রাজ্জাক বলতেন, ‘আমার জীবনটাই একটা সিনেমা...’
‘আয়নাতে ওই মুখ দেখবে যখন/ কপোলের কালো তিল পড়বে চোখে/ ফুটবে যখন ফুল বকুলশাখে/ ভ্রমর যে এসেছিল জানবে লোকে’ বাংলা সিনেমার গানের ইতিহাসে এই গানের মর্যাদা অন্য রকম। অশোক ঘোষ পরিচালিত বাংলাদেশি নাট্য চলচ্চিত্র ‘নাচের পুতুল’–এর গান এটি। কে জি মোস্তফার লেখা গানটি শোনা যায় মাহমুদন্নবীর কণ্ঠে। জীবনঘনিষ্ঠ গল্পের এই সিনেমায় প্রেম, ভালোবাসা, লড়াই, সংগ্রাম—কী নেই! দেখলে মুগ্ধ হতে হয়। নানান প্রশস্তি ইউটিউবে গানটির মন্তব্যের ঘরে লিখেছেন দর্শকেরা। পাশাপাশি অভিনেতা-অভিনেত্রীরও প্রশংসা করেছেন। নীল নামে একজন লিখেছেন, ‘এই প্রজন্মের হয়েও গানটা এতটাই ভালো লাগে যে আমি প্রেমে পড়ে যাই। কত সুন্দর ছিল আমাদের সিনেমার সোনালি সময়। প্রয়াত নায়করাজ রাজ্জাক, তুমি সেই সময়ের বাংলা সিনেমার বাদশাহ।’
সিনেমা দিয়ে মানুষের হৃদয়ে আসন করে নেওয়া ‘বাংলা সিনেমার বাদশাহ’ আবদুর রাজ্জাকের জন্মদিন ছিল গতকাল ২৩ জানুয়ারি। ১৯৪২ সালে এই দিনে জন্মেছিলেন তিনি। ‘নায়করাজ রাজ্জাক’ নামেই তিনি সুপরিচিত। সিনেমা দিয়েই তাঁর উত্থান।
জীবনও যেন এক পূর্ণাঙ্গ সিনেমা তাঁর। নিজেই বলতেন এ কথা। বলতেন, ‘আমার জীবনটাই একটা সিনেমা...।’ তিন ভাইবোনের মধ্যে রাজ্জাক ছিলেন সবার ছোট। কলকাতার নাকতলা এলাকার জমিদার বংশের সন্তান তিনি। সচ্ছল-সুখী পরিবেশে বেড়ে ওঠেন। পড়াশোনায় মন বসত না। স্কুলজীবনেই অভিনয়ে হাতে খড়ি।
পর্দায় রাজ্জাকের শুরুটা হয়েছিল একেবারেই ছোট চরিত্র দিয়ে, সিনেমার ভাষায় যাকে বলে, ‘এক্সট্রা’। কলেজে পড়ার সময় চলচ্চিত্রে প্রথম অভিনয়ের সুযোগ পান। অজিত ব্যানার্জির ১৯৫৮ সালের ছবি ‘রতন লাল বাঙালি’। সিনেমাটির মূল চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন আশিস কুমার ও নায়িকা সন্ধ্যা রায়। ছোট্ট একটি চরিত্র ছিল রাজ্জাকের—পকেটমার। তৃতীয় ছবি ‘শিলালিপি’। এই সিনেমায় একটি গানের দৃশ্যে অতিরিক্ত শিল্পী হিসেবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। সম্মানী পেয়েছিলেন ২০ টাকা। এই সম্মানী রাজ্জাকের আস্থা আর উৎসাহ বাড়িয়ে দেয়। অবশ্য তিনি বুঝেছিলেন যে টালিগঞ্জে সুবিধা করতে পারবেন না। এখানে থাকলে ‘এক্সট্রা’ হয়েই থাকতে হবে। তাই নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে পাড়ি জমালেন মুম্বাইয়ে (তখনকার বোম্বে)। নায়ক হওয়ার আশা নিয়ে ভর্তি হলেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ফিল্মালয়ে। পাশাপাশি মুম্বাইয়ের চিত্রজগতে ঢোকার সুযোগ খুঁজতে থাকেন, কিন্তু বিষয়টি শুধু কঠিন নয়, অসম্ভবই ছিল। তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই কলকাতায় ফিরে এলেন রাজ্জাক।
১৯৬২ সাল। রাজ্জাক কলকাতার বাঁশদ্রোণী এলাকার খায়রুন্নেসার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলেন। কোল আলো করে এল পুত্রসন্তান। এর কিছুদিনের মধ্যে কলকাতায় দাঙ্গা বাধে। ১৯৬৪ সালের ২৬ এপ্রিল স্ত্রী ও শিশুপুত্র বাপ্পাকে নিয়ে ঢাকায় পাড়ি জমান রাজ্জাক। পরিবার নিয়ে ৮০ টাকা মাসিক ভাড়ায় একটি বাসায় থাকতে শুরু করেন।
পত্র-পত্রিকা সূত্রে জানা যায়, ঢাকায় পাড়ি দিয়ে অভিনয়সংশ্লিষ্ট কাজ খুঁজতে শুরু করেন রাজ্জাক। ঢাকায় তখন উর্দু সিনেমার ব্যাপক প্রসার। একের পর এক উর্দু সিনেমা নির্মিত হচ্ছে। কী করি, কী করি ভাবতে ভাবতে মঞ্চনাটকে অভিনয় শুরু করেন। যা টাকা পান, তা দিয়ে ঠিকমতো সংসার চলে না। এ প্রসঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছিলেন, ‘অল্প আয়ে সংসারের খরচ চলে না। বাচ্চাদের দুধ জোগাড় করতেই সব টাকা ব্যয় হয়ে যেত। ওই সময় স্বামী-স্ত্রী দুজন মাঝেমধ্যে উপোসও করতাম। পয়সার অভাবে ফার্মগেট থেকে ডিআইটি টিভি কেন্দ্রে হেঁটে যাতায়াত করতাম।’
নির্মাতা কামাল আহমেদের ‘উজালা’ নামের সিনেমার চতুর্থ সহকারী পরিচালক হিসেবেও কাজ করেছেন রাজ্জাক। ঢাকার ইন্ডাস্ট্রিতে এটি তাঁর প্রথম কাজ। এরপর ‘পরওয়ানা’ সিনেমায়ও সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেন। কিন্তু পরিবারের অভাব-অনটন কাটছে না। অভিনয়ের সুযোগ পাওয়ার আশায় তিনি ঘুরছেন। এর মধ্যে ‘ঘরোয়া’ নামের একটি টিভি ধারাবাহিকে অভিনয় শুরু করলেন। পাশাপাশি চলচ্চিত্রে কাজ করার সুযোগও খুঁজতে থাকলেন। একদিন চলচ্চিত্রের পর্দার সামনে থাকার সুযোগ মিলে গেল। ১৯৬৫ সালে, ‘আখেরি স্টেশন’ ছবিতে সহকারী স্টেশন মাস্টারের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন তিনি। এরপর আরও বেশ কয়েকটি ছবিতে বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি। যেমন ‘কার বউ’ ছবিতে অটোরিকশাচালক (বেবিট্যাক্সি ড্রাইভার), ‘১৩ নম্বর ফেকু ওস্তাগার লেন’-এ পাড়ার ছেলে মিন্টু, ‘ডাকবাবু’তে আদালতের কর্মচারী, ‘কাগজের নৌকা’য় মাতাল।
ঢাকায় সিনেমার উঠোনে হাঁটতে হাঁটতে একসময় পরিচয় হয় জহির রায়হানের সঙ্গে। তিনি রাজ্জাককে ‘বেহুলা’ ছবিতে নেন। এই সিনেমার সাইনিং মানি হিসেবে নগদ ৫০০ টাকা পেয়েছিলেন রাজ্জাক। ‘বেহুলা’ চলচ্চিত্রে নায়ক হিসেবে আবির্ভাবের পর রাজ্জাককে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ক্রমান্বয়ে খ্যাতির শীর্ষে উঠেছেন তিনি। নিজের মেধা ও প্রতিভার সবটুকু দিয়ে তিলে তিলে প্রস্তত করেছেন নিজেকে। দুহাতে আঁকড়ে রেখেছেন নিজের ‘অভিনেতা’ হওয়ার স্বপ্নকে। দেখিয়ে দিয়েছেন, স্বপ্ন আর পরিশ্রম দিয়ে এক্সট্রা থেকেও নায়ক হওয়া যায়। জিতে নেওয়া যায় ‘রাজা’র আসন। দীর্ঘ অভিনয়জীবনে তাঁর ঝুলিতে রয়েছে প্রায় ৩০০ বাংলা ও উর্দু ভাষার চলচ্চিত্র।