আহমেদ রুবেলকে নিঃসঙ্গ করে দেওয়া হয়েছে! অরুণা বিশ্বাসের ক্ষোভ
‘চাপা ডাঙার বউ’ চলচ্চিত্রে দিয়ে বড় পর্দায় যাত্রা শুরু অরুণা বিশ্বাসের। নায়করাজ রাজ্জাকের হাত ধরে ১৯৮৬ সালে পথচলা শুরু করা অরুণার বিশ্বাসের অভিনয়জীবন চার দশক ছুঁই ছুঁই। আজ শুক্রবার সকালে তাঁর ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়ে জানিয়েছেন, সিন্ডিকেটের নামে সব গুণী শিল্পীগুলোকে কাজ না দিয়ে ঘরে বসিয়ে রেখে জীবিত মেরে ফেলা হচ্ছে। আর মঞ্চে চলছে দাঁড়িয়ে হাহুতাশ। অসম্মান, অশ্রদ্ধা এসব পাওয়ার জন্য শিল্পীর জন্ম নয়।
কী কারণে এমনটা লিখেছেন, তা ফেসবুক পোস্টে উল্লেখ করেননি। এরপর প্রথম আলোর পক্ষ থেকে কথা হলে জানান, গেল বুধবার মারা যাওয়া শক্তিমান অভিনয়শিল্পী আহমেদ রুবেলের মৃত্যু তাঁকে নাড়া দিয়েছে। এক যুগের বেশি সময় ঢাকা ছেড়ে গাজীপুরের জয়দেবপুরে নিজ বাড়িতে গিয়ে থাকা শুরু করেন। আশির দশকের মাঝামাঝি কলেজ পড়তে ঢাকায় আসা আহমেদ রুবেল জীবনের দুই যুগ কাটান। অভিনয়ের ব্যস্ততা কমে যাওয়ায় নতুন কোনো কাজে যুক্ত হলে তবেই ঢাকায় আসতেন। এর বাইরে অন্য সময়টায় জয়দেবপুরের ছায়াবীথি এলাকায় থাকতেন। অরুণা বিশ্বাসের মতে, আহমেদ রুবেলের মতো অভিনয়শিল্পী সিন্ডিকেটে কোণঠাসা হয়ে পড়েছিলেন। তাই কাজের ব্যস্ততা কমে যায়।
রাগে ক্ষোভে অরুণা বিশ্বাস ফেসবুকে লিখেছেন, ‘অখাদ্য-কুখাদ্য জোর করে গেলাচ্ছেন, বলছেন দর্শকের রুচি খারাপ। সিন্ডিকেটের নামে সব গুণী শিল্পীকে কাজ না দিয়ে ঘরে বসিয়ে রেখে জীবিত মেরে ফেলছেন, আর মঞ্চে দাঁড়িয়ে হাহুতাশ। অসম্মান, অশ্রদ্ধা এসব পাওয়ার জন্য শিল্পীর জন্ম নয়।
ফেসবুক পোস্টের পরিপ্রেক্ষিতে অরুণা বিশ্বাস বলেন, ‘আজকে আহমেদ রুবেল মারা গেছে। সবাই অনেকে দুঃখ প্রকাশ করতেছে। ঠিকাছে। অনেকে আবার এও বলছেন, তিনি দেরি করে সেটে আসতেন। ফরীদি ভাই সম্পর্কেও এ রকম বলতে শুনেছি। আরে ভাই, গুণী শিল্পীরা একটু এ রকম হয়। তাঁরা একটু যদি এ রকম করেনও, আমাদের মতো ক্ষুদ্র মানুষদের এগুলো মেনে নেওয়া উচিত। আমি মনে করি, দেশের স্বার্থে, সংস্কৃতির স্বার্থে, শিল্পের স্বার্থে এসব মেনে নেওয়া উচিত। এখনো অনেক গুণী শিল্পী, তাঁদের সম্মান, শ্রদ্ধা ও যত্নে আগলে রাখা উচিত। কাজের মধ্যে রাখা উচিত। তাঁদের নিয়ে নতুন সব চরিত্র ভাবা উচিত।’
কথায় এসেছে সিন্ডিকেট প্রসঙ্গও। এ নিয়ে অরুণা বিশ্বাস বললেন, ‘সিন্ডিকেট বিষয়টা একটা সংগঠনের মতো। আমরাও তো একটা সময় কাজ করেছি। রাজ্জাক (নায়ক রাজ্জাক) কাকু, শিবলী (শিবলী সাদিক) ভাই, মাহফুজ (মাহফুজুর রহমান খান) ভাই— তাঁরা কখনোই বলেননি, তোমরা ওখানে কাজ করবা না। একে–ওকে নেওয়া যাবে না। তাঁকে নেওয়া যাবে না। এগুলো তো আমরা বুঝিও নাই। জানিও না। এই যে এখন এত এত আলোচিত কাজ হচ্ছে, বেশির ভাগ জায়গায় অশালীল সংলাপে ভরা। আমি সেদিন তথাকথিত একটা বেশ আলোচিত ফিল্ম দেখলাম। স্বামী–স্ত্রী একে অপরকে এত বাজে ভাষায় গালাগালি করতেছে! দেখে বেকুব বনে গেলাম। আরে আমরা তো ওভাবে বড়ই হয়নি।’
সেই আলোচিত ফিল্মের নামটা কী জানতে চাইলে বলেননি অরুণা বিশ্বাস। উত্তরটা দিলেন এভাবে, ‘নামটা মনে আছে, কিন্তু মুখে আনতে চাই না। নাম নিলে আরও হাইলাইটস করা হবে। অথচ যে দুজন অভিনয়শিল্পী এসব সংলাপ দিচ্ছেন, তাঁরাও কিন্তু দুর্দান্ত অভিনয়শিল্পী, কিন্তু এমন অশালীন গালিগালাজ! এ রকম আরও অনেক ভালো অভিনয়শিল্পী আছেন, যাঁদের দর্শক দেখতে চান। কিন্তু তাঁরা সেই সুযোগ পাচ্ছেন না। অনেক গুণী শিল্পী আছেন, যাঁরা বসে আছেন। কাজ করতে চান। অনেক সিনিয়র শিল্পীও আছেন, শিল্পের পথে যাঁদের দীর্ঘ ভ্রমণ, যাঁরা এটাই শুধু অভিনয়টাই শিখেছেন। অভিনয়টাই করে গেছেন আজীবন—সেই তাঁরাও দিনের পর দিন কাজ থেকে বঞ্চিত। সেদিন এক আড্ডায় কয়েকজন সিনিয়র শিল্পী দুঃখ প্রকাশ করেছেন। এত বড় মাপের শিল্পী তাঁরা, সম্মান রক্ষাথে নাম নিচ্ছি না। আমি নিজেও তো সেভাবে ভালো কোনো কাজের জন্য ডাক পাই না।
কাজ কিন্তু আয় রোজগারের জন্য না। আমি নাহয় সারভাইব করছি। সত্যিকারের শিল্পীদের আসলে শিল্পের একটা খুদা আছে। সব সময় এখানে টাকাপয়সা ম্যাটার করে না। আজকে, এই বয়সে অমিতাভ বচ্চন যে কাজ করছেন, তিনি কি শুধু টাকার জন্যই কাজ করছেন? সৌমিত্র চট্টোপধ্যায় মৃত্যুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত অভিনয় করে গেছেন। এসব কি টাকার জন্যই?— এসব আসলে শিল্পের খুদা। আমরা তো এখন একজন আরেকজনকে সঠিকভাবে শ্রদ্ধা করতেই শিখিনি। আহমেদ রুবেল মারা যাওয়ার পর এসব আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।’ বললেন অরুনা বিশ্বাস।
আহমেদ রুবেলের সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে জানিয়ে অরুণা বিশ্বাস বললেন, ‘এই ভদ্রলোককে নিয়ে আমি কাজ করছি। কালকে দেখলাম পরিচালক আমিতাভ রেজা বলছেন, আহমেদ রুবেল মানুষটা খুব নিঃসঙ্গ ছিলেন। আমি তো বলব, আহমেদ রুবেলকে নিঃসঙ্গ করে দেওয়া হয়েছে। তাঁকে তো অনেক দিন ধরে কাজই দেওয়া হয়নি। তিনি যদি কাজের মধ্যে থাকতেন, আনন্দেই থাকতেন। মনটা সতেজ থাকত। অথচ আজ মরার পর কতশত নিউজ। কত অ্যাঙ্গেলের নিউজ। অথচ বেঁচে থাকা অবস্থায় যদি এর অর্ধেক গুরুত্ব দিয়েও যদি তাঁর খবর নেওয়া হতো, তাঁর ঢাকা ছেড়ে জয়দেবপুর চলে যাওয়া লাগত না। আমার ধারণা, এসব তাঁকে অনেক কুড়ে কুড়ে খেয়েছে। কোনো মানুষকে নিসঃঙ্গ করে দেওয়া অপরাধ, যা আহমেদ রুবেলের ক্ষেত্রে ঘটেছে। অথচ তিনি দেখতে সুন্দর, কী বলিষ্ঠ কণ্ঠ, কী অসাধারণ সংলাপ বলতেন—তাঁর তো এভাবে নিঃসঙ্গ হওয়ার কথা নয়। সময় থাকতে আমাদের গুণী অন্য শিল্পীদের নিয়ে এখনই ভাবতে হবে।’