বাড়ি বিক্রি করে সিনেমা, ‘হুরমতি’ অভিনেত্রীর ববিতা হতে চাওয়ার অজানা গল্প

‘হুরমতি’ সিনেমার পোস্টারে শবনম পারভীন। ছবি: ফেসবুক

আশির দশকের কথা। হঠাৎ শুনলেন গ্রামে শুটিং হচ্ছে। আগ্রহ নিয়ে সেই শুটিং দেখতে গেলেন। ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে গেলেন। ভিড়ের মধ্যে চোখ আটকে গেল একজনের দিকে। তাঁকে চিনতেন না। এটুকু বুঝেছিলেন তিনি নায়িকা। সেই নায়িকাকে দেখেই সেদিনই সিদ্ধান্ত নেন, তাঁর মতো হতে হবে। তারপর যেন পাগলামি পেয়ে বসে। অভিনেত্রী হতেই হবে। পরে ঠিকই শত বাধা পেরিয়ে মানিকগঞ্জ থেকে অভিনয়ে এসেছিলেন। বলছি ইত্যাদির ‘নানি’খ্যাত অভিনেত্রী শবনম পারভীনের কথা। সেদিন তাঁর শুটিংয়ে দেখা সেই অভিনেত্রী ছিলেন ববিতা।

শবনম বলেন, ‘আমাদের বাড়িতে তখন টেলিভিশন ছিল। কিন্তু তাঁর বাবা খবর ছাড়া আর কিছুই দেখতেন না। যে কারণে সিনেমা, নাটক দেখার সুযোগ খুব বেশি ছিল না। পরে শুটিং দেখতে গিয়েই চিনেছিলেন ববিতাকে। সেদিন শুটিং চলছিল আমজাদ হোসেনের ‘সুন্দরী’ সিনেমার। ববিতার সঙ্গে সেই সিনেমায় ছিলেন ইলিয়াস কাঞ্চন, আনোয়ার হোসেনসহ অনেকে।

শবনম পারভীন। ছবি: ফেসবুক

এই অভিনয়শিল্পী বলেন, ‘আমার চোখ ছিল ববিতার দিকে। আমার শুধুই এটাই মনে হয়েছে যেকোনোভাবেই হোক, তাঁর মতো হব আমি। হয়তো তাঁর লাইফস্টাইল, তাঁর অভিব্যক্তি আমাকে মুগ্ধ করেছিল। পরে আমি পারিবারিক বাধার মধ্যে নানা উপায় খুঁজতে থাকি সিনেমায় আসার। একসময় সুযোগও মিলে যায়। সেই সিনেমার পোকা এখনো মাথায় নিয়ে ঘুরছি। আমি শেষ দিন পর্যন্ত সিনেমা করে যাব।’

এই অভিনয়শিল্পী নতুন করে আজ শুক্রবারে বড় পর্দায় মুক্তি পেয়েছে। মূল চরিত্রে অভিনয়ের পাশাপাশি এবার তাঁকে দেখা গেছে এবার একই সঙ্গে পরিচালক, প্রযোজক হিসেবে। সিনেমাটির নাম ‘হুরমতি’। ইতিমধ্যে সিনেমার ট্রেলার, টিজার ও গান প্রকাশ করেছেন। তাঁর প্রধান চরিত্রের অভিনেত্রী হিসেবে বয়স বেশি হওয়ায় সেগুলো নিয়ে কেউ কেউ বিরূপ মন্তব্য করছেন।

শবনম পারভীন। ছবি: ফেসবুক

সিনেমায় অভিনয় নিয়ে ইতিমধ্যে সমালোচনা তৈরি হয়েছে, সেগুলো শুনেছেন তিনি। মন খারাপ করে তিনি বলেন, ‘আমি কি বলেছি সিনেমায় আমার বয়স কত, এখানে তো আমি নায়িকা নই, আমি কি বলেছি আমি স্কুল–কলেজের ছাত্রী, স্কুল–কলেজের পোশাক পরে ফুল ছিটিয়ে প্রেম করছি? এখানে অভিনেত্রী হিসেবে আছি। এটা একটা কমেডি গল্প। গল্পের প্রয়োজনে আমাকে অভিনয় করতে হয়েছে। আর আমি কি প্রধান চরিত্রে অভিনয় করতে পারি না? সমালোচনা না করে সিনেমা দেখে সবাই কথা বললে খুশি হতাম। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে আমাকে ট্রল করছে অনেকে। এখন ট্রলের বাইরে তো জনপ্রিয় নায়ক–নায়িকা, রাজনীতিবিদ কেউ বাদ নেই, সেখানে আমাকে ট্রল নিয়ে অতটা ভাবছি না। সমালোচনা থাকবেই।’

একই সঙ্গে শবনমের পরিচালনা ও প্রযোজনা নিয়েও অনেকে কথা বলছেন। সেসব কথাও তিনি আমলে নেননি। তিনি জানান, এর আগে ‘কুখ্যাত জরিনা’, ‘দুর্ধর্ষ পামেলা’, ‘সত্যের সংগ্রাম’, ‘পাপী শক্র’, ‘ভয়ংকর নারী’সহ একাধিক সিনেমা প্রযোজনা করেছেন। এমনকি কিছু সিনেমা পরিচালনা করেও সহকারীর নাম দিয়েছেন। শবনম বলেন, ‘“দুর্ধর্ষ পামেলা” সিনেমার শুটিং শেষ করে মুক্তি দেওয়ার আগে আমার সহকারী বলল, তার একটা মেয়ে আছে। বিয়ে দিতে হবে। পরিচালক হিসেবে কোনো সিনেমায় তার নাম গেলে পরিবারের জন্য ভালো হয়, তখন আমি আমার নাম না দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে তার নাম পরিচালক হিসেবে দিয়েছি। বিনোদন–দুনিয়ার সবাই জানে, আমি কত সিনেমা–নাটক বানিয়েছি। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে আমার নাম দিইনি। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা আছে জন্যই তো সিনেমা বানিয়েছি।’

শবনম পারভীন। ছবি: ফেসবুক

শবনম শুরু থেকেই নিজে প্রযোজনা করেন, অভিনয় করেন। জানালেন, সিনেমা বানাতে কখনোই লাভ–ক্ষতির চিন্তা করেন না। এ জন্য কঠিন অনেক সিদ্ধান্ত পর্যন্ত নিতে হয়েছে। জানালেন, এর আগে ‘দুর্ধর্ষ পামেলা’ সিনেমার জন্য উত্তরায় জমি বিক্রি করেছিলেন। এবার ‘হুরমতি’ সিনেমার শুটিংয়ের আগে মানিকগঞ্জের চারতলা বাড়ি বিক্রি করেছেন। অনেকের থাকার জায়গা নেই, তাদের কাছে আরও এলাকার জমি বিক্রি করেছেন।
শবনম বলেন, ‘সিনেমার জন্য পরিবার থেকে বিতাড়িত হয়েছি, উত্তরায় জমি, মানিকগঞ্জে চারতলা বাড়ি, আরও অনেক সম্পদ বিক্রি করেছি। লস চিন্তা করে কি বিনিয়োগ হয়? কখনো কখনো টাকা ফিরে এসেছে। কখনো ভালো চলেনি। সিনেমাটাই আমার কাছে সব। এই সিনেমার জন্যই আমি ঘর ছেড়েছি। আমি সিনেমা করেই যাব। এতে কী লাভ আর কী ক্ষতি, সেগুলো ভাবি না। দর্শকদের বিনোদন দেওয়ার চেষ্টা করেই যাব।’
পরিবার থেকে কীভাবে অভিনয়ে এলেন, কেন ত্যাজ্য হতে হলো—এমন প্রশ্নে শবনম পারভীন বলেন, ‘অভিনয়ে আসার জন্য আমি অনেকের সহায়তা নিয়েছি। আমার বান্ধবী, পরিচিত মানুষ, আত্মীয়স্বজনসহ অনেকের সহায়তা চেয়েছি। পরে যাত্রাদলেও কাজ করতে চেয়েছি। ববিতার পরে মানিকগঞ্জেই আরেক শুটিংয়ে অভিনেত্রী সুষমা দিদিকে দেখি। তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয়। পরে অভিনয়ের জন্য আশির দশকে ঢাকায় আসি। বাবার পরিচিত এক বন্ধুর মাধ্যমে ড্রামা সার্কেলে কাজ করি।’

সহশিল্পীদের সঙ্গে শবনম পারভীন। ছবি: ফেসবুক

ড্রামা সার্কেলে ‘চুপ আদালত চলছে’ নাটকের মহড়া চলছিল। সেখান থেকে বৈশাখী নামের আরেক নাট্যদলে যোগ দেন। প্রথম বৈশাখী নাট্যদলে দেশভাগ নিয়ে ‘কুমারখালীর চর’ নাটক মঞ্চায়ন হয়। সেই শুরু হয় অভিনয়ে পথচলা। ক্রমেই কাজ বাড়তে থাকে। সেখান থেকে অন্যদের দেখেই টেলিভিশন, রেডিও, সিনেমায় কাজ করতে থাকেন। ‘নব্বই দশকে আমার পরিচিতি বাড়তে থাকে। আমাকে নিয়ে পত্রিকায় খবরও প্রকাশ পায়। সেই নিউজ দেখেই বাবা ত্যাজ্য করার কথা বলেন। ত্যাজ্য হলেও আমি অভিনয়ের জন্য সব মেনে নিয়েছি। আমি তখনো বলেছি অভিনয় ছাড়তে পারব না, এখন পারব না। আমাকে নিয়ে যতই সমালোচনা, ট্রল করুক, আমৃত্যু অভিনয়ের প্রতি ভালোবাসা থাকবে।’

দীর্ঘ ক্যারিয়ারে শবনম জনপ্রিয়তা পেয়েছেন হুমায়ূন আহমেদের নাটক ও সিনেমায় অভিনয় করে। তখন কাছ থেকে দেখেছেন কমেডি কাজ বলতে কী বোঝায়। যা ছিল সত্যিকারের কমেডি। সেই ধারাতেই তিনি দীর্ঘদিন ধরে কাজ করতে চেয়েছিলেন।

অবশেষে ২০১৯ সালে শুরু করেন ‘হুরমতি’ সিনেমার কাজ। মুক্তির অপেক্ষায় থাকা ‘হুরমতি’ সিনেমার গল্পেও হুমায়ূন আহমেদের কাছ থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছেন উল্লেখ করে শবনম বলেন, ‘হুমায়ূন আহমেদ স্যারের নাটকে আমরা কথা বলতাম, কিন্তু দর্শক বিনোদন পেতেন। সেই ধারাটা আমার কাছে সবচেয়ে ভালো লাগে। আমাদের হুরমতি সিনেমা শতভাগ কমেডি। দর্শক যদি একটুও আনন্দিত হন, তাহলেই আমি খুশি হব।’

শবনম পারভীন। ছবি: ফেসবুক

এ ছাড়া ইত্যাদির নানি চরিত্র দিয়েও শবনম আলোচিত। সেসব কাজের বাইরে ‘হুরমতি’ সিনেমাটি তাঁর ক্যারিয়ারে নতুন কিছু যোগ করবে কি না—এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘অভিনয়শিল্পীর কাজ অভিনয় করে যাওয়া। এই চরিত্রও তো দর্শক প্রশংসা করতে পারে। সবার সব কাজই কি দর্শকের ভালো লাগে? শিল্পীরা বেঁচে থাকে কিছু কাজ দিয়ে। আমি চেষ্টা করে যাচ্ছি। এ বয়সে অভিনয় করছি বলে সমালোচনার কিছু নেই। বরং পাশে থাকলেও বড় মনের পরিচয় দেওয়া হবে। কারণ, আমি কারও ক্ষতি করছি না।’