শিমু যখন পারস্য-যাত্রী
আলী ও জাহরা ভাই–বোন। আলী ছোট বোনের জুতা মেরামত করার জন্য একদিন বাজারে মুচির কাছে যায়। আলী যখন জুতাটি রেখে একটি দোকানে আলু কিনতে যায়, তখনই ঘটে বিপত্তি। এক বৃদ্ধ অন্ধ ভিক্ষুক আলীর জুতা নিয়ে চলে যায়। জুতা হারিয়ে আলী মহাবিপদে পড়ে যায়। মাজিদ মাজিদির বিখ্যাত সিনেমা ‘চিলড্রেন অব হ্যাভেন’-এর গল্পটি অনেকেরই জানা।
ছোটবেলায় অন্য অনেকের মতো বাংলাদেশ টেলিভিশন বাংলা ডাবে ইরানি সিনেমাটি দেখেছিলেন রিকিতা নন্দিনী শিমু। তখনো তিনি অভিনয় শুরু করেননি। তবে ইরানি সিনেমার সারল্যে মুগ্ধ হয়েছিলেন। বড় হওয়ার পর যখন অভিনয় শুরু করলেন, তত দিনে ইরানের নামী পরিচালকদের ভক্ত বনে গেছেন।
সিনেমার কল্যাণে বিভিন্ন দেশের উৎসব ঘোরা হয়ে গেছে। তবে ইরানে কখনো যাওয়া হয়নি। সুযোগ মিলে গেল ‘ফেরেশতে’র কল্যাণে।
১ ফেব্রুয়ারি তেহরানে প্রদর্শিত হয় বাংলাদেশ ও ইরানের যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত সিনেমাটি। উৎসব যোগ দিতে প্রথমবারের মতো ইরান যান অভিনেত্রী। কেমন লাগল দেশটি? উৎসবে স্থানীয় দর্শকেরাই বা কী বললেন সিনেমাটি দেখে? গতকাল দুপুরে প্রশ্ন করতেই রিকিতা নন্দিনী খুলে বসলেন গল্পের ঝাঁপি।
অভিনেত্রীর ‘ইরান-যোগ’ অবশ্য শুরু হয়েছে আরও আগে। গত ২০ জানুয়ারি শুরু হয়েছিল ২২তম ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব। উৎসবের উদ্বোধনী সিনেমা ছিল ‘ফেরেশতে’। সিনেমাটির পরিচালক মুর্তজা অতাশ জমজম। কাকতালীয়ভাবে এবারের ঢাকা উৎসবে হাজির ছিলেন রিকিতা নন্দিনীর প্রিয় পরিচালকদের একজন মাজিদ মাজিদিও। ঢাকা উৎসবের পর ইরানের ফজর আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবেও উদ্বোধনী সিনেমা হিসেবে প্রদর্শিত হয় ‘ফেরেশতে’।
ইরানের সঙ্গে আরও অনেকের মতো সিনেমা দিয়েই পরিচয় রিকিতা নন্দিনীর। তবে তেহরান তাঁকে বরাবরই আকর্ষণ করেছে। হয়তো নানা কারণে ইরান বা তেহরানের অনেক কিছুই ‘প্রকাশ্য’ নয় বলে। মাঝেমধ্যে ইউটিউবে ইরান বা তেহরানের ভিডিও খুঁজে দেখেছেন। সেই দেখা থেকে পূর্ব একটা ধারণা নিয়ে এবার দেশটিতে গিয়ে রীতিমতো বিস্মিত অভিনেত্রী। ‘ভিডিওতে একভাবে দেখাত কিন্তু বাস্তবের সঙ্গে তার কোনো মিল নেই। যাওয়ার পর দেখলাম দেশটা এত সুন্দর! আমরা ইস্পাহান শহরে ছিলাম। তেহরান থেকে ছয় ঘণ্টার জার্নি, ওখানেই দুই দিন ছিলাম। এত অদ্ভুত সুন্দর শহরটা,’ বলছিলেন রিকিতা নন্দিনী।
তেহরান থেকে প্রায় ৩৪০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত এই ইস্পাহান ইরানের তৃতীয় বৃহত্তম নগরী; সাফাভীয় সাম্রাজ্যের সময় শহরটি ছিল পারস্যের রাজধানী। প্রাচীন ইসলামি স্থাপত্য, সেতু, মসজিদ ও মিনার মিলিয়ে শহরটির খ্যাতি দুনিয়াজোড়া। অভিনেত্রীও প্রেমে পড়ে গেছেন এই শহরের। বলছিলেন, ‘প্রতিটি রাস্তা, স্থাপত্য আপনাকে মুগ্ধ করবে। রাত হোক বা দিন—রাস্তায় নামলে বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকবেন। শহরটাকে তাঁরা যেভাবে তুলে ধরেছেন, তা দেখার মতো। আমরা মোটে দুই দিন ছিলাম, ঘুম কী জিনিস বুঝিনি; যতটা সম্ভব ঘুরে বেড়িয়েছি। স্থানীয় বাজার, পার্ক কত জায়গায় যে গেছি!’
১ ফেব্রুয়ারি ফজর উৎসবে ‘ফেরেশতে’র প্রদর্শনী হয়। প্রদর্শনী শেষেই পুরো টিম চলে গিয়েছিল ইস্পাহানে। প্রদর্শনীর অভিজ্ঞতা নিয়ে বাংলাদেশের জাতীয় পুরস্কারজয়ী অভিনেত্রী বলেন, ‘প্রচুর দর্শক সিনেমাটি দেখতে এসেছিলেন। স্থানীয় দর্শকের সঙ্গে কিছু বাংলাদেশি দর্শকও ছিলেন। সবাই সিনেমাটির প্রশংসা করেছেন, উৎসবের বিচারকেরাও প্রশংসা করেছেন। প্রদর্শনী শেষে স্থানীয় সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছি। ভাষা না জানার পরও আমরা কীভাবে কাজ করলাম, সবাই জানতে জানতে চাচ্ছিলেন। সব মিলিয়ে দুর্দান্ত অভিজ্ঞতা।’
উৎসবে রিকিতা নন্দিনী ছাড়াও ছিলেন সিনেমার অন্য দুই অভিনয়শিল্পী জয়া আহসান, সুমন ফারুক; ছবির গল্পকার ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মুমিত আল রশিদ। রিকিতা নন্দিনী জানান, সবাই মিলে এক হোটেলে থাকা, ঘোরাঘুরি মিলিয়ে দারুণ উপভোগ করেছেন সফর। মাঝে পরিচালক অতাশ জমজমের বাড়িতে নিমন্ত্রণ ছিল বড় পাওনা।
তারেক মাসুদের সিনেমা ‘রানওয়ে’ দিয়ে শুরু, এরপর গত এক যুগে ‘আন্ডার কনস্ট্রাকশন’, ‘শিমু’ সিনেমায় দেখা গেছে রিকিতা নন্দিনীকে। মাঝে পশ্চিমবঙ্গের আদিত্য বিক্রম সেনগুপ্তর ‘ওয়ানস আপন আ টাইম ইন ক্যালকাটা’য় অভিনয় করেছেন তিনি।