জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারজয়ী পরিচালক জাহিদুর রহিম অঞ্জনকে শেষবারের মতো শ্রদ্ধা জানানো হয় শাহবাগ জাতীয় জাদুঘরের সামনের রাস্তায়। একদমই শেষ মুহূর্তে সাংস্কৃতিক কর্মীরা সম্মিলিতভাবে জাতীয় সংগীত গেয়ে শ্রদ্ধা জানান। সবশেষে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। নীরবতা পালন শেষে জাদুঘরের দিকে তাকিয়ে আছেন পরিচালক নূরুল আলম আতিক। তাঁর কাছে এগিয়ে যান পরিচালক গিয়াস উদ্দিন সেলিম। জাহিদুর রহিমের প্রয়াণের শোকে হু হু করে কাঁদছেন নূরুল আলম আতিক। তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে জড়িয়ে ধরেন গিয়াস উদ্দিন সেলিম।
বেলা তিনটা। এই পরিচালকের মরদেহ আজিমপুর কবরস্থানে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি চলছে। পাশেই একে অন্যকে জড়িয়ে কাঁদছেন দুই তরুণী। জানা গেল, তাঁরা প্রয়াত এই পরিচালকের শিক্ষার্থী। সহকর্মী কিংবা শিক্ষার্থীদের এই ভালোবাসা মনে করিয়ে দেয়, নতুন করে বলার প্রয়োজন পড়ে না শিক্ষক, চলচ্চিত্রকর্মী বা ব্যক্তি হিসেবে কতটা সফল ছিলেন জাহিদুর রহিম। যিনি পরিচালক নন; বরং নিজেকে চলচ্চিত্রের কর্মী হিসেবে পরিচয় দিতে ভালোবাসতেন। দীর্ঘ কর্মজীবনে তিনি প্রতি পদক্ষেপেই সেই চিহ্ন রেখে গেছেন।
আরেকটি দৃশ্যে দৃষ্টি আটকায়। ‘মেঘমল্লার’ নির্মাতার মরদেহ ফ্রিজিং ভ্যানে রাখা হয়েছে। মাঝখানে কাচের দেয়াল। বাইরে থেকে তাঁকে শেষবারের মতো একনজর দেখতে পরিচালক, সহকর্মীরা ভিড় করেন। শোকের আবহ। অঞ্জনের নিথর দেহের দিকে দীর্ঘ সময় তাকিয়ে আছে ছয়–সাত বছরের এক শিশু। তার হাতে পুতুল। চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে। পাশ থেকে একজন জানালেন, এই শিশুর সবচেয়ে কাছের ছিলেন তার মামা। তাকে পেয়ে মামাও শিশু হয়ে যেতেন। একসঙ্গে আড্ডা, গাছের পরিচর্যা, প্রকৃতি, পশুপ্রেমসহ সবকিছু নিয়েই মেতে থাকতেন। এই শিশুর নাম সুরঞ্জনা। সে জাহিদুর রহিমের ভাগনি। পাশে শিশুটির মা সোনিয়া মিজান ভাইকে হারিয়ে কেঁদেই চলেছেন।
কথা হলো গাজী রাকায়েতের সঙ্গে। এই পরিচালক বলেন, ‘অঞ্জনের সামনে দাঁড়িয়ে আজ আমি আমার নিজেকে দেখছিলাম। ও একটা সুস্থ, সুন্দর জীবন যাপন করত। আজ, এটাই মনে হচ্ছিল, জীবনটা এমনই হওয়া উচিত। একসঙ্গে আমরা শিক্ষক হিসেবে কাজ করেছি। আমাদের উন্নত চলচ্চিত্রের জন্য, বিশ্বমানের চলচ্চিত্রের জন্য, সুস্থ নিওরিয়েলিস্টিক ফিল্মের জন্য অঞ্জনের চেষ্টা, যা রেখে গেল, সেগুলোর জন্য তার বন্ধু, শিক্ষার্থীরা ঋণী হয়ে রইল।’
দল ধরে এসেছেন শিক্ষার্থীরা। সবার চোখেই অভিভাবকতুল্য প্রিয় শিক্ষককে হারানোর শোক। তাসনুভা রহমান নামের এক শিক্ষার্থী জানান, দ্বিতীয় সেমিস্টারে প্রিয় এই শিক্ষকের সহযোগিতায় একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমা বানিয়েছিলেন। কথা ছিল, স্যার সুস্থ হয়ে দেশে ফিরে সেটার ফিডব্যাক দেবেন। তাসনুভা বলেন, ‘আমার শর্টফিল্মে কী ভুল করেছি, সেটা কীভাবে আরও ভালো হতে পারত; এই পরামর্শগুলো তো আর কখনোই স্যারের মতো করে কেউ বলতে পারবেন না। তৃতীয় ও চতুর্থ সেমিস্টারে স্যারকে পাব না, এটা ভাবতেই পারছি না।’ বাংলাদেশ চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী তিনি।
প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ, উপসম্পাদক এ কে এম জাকারিয়াসহ অনেকেই জাহিদুর রহিম অঞ্জনের হঠাৎ প্রয়াণ ও অসুস্থতা নিয়ে কথা বলছিলেন। সে সময়ই ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে উপস্থিত হন সংস্কৃতি উপদেষ্টা ও পরিচালক মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। তাঁদের কথায় প্রাধান্য পায়, চলচ্চিত্রের অন্তঃপ্রাণ মানুষ ছিলেন এই জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারজয়ী প্রয়াত নির্মাতা। শুধু তা–ই নয়, তাঁদের কথায় আরও উঠে আসে, একই সঙ্গে জাহিদুর রহিম ছিলেন প্রাণবন্ত, নিখুঁত আড্ডাবাজ, প্রকৃতিপ্রেমী। যিনি চলচ্চিত্র নিয়ে ছিলেন স্বপ্নবাজ। ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন সাদা মনের মানুষ।
মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ভাষ্যে, ‘একসঙ্গে কিছু মানুষের সঙ্গে বড় হলে অভিজ্ঞতা এতটাই গভীরে থাকে যে হঠাৎ করে স্মৃতিচারণা করা কঠিন হয়ে যায়। যখন তিনি শিক্ষকতা শুরু করেননি, সেই সময়েই আমাদের সিনেমা নিয়ে আড্ডা হতো। স্বপ্ন দেখতাম, আমরা কোনো না কোনো দিন সিনেমা বানাব। যদিও জানতাম, কোনো দিন ছবি বানানো হবে না। ওই সময় থেকে এখনকার সময় পর্যন্ত, এই যে জার্নি, এখানে তাঁরও অবদান রয়েছে।’
গত সোমবার রাত সাড়ে আটটার দিকে বেঙ্গালুরুর একটি হাসপাতালে মারা যান এই পরিচালক। এর কদিন আগেই লিভার ট্রান্সপ্লান্টের অস্ত্রোপচার করা হয়েছিল। অস্ত্রোপচার ও পরবর্তী জটিলতায় তাঁকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। বুধবার সন্ধ্যায় তাঁর মরদেহ ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। বৃহস্পতিবার সকাল নয়টার পর শ্রদ্ধা জানাতে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে। যেখানে তিনি দীর্ঘদিন সিনেমা বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদে জানাজার পর শেষশ্রদ্ধার জন্য বাংলাদেশ শর্টফিল্ম ফোরামের আয়োজনে বেলা দুইটার দিকে মরদেহ নিয়ে আসা হয় শাহবাগ জাতীয় জাদুঘরের সামনে।
শাহবাগে এই পরিচালককে শেষশ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন সাংস্কৃতিক অঙ্গনের মানুষেরা। বেলা তিনটার পর এই পরিচালকের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় আজিমপুর কবরস্থানে। সাড়ে তিনটার পর মায়ের কবরের পাশে তাঁকে দাফন করা হয়। শাহবাগে জাহিদুর রহিমকে শেষশ্রদ্ধা জানাতে আরও উপস্থিত ছিলেন মতিন রহমান, মোরশেদুল ইসলাম, মানজারে হাসীন মুরাদ, আকরাম খান, প্রিন্স মাহমুদ, ফাখরুল আরেফিন খান, জ্যোতিকা জ্যোতি, দিলরুবা দোয়েল, বাংলাদেশ শর্টফিল্ম ফোরামের সভাপতি জহিরুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক রাকিবুল হাসানসহ অনেকে।