৭০ বছরের জীবনে তিনি ৫৬ বছর কাটিয়ে দেন সিনেমাজগতে
‘মিষ্টি মেয়ে’ কথাটি বললেই যে নায়িকার নামটি মাথায় আসে, তিনি একজনই। কবরী। চট্টগ্রামের মীনা পাল চলচ্চিত্রে নাম লিখিয়ে কবরী হয়ে ওঠেন। মিষ্টি হাসি ও ব্যতিক্রম অভিনয়ে জায়গা করে নেয় দেশের কোটি মানুষের অন্তরে। এ দেশের সিনেমাকে যাঁরা সমৃদ্ধ করেছেন, তাঁদের মধ্য তিনি অন্যতম।
১৯৫০ সালের ১৯ জুলাই চট্টগ্রামের বোয়ালখালীতে জন্মগ্রহণ করা কবরী ১৯৬৪ সালে ‘সুতরাং’ দিয়ে রুপালি পর্দায় তাঁর যাত্রা শুরু করেন। তাঁর অভিনীত সিনেমার আবেদন ছবিপ্রেমীদের কাছে কখনোই ফুরিয়ে যাওয়ার নয়। গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তায় তিনি ছাড়িয়ে যান অনেককে। নিজেকেই নিজের তুলনা করে তোলেন কবরী।
কবরী রোমান্টিক, সামাজিকসহ সব ধরনের সিনেমায় অভিনয় করে কোটি মানুষের মন জয় করে নেন। ১৯৬৪ সালে সুভাষ দত্তের ‘সুতরাং’ দিয়ে চলচ্চিত্রে অভিষেক হওয়া কবরী পরের বছর অভিনয় করেন ‘জলছবি’ ও ‘বাহানা’য়। ১৯৬৮ সালে ‘সাত ভাই চম্পা’, ‘আবির্ভাব’, ‘বাঁশরি’, ‘যে আগুনে পুড়ি’। ১৯৭০ সালে ‘দীপ নেভে নাই’, ‘দর্পচূর্ণ, ‘ক খ গ ঘ ঙ’, ‘বিনিময়’ ছবিগুলো। কবরী অভিনীত ‘ময়নামতি’, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, ‘সারেং বৌ’, ‘নীল আকাশের নীচে’, ‘সুজন সখী’র মতো ছবির মাধ্যমে দর্শক অবাক বিস্ময়ে দেখেছেন অসামান্য এক অভিনেত্রী হয়ে ওঠা। অভিনয়ে, প্রযোজনায়, পরিচালনায় সাত দশকের জীবনটা এক আশ্চর্য সফলতার গল্প।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়ি চলে যান তিনি। সেখান থেকে পাড়ি জমান ভারতে। কলকাতায় গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টি করতে বিভিন্ন সভা-সমিতি ও অনুষ্ঠানে বক্তৃতা এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগ দেন কবরী। তখনকার স্মৃতি স্মরণ করে একবার কবরী বলেছিলেন, ‘সেখানকার এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের অবস্থার কথা তুলে ধরেছিলাম। কীভাবে আমি মা-বাবা, ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন সবাইকে ছেড়ে এক কাপড়ে পালিয়ে সেখানে পৌঁছেছি, সে কথা বলেছিলাম। সেখানে গিয়ে তাদের মাধ্যমে বিশ্ববাসীর কাছে আমাদের দেশকে সাহায্যের আবেদন করি।’
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আবারও চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু করেন কবরী। শতাধিক ছবিতে অভিনয় করেন তিনি। ১৯৭৩ সালে ঋত্বিক ঘটক পরিচালিত ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ সেসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। নায়ক রাজ্জাকের সঙ্গে ‘রংবাজ’ পায় বেশ জনপ্রিয়তা। ৫০ বছরের বেশি সময় চলচ্চিত্রে রাজ্জাক, ফারুক, সোহেল রানা, উজ্জ্বল, জাফর ইকবাল ও বুলবুল আহমেদের মতো অভিনেতাদের সঙ্গে কাজ করেছেন তিনি। ঢাকার চলচ্চিত্র ইতিহাসের অন্যতম জনপ্রিয় জুটি ছিলেন রাজ্জাক-কবরী।
২০০৫ সালে এসে ‘আয়না’ নামের একটি ছবি নির্মাণের মাধ্যমে চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে কাজ শুরু করেন কবরী। এমনকি ওই ছবির একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে তিনি অভিনয়ও করেছিলেন। এরপর রাজনীতিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন তিনি। ২০০৮ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। যুক্ত হয়েছেন অসংখ্য নারী অধিকার ও সমাজসেবামূলক সংগঠনের সঙ্গে। কবরীর বর্ণাঢ্য জীবনকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে আরেক গুণী অভিনয়শিল্পী, প্রযোজক এবং পরিচালক সোহেল রানারও। তিনি বলেন, ‘কবরীকে “মিষ্টি মেয়ে” নামটা এ দেশের সাধারণ মানুষেরাই দিয়েছে। সাধারণ লোকের দেওয়া নামটাই বোধ হয় একজন শিল্পীর বড় প্রাপ্য। একজন শিল্পী হিসেবে তাঁর বড় সার্থকতা। এরপর শিল্পী হিসেবে তাঁকে নিয়ে আর দ্বিতীয় কথা বলার নেই। সি ওয়াজ জাস্ট আন প্যারালাল। ওই মিষ্টি মুখ বা ওই মিষ্টি হাসি বা ওই মিষ্টি অভিনয়—বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে আসেনি এর আগে এক কবরী ছাড়া। আগামী ৫০ বছরে আসবে বলেও আমার ধারণা নেই। আমি বিশ্বাস করি, শত বছরে কবরী একটাই জন্মায়।’
বাংলা চলচ্চিত্রপ্রেমী অনেকের প্রিয় কবরী। তাঁর মিষ্টি অভিনয় ও মিষ্টি হাসি যেমন সবাইকে মুগ্ধ করত। তেমনি দেশ-বিদেশের অনেকেও তাঁর প্রিয় তালিকায় ছিল। অভিনয়শিল্পীদের মধ্যে সোফিয়া লরেন, এলিজাবেথ টেলর, অড্রে হেপবার্ন, গ্রেগরি পেক, উত্তম কুমার, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, বিকাশ রায় ও ছবি বিশ্বাস ছিলেন প্রিয়দের তালিকার সবার আগে। গান শুনতেও খুব পছন্দ করতেন কবরী। এর মধ্যে পপ ধারার গানই বেশি শুনতেন বলে প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপে একাধিকবার জানিয়েছিলেন। তবে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় সংগীতশিল্পীর তালিকায় দেশের বাইরে মান্না দে, হেমন্ত ও শ্রীকান্ত আচার্য। দেশের মধ্যে সুবীর নন্দী ও সাবিনা ইয়াসমীনের কণ্ঠ তাঁর খুব প্রিয়। তাঁর সমসাময়িক এমন কেউ নেই, যাঁর সঙ্গে চলচ্চিত্রে তিনি পর্দা ভাগাভাগি করেননি। কিন্তু মনে মনে একজনের সঙ্গে অভিনয়ের স্বপ্নটা দেখতেন। যা কখনোই পূরণ হয়নি, এমনকি সেই সুযোগও তৈরি হয়নি। কথা প্রসঙ্গে কবরী বলেছিলেন, ‘অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে কাজ করার খুব আগ্রহ ছিল। তাঁর অভিনয় ও কথাবার্তা মুগ্ধ করত। অমিতাভকে স্বপ্নেও দেখেছি বহুবার।’
মাত্র ১৩ বছর বয়সে নৃত্যশিল্পী হিসেবে মঞ্চে উঠেছিলেন তিনি। তারপর টেলিভিশন ও সবশেষে সিনেমায়। কবরী বিয়ে করেন চিত্ত চৌধুরীকে। সম্পর্কছেদের পর ১৯৭৮ সালে তিনি বিয়ে করেন সফিউদ্দীন সরোয়ারকে। ২০০৮ সালে তাদেরও বিচ্ছেদ হয়ে যায়। কবরী ছিলেন পাঁচ সন্তানের মা। মীনা পাল বা কবরীর প্রথম স্কুল ছিল আলকরণ। থাকতেন চট্টগ্রামের ফিরিঙ্গিবাজারে। আলকরণ স্কুলে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন তিনি। এরপর কবরীর মা তাঁকে জেএম সেন হাইস্কুলে ভর্তি করে দেন। কবরীদের পুরো পরিবারটিই ছিল ভীষণ সংস্কৃতিমনা। বড় বোনদের মধ্যে দুই বোন নাচতেন। ছোট ভাই তবলা বাজাতেন। কবরী নাচ-গান একসঙ্গে করতেন। ৭০ বছরের জীবনে তিনি ৫৬ বছর কাটিয়ে দেন চলচ্চিত্রে।