আমার মতো কষ্ট কোনো নায়িকা করেনি: চিত্রনায়িকা মুনমুন
ছোটবেলায় ওজন নিয়ে স্কুলে বুলিংয়ের শিকার হয়েছেন মুনমুন। গান ও নাচ শিখতেন। সেসব নিয়েও সহপাঠীদের কেউ কেউ তির্যক মন্তব্য করতেন। একসময় সহপাঠীদের মন্তব্যে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েন, ঠিক করেন কিছু করে বন্ধুদের জবাব দেবেন। নায়িকা হওয়ার ইচ্ছা হয়। এই ইচ্ছার কথা বন্ধুরা শুনে আরও হাসাহাসি করতেন। একসময় জেদের বশেই সিনেমার নায়িকা হওয়ার পথে পা বাড়ান মুনমুন। কিন্তু পথটা তাঁর জন্য মসৃণ ছিল না।
মুনমুনদের পরিবার ছিল সংস্কৃতিমনা। নাচ, গান, সিনেমা দেখা ও সিনেমা নিয়ে আলোচনা হওয়া, এমন পরিবেশে বেড়ে ওঠার কারণেই নায়িকা হওয়ার ইচ্ছাটা ছিল। অভিনয় নিয়ে পরিবারেরও কোনো বাধা ছিল না। তবে জানতেন, নায়িকা হওয়া সহজ কথা নয়। এমন হাজারো মেয়ে ঘুরছে নায়িকা হওয়ার জন্য। তাই খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারেন পরিচালক এহতেশামের কথা। তিনি নতুনদের নিয়ে বেশি সিনেমা বানান। এ ছাড়া সেই সময়ে নতুনদের নিয়ে কাজ করা আরেক পরিচালক ছিলেন সোহানুর রহমান সোহান। কিন্তু তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ তো সহজ কথা নয়।
মুনমুন জানান, ‘চেষ্টার পরে তাঁর গানের শিক্ষকের মাধ্যমে গুণী পরিচালক এহতেশামের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করেন। পরে এই পরিচালকের অফিসে দেখা করতে যান। প্রথম দেখাতেই এই পরিচালক তাঁকে পছন্দ করেন। ‘এহতেশাম দাদু আমাকে দেখেই বললেন, “তুমি আমার ছবির নায়িকা হবে। তোমার চেহারাটা আমি ২০ বছর ধরে খুঁজছি।” পরে আমাকে ওজন কমাতে বললেন। প্রথম দিনই তিনি যে আমাকে নায়িকা হওয়ার প্রস্তাব দেবেন, এটা অপ্রত্যাশিত ছিল। আমাকে তিনি নায়িকা বানাবেন, সেটা কল্পনাই করিনি।’
তখন সবে ক্লাস টেনে উঠেছেন। পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে নিয়মিত অভিনয়ের প্রশিক্ষণ নিতেন। এহতেশামের অফিসে যেতেন। নাচ, গান ও অভিনয়ের ওপর পড়াশোনা করতে হতো। এর মধ্যে ১৮ পাউন্ড ওজন কমানোর চ্যালেঞ্জ নেন। অনেকটা সফলও হন। ‘মৌমাছি’ নামের একটি সিনেমার কাজ শুরু করেন এই পরিচালক। মুনমুন ভেবেছিলেন, সেখানে নায়িকা হিসেবেই সুযোগ পাবেন। তবে শাবনূরের পাশে দ্বিতীয় নায়িকা হিসেবে কাজ করতে হবে।
মুনমুন বলেন, ‘এহতেশাম দাদু আমাকে পছন্দ করতেন। তিনি না থাকলে হয়তো আমার সিনেমায় আসা হতো না। দাদুই আমাকে নায়িকা বানিয়েছেন। এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে দাদুর সিনেমায় কাজ করি। তিনিই আমাকে গড়ে তুলেছেন। শুটিংয়ের প্রথম দিন ছিল কান্নাকাটির দৃশ্য। দাদুই শিখিয়েছিলেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, দাদুর এই সিনেমার মাধ্যমে অনেকেই জানতে পারে, মুনমুন নামে একটা মেয়ে আসছে।
শুটিংয়ের মধ্যেই আমি আরও তিনটি সিনেমায় চুক্তিবদ্ধ হই। আমি ব্যস্ত হচ্ছি, এটা দাদু পছন্দ করতেন। পরে সিনেমাটি ফ্লপ হয়। তারপরেও আমার কাজ বাড়তে থাকে।’
সিনেমা মুক্তির আগেই আমিন খান, রাজ্জাকদের সঙ্গে ‘টারজান কন্যা’ সিনেমায় নাম লেখান। এটি পরিচালনা করেছিলেন ফজল আহমেদ। মান্না ও বাপ্পারাজের সঙ্গে জীবন রহমান পরিচালিত ‘আজকের সন্ত্রাসী’, রুবেল ও বাপ্পারাজের সঙ্গে ‘বেঈমানের শাস্তি’, এটি পরিচালনা করেন কমল সরকার। এই তিন সিনেমায় চুক্তিবদ্ধ হন। তাঁর ‘টারজান কন্যা’ ব্যবসায়িকভাবে সফল হয়। পরে মালেক আনসারীর পরিচালনায় ইলিয়াস কাঞ্চনের সঙ্গে ‘মৃত্যুর মুখে’ সিনেমাটিও তাঁকে দর্শকদের কাছে নিয়ে যায়। তবে এসব সিনেমায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাঁকে দেখা যেত মারধর করতে। কিন্তু মুনমুন চাইতেন রোমান্টিক গল্পে অভিনয় করতে।
মুনমুনের ভাষ্যে, ‘আমি একসময়ে ২০ থেকে ৩০টা সিনেমায় অভিনয়ের প্রস্তাব পেয়েছি। সব সিনেমাই অ্যাকশন। আমাকে মারামারি করতে হবে। আমি রোমান্টিক গল্প না পেয়ে একচেটিয়া অ্যাকশন সিনেমা নিতে থাকি। অ্যাকশন নায়িকা মানেই আমি। আমি দিন–রাত পরিশ্রম করেছি। সারা দিন ফাইট দৃশ্যে অভিনয় করেছি, পরে আমার নাচের দৃশ্য। মারামারি দিয়ে সকাল শুরু হতো আর নাচতে নাচতে রাত শেষ হতো। এটা অভিনেত্রী হিসেবে কঠিন কাজ। আমার মতো কষ্ট কোনো নায়িকা করেনি। অনেকে এসেছে কিন্তু সফল হয়নি।’
মুনমুন সেই সময়ে বেশ কিছু সিনেমার জন্য যেমন সমালোচিত হতে থাকেন, তেমনি অ্যাকশন দৃশ্যের জন্যও সহকর্মীদের কাছে প্রশংসা পেতে থাকেন। মুনমুন জানান, অ্যাকশন দৃশ্যে অভিনয় করতে গিয়ে তাঁর দাঁত পর্যন্ত ভেঙেছে। বহুবার হাতে, পায়ে ও মুখে আঘাত পেয়েছেন। তবে রোমান্টিক ও সামাজিক সিনেমা নিয়ে তাঁর আক্ষেপ আছে। তিনি বলেন, ‘আমাকে কেউ রোমান্টিক গল্পে ডাকেননি। রোমান্টিক নাচও আমাকে দিয়ে কেউ করাননি। ইন্ডাস্ট্রির লোকেরা আমাকে দিয়ে প্রচুর পরিশ্রম করিয়েছেন। মনে হয় না আর কেউ আমার মতো সকাল থেকে রাত পর্যন্ত শুধু শুটিং আর শুটিং করে যেত। শুটিংয়ে গিয়ে দিন–রাত আমাকে পরিশ্রম করতে হয়েছে। শুটিং করতে গিয়ে আমি বহুবার অসুস্থ পর্যন্ত হয়েছি।’