দুই বন্ধুর শেষ ইচ্ছাটা পূরণ হলো না

এ টি এম শামসুজ্জামান ও প্রবীর মিত্রকোলাজ

ঢালিউডকে সমৃদ্ধ করা নক্ষত্রগুলো একে একে খসে পড়ছে। দাপুটে এসব গুণী অভিনয়শিল্পী কেউ কেউ নিঃশব্দে, মনে কষ্ট নিয়ে বিদায় নিচ্ছেন। এই বিদায়ে অভিনয় অঙ্গনে তৈরি হচ্ছে শূন্যতা। যা কখনোই পূরণ হওয়ার নয়। সেই শূন্যতা তৈরি করে গত রোববার রাতে বিদায় নিলেন রুপালি পর্দার সাড়া জাগানো আরেক বর্ষীয়ান অভিনেতা প্রবীর মিত্র।

দীর্ঘদিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন এই অভিনেতা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে খুব একটা কথাও বলতেন না। তবে বছর চারেক আগে জানা গিয়েছিল শেষ ইচ্ছার কথা। সেই ইচ্ছা ছিল আবার ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানোর। পরিবার থেকে এ তথ্য জানা গিয়েছিল। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার জন্য শেষ ইচ্ছা আর পূরণ হয়নি। অভিনয়ের জন্য তেমন কেউ আগ্রহ নিয়ে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগও করেননি।

আরও পড়ুন

প্রবীর মিত্রর মতো একই ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন আরেক অভিনেতা এ টি এম শামসুজ্জামান। তিনি ২০২১ সালে মারা যান। এই অভিনেতা অসুস্থ হয়ে প্রতীক্ষায় ছিলেন সুস্থ হয়ে আবার অভিনয়ে ফেরার। প্রবীর মিত্রর মতো তাঁরও শেষ ইচ্ছা পূরণ হয়নি। এই দুই অভিনেতা ছিলেন দীর্ঘদিনের বন্ধু। দুই পরিবারের তথ্যে জানা গিয়েছিল, জীবনের শেষ সময়ে তাঁদের দুজনেরই বয়সটা অভিনয়ের জন্য অতটা জুতসই ছিল না। উভয়ের মনের জোর ছিল প্রবল। অদম্য অভিনয়ের প্রতি টান থেকে দেশের গুণী দুই অভিনয়শিল্পী জানিয়েছিলেন, সুযোগ পেলে জীবনের সবচেয়ে দামি সময় কাটানো সেই লাইট-ক্যামেরা-অ্যাকশনে মুখর হতে চান তাঁরা।

২০২০ সালের শেষের দিকে। তখন এ টি এম শামসুজ্জামান বেঁচে ছিলেন। সেই সময় নিয়মিত জনপ্রিয় এই অভিনেতার খোঁজ নিতে তাঁর স্ত্রী রুনি জামানের সঙ্গে কথা হতো এই প্রতিবেদকের। স্বামী কিছুটা সুস্থ হলে রুনি জামান বলেছিলেন, ‘প্রায় তিন মাস ধরে তাঁর (এ টি এম শামসুজ্জামান) শারীরিক অবস্থা ভালো। এখন বাড়িতে বই পড়েই বেশির ভাগ সময় কাটে। তবে অভিনয়ের নেশা এখনো তাঁর মাথা থেকে যায়নি। বেশ কিছুদিন ধরে তিনি অভিনয় করতে চাচ্ছেন। কোনো নির্মাতা যদি বাসা থেকে নিজ দায়িত্বে নিয়ে যান এবং যথেষ্ট নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন, তাহলে তিনি অভিনয় করবেন।’ সেবার টানা দেড় মাস চিকিৎসা নিতে হয়েছিল এই অভিনেতাকে। কিছুটা সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরেই তিনি স্ত্রীকে মনের কথা জানিয়েছিলেন।

আরও পড়ুন

অন্যদিকে অভিনেতা প্রবীর মিত্র আর্থ্রাইটিসে আক্রান্ত ছিলেন। ২০১৭ সালের মে মাস থেকে তিনি বাসায় বিশ্রামে ছিলেন। সেই থেকে নিয়মিত শুটিংয়ের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল না। চিরচেনা সেই জগৎ থেকে দূরে। তার পর থেকেই তিনি অনেকটা নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করছিলেন। করোনার পর তিনি কিছুটা সুস্থ বোধ করলে পরিবারকে জানিয়েছিলেন অভিনয় নিয়ে আগ্রহের কথা। এমনটিই প্রথম আলোকে জানিয়েছিলেন তাঁর পুত্রবধূ সোনিয়া ইয়াসমিন।

আরও পড়ুন

সে সময় সোনিয়া বলেছিলেন, ‘বাবা অভিনয়ের জন্য ছটফট করছেন। তিনি অভিনয়পাগল। এখনো তাঁর পায়ের ব্যথা আছে। তিনি কিছুটা হাঁটতে পারেন। এ অবস্থায় অবশ্য বাইরে যাওয়া সম্ভব নয়। তবে যদি কোনো নির্মাতা চান, তাহলে আমাদের বাসায় এসে স্বল্প পরিসরে কাজ করতে পারবেন। হয়তো বাবার অভিনয়ের শেষ ইচ্ছাটা পূরণ হবে।’ অসুস্থতা, অভিনয়ের সুযোগ না পাওয়াসহ নানা কারণে সেই শেষ ইচ্ছা পূরণ হয়নি প্রবীর মিত্রর।

আরও পড়ুন

প্রয়াত এই দুই অভিনেতা ছাত্রজীবন থেকেই ছিলেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু। একসঙ্গে অনেক ছবিতে অভিনয় করেছেন। সেই বন্ধুত্ব শেষ সময় পর্যন্ত অটুট ছিল। এমনকি এ টি এম শামসুজ্জামান মারা গিয়েছিলেন, সেই তথ্য প্রবীর মিত্রকে জানানো হয় অনেক পরে। কারণ, বন্ধুর শোকে অসুস্থ শরীর নিয়েই প্রবীর মিত্র ভেঙে পড়তে পারেন, এই ভয়ে প্রবীর মিত্রকে মৃত্যুর সংবাদ সঙ্গে সঙ্গে জানানো হয়নি। বন্ধুর মৃত্যুর খবর যেন দেখতে না পান, সে কারণে প্রবীর মিত্রর ঘরের টেলিভিশনও বন্ধ রাখা হয়েছিল। ঢালিউডে এমন বন্ধুত্ব এখনো বিরল।

আরও পড়ুন

এ টি এম শামসুজ্জামান ও প্রবীর মিত্র পুরান ঢাকায় বেড়ে উঠেছেন। উচ্চমাধ্যমিকে পড়ার সময় তাঁদের মধ্যে ভালো বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। পরে তাঁরা ঢাকাতেই শুরু করেন নাট্যচর্চা। সিনেমা নিয়ে দিনের পর দিন তাঁরা আলোচনা করেছেন। আড্ডা দিয়ে কাটিয়েছেন দীর্ঘ সময়। সেই দুই অভিনেতা এখন ভক্তদের কাছে শুধুই অতীত।
পরিচালক এইচ আকবরের ‘জলছবি’ চলচ্চিত্রে প্রথম অভিনয় করেন প্রবীর মিত্র। অন্যদিকে এ টি এম শামসুজ্জামানের চলচ্চিত্রজীবনের শুরু ১৯৬১ সালে পরিচালক উদয়ন চৌধুরীর ‘বিষকন্যা’ চলচ্চিত্রে সহকারী পরিচালক হিসেবে। তিনি প্রথম কাহিনি ও চিত্রনাট্য লিখেছেন ‘জলছবি’ চলচ্চিত্রের জন্য। সেই ছবি দিয়ে নায়ক হিসেবে বন্ধু প্রবীর মিত্রর অভিষেক হয়। বন্ধুত্বটা আরও গাঢ় হতে থাকে।

কিছু ছবিতে নায়ক হিসেবে কাজ করলেও প্রবীর মিত্র ‘চরিত্রাভিনেতা’ হিসেবেই সবচেয়ে বেশি দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছেন। অন্যদিকে খল অভিনেতা হিসেবে শুরুতে একের পর এক বাজিমাত করতে থাকেন এ টি এম শামসুজ্জামান। দুজনই সত্তরের দশক থেকে ভক্তদের কাছে হয়ে ওঠেন তারকা। এ টি এম শামসুজ্জামানের পর প্রবীর মিত্রর বিদায় প্রশ্ন রেখে যায়, দুই বন্ধুর শেষ ইচ্ছা কি পূরণ করা যেত না?