচ্চিত্র উৎসবের পুরস্কার পেলেও কামার আহমাদ সাইমনের সিনেমাটি এখনো ঢাকার সার্টিফিকেশন সনদই পায়নি।

‘অন্যদিন...’ সিনেমার পোস্টার
নির্মাতার সৌজন্যে
ঢালাওভাবে কর্তন করলে পুরো ছবিই ফেলে দিতে হতো। ফলে ছবিটি আর জমা দিইনি।
কামার আহমাদ সাইমন, ‘অন্যদিন...’ নির্মাতা

সেন্সর আইন দেখিয়ে চলচ্চিত্রের বেশ কয়েকটি দৃশ্য কেটে জমা দিতে বলেছিল বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড। এ নিয়ে ২০২৩ সালের ২৬ ডিসেম্বর ছবির প্রযোজক সারা আফরীনকে চিঠি দিয়েছিল সেন্সর বোর্ড।

নির্মাতা কামার আহমাদ সাইমন গত রোববার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঢালাওভাবে কর্তন করলে পুরো ছবিই ফেলে দিতে হতো। ফলে ছবিটি আর জমা দিইনি।’ ‘অন্যদিন...’ নিয়ে প্রথম আলোতে একটি সংবাদ প্রকাশের পর সিনেমাটি নিয়ে রোববার বৈঠক করেছে সার্টিফিকেশন বোর্ড। এই সপ্তাহে ছবিটি আবারও দেখে সিদ্ধান্ত জানানো হবে বলে জানান বোর্ডের এক সদস্য।

আরও পড়ুন
সেন্সর বোর্ডে (সার্টিফিকেশন) প্রায় এক দশক ধরে আটকে আছে চাকমা ভাষার সিনেমা ‘মাই বাইসাইকেল’ (মর থেংগারি)
নির্মাতার সৌজন্যে

সেন্সর বোর্ডে (সার্টিফিকেশন) প্রায় এক দশক ধরে আটকে আছে চাকমা ভাষার সিনেমা ‘মাই বাইসাইকেল’ (মর থেংগারি)। সিনেমাটি নির্মাণ করেছেন অং রাখাইন। পাহাড়ঘেরা এক গ্রামের কমল নামের এক চাকমা যুবককে ঘিরে সিনেমার কাহিনি। শহরে জীবিকা অর্জনে বিফল হয়ে একটি সাইকেল নিয়ে গ্রামে ফেরত আসেন তিনি। অং রাখাইন প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমার ছবিটা ৬৪ মিনিটের, সেখান থেকে ২৫ মিনিট কাটলে ছবিটাই তো আর থাকে না। সেই ছবির সেন্সর ছাড়পত্র নিয়ে আমি কী করব?’

সেন্সর বোর্ডের (সার্টিফিকেশন) কোনো সিদ্ধান্তে সংক্ষুব্ধ হলে প্রযোজকেরা আপিল কমিটিতে আপিল করতে পারেন। সেন্সর (সার্টিফিকেশন) না পেয়ে আপিল কমিটিতে আবেদন করেছিলেন ‘শনিবার বিকেল’ ও অমীমাংসিত’ সিনেমার প্রযোজক। দুই ছবিই বছরের পর বছর ধরে আটকে আছে।

‘শনিবার বিকেল’ সিনেমার দৃশ্যে নুসরাত ইমরোজ তিশা
ছবি: নির্মাতার সৌজন্যে

২০১৬ সালের হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার ঘটনাকে আশ্রয় করে ‘শনিবার বিকেল’ নির্মাণ করেছেন সংস্কৃতি উপদেষ্টা ও নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। ছবিটি আটকে দেওয়ার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন নির্মাতা, শিল্পীরা। ২০২৩ সালের ২২ নভেম্বর সিনেমাটি ভারতীয় স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম সনি লিভে মুক্তি পেয়েছে। তবে ছাড়পত্র না পাওয়ায় দেশের প্রেক্ষাগৃহে এখনো ছবিটি মুক্তি পায়নি।

আরও পড়ুন
রায়হান রাফী পরিচালিত ‘অমীমাংসিত’ চলচ্চিত্রটি সার্টিফিকেশন বোর্ডে আটকে আছে
ছবি: প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান

এক সাংবাদিক দম্পতি হত্যাকাণ্ডের ঘটনার ছায়া অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে ‘অমীমাংসিত’। ছবিটি নির্মাণ করেছেন রায়হান রাফী। সিনেমাটি গত বছর থেকে আপিল কমিটিতে আটকে আছে।

আপিল কমিটির এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে রোববার প্রথম আলোকে জানান, গঠনের পর থেকে এখনো আপিল কমিটির কোনো বৈঠক হয়নি। ফলে আপিল কমিটি এখনো কোনো ছবি ছাড়ার বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসেনি।

এর বাইরে ‘নমুনা’ ছবিটির ভাগ্য সার্টিফিকেশন বোর্ড কিংবা আপিল কমিটির হাতে নেই, আদালতে রয়েছে। বিষয়টি এখনো আদালতে নিষ্পত্তি হয়নি। ফলে সার্টিফিকেশন বোর্ডের করার কিছু নেই। ১৫ বছর আগে সরকারি অনুদানে বাংলাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা নিয়ে ছবিটি নির্মাণ করেছেন এনামুল করিম নির্ঝর।

‘রানা প্লাজা’ সিনেমায় রেশমা চরিত্রে অভিনয় করেছেন পরীমনি
পরিচালকের সৌজন্যে

আরেক চলচ্চিত্র ‘রানা প্লাজা’ সিনেমাকে সেন্সর সনদবিহীন ঘোষণা করে বিগত সরকার। সাভারের রানা প্লাজা ভবন ধসের ঘটনা ও পোশাকশ্রমিক রেশমাকে নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন নজরুল ইসলাম খান। সিনেমাটিও আদালতে রয়েছে, এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। এতে রেশমা চরিত্রে অভিনয় করেছেন পরীমনি।

তাঁরা (প্রযোজক) চিঠি দিয়ে বলতে পারেন, ছবিটি আবার দেখে সিদ্ধান্ত নেওয়া হোক। তখন সার্টিফিকেশন বোর্ড ও আপিল কমিটি বিষয়টি নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।’
আবদুল জলিল, ভাইস চেয়ারম্যান, চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন বোর্ড

এখনো ছবি আটকে আছে কেন

আটকে থাকা ছবিগুলোর বিষয়ে জানতে চাইলে চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল জলিল রোববার প্রথম আলোকে জানান, ছবিগুলোর প্রযোজকেরা চিঠি দিলে সার্টিফিকেশন বোর্ড ও আপিল কমিটি বিষয়টি দেখবে।

অন্য আরেক প্রশ্নের জবাবে বিষয়টা আরও খোলাসা করেন আবদুল জলিল, ‘আগে যে অবজারভেশন (পর্যবেক্ষণ) দেওয়া হয়েছিল, সেটা প্রযোজকের যৌক্তিক মনে না–ও হতে পারে। ফলে তাঁরা চিঠি দিয়ে বলতে পারেন, ছবিটি আবার দেখে সিদ্ধান্ত নেওয়া হোক। তখন সার্টিফিকেশন বোর্ড ও আপিল কমিটি বিষয়টি নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।’

‘শনিবার বিকেল’ নিয়ে আপিল কমিটিতে চিঠি দেবেন কি না, জানতে চাইলে ছবির নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাননি। ছবিটি প্রযোজনা করেছে জাজ মাল্টিমিডিয়া, ছবিয়াল ও ট্যানডেম প্রোডাকশন।

জাজ মাল্টিমিডিয়ার কর্ণধার আবদুল আজিজ রোববার প্রথম আলোকে জানান, সপ্তাহখানেকের মধ্যেই আপিল কমিটিতে চিঠি দেবেন তাঁরা।

‘নমুনা’, ‘রানা প্লাজা’, ‘অমীমাংসিত’, ‘শনিবার বিকেল’, ‘মাই বাইসাইকেল’–এর মতো ছবি আটকে আছে
কোলাজ
এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে আমি একমত নই। তারা চাইলে ছবিটা ছেড়ে দিতে পারে। এটা একটা অজুহাত। ছবির কাগজপত্র সবই বোর্ডে আছে। ফলে আমি নতুন করে চিঠি দিতে চাই না।
অং রাখাইন, ‘মাই বাইসাইকেল’ নির্মাতা

‘অমীমাংসিত’ নির্মাতা রায়হান রাফী জানান, এ মাসের শেষভাগে আপিল কমিটিতে চিঠি দেবেন তিনি।

তবে ‘মাই বাইসাইকেল’ নির্মাতা অং রাখাইন চিঠি দিতে নারাজ। এই নির্মাতা রোববার প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে আমি একমত নই। তারা চাইলে ছবিটা ছেড়ে দিতে পারে। এটা একটা অজুহাত। ছবির কাগজপত্র সবই বোর্ডে আছে। ফলে আমি নতুন করে চিঠি দিতে চাই না।’

বিষয়টি নিয়ে সার্টিফিকেশন বোর্ডে কয়েক দফা চিঠি দিয়েও কোনো সুরাহা পাননি নির্ঝর। ফলে বিষয়টি নিয়ে বিরক্তির কথা জানালেন এই পরিচালক।

নির্মাতা কামার আহমাদ সাইমন বলছেন, ‘অভ্যুত্থান–পরবর্তী বাংলাদেশ একটা নতুন স্বপ্ন নিয়ে যাত্রা শুরু করেছে। আমরা তো আশা করি, গুমঘরের মতো আটকে থাকা সব ছবি দ্রুত ছাড়া পাবে। বিশেষ কোনো কারণ থাকলে নির্দিষ্ট ছবি নিয়ে পরিচালক-প্রযোজকের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে পারে বোর্ড। কিন্তু ২০২৪–এর পরবর্তী বাংলাদেশ কেমন হবে, তার চর্চা আজকেই শুরু করতে হবে। সামনের লড়াইটা কালচারাল ন্যারেটিভের, এই লড়াইয়ে সিনেমা হবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।’

আরও পড়ুন