স্মৃতিকাব্যে প্রিয়মুখ
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে কবরী এক বিরল নক্ষত্রের নাম।
কিংবদন্তিতুল্য এই শিল্পী ‘সুতরাং’, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ অথবা ‘সারেং বৌ’সহ আরও অনেক ছবিতে অভিনয় করেছেন। ইতিহাস সৃষ্টি করা বহু ছবিতে অভিনয় তাঁকে নিয়ে গেছে এক ভিন্ন উচ্চতায়। এক ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তার শিখরে তিনি অবস্থান করছেন। পেয়েছেন একাধিকবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, মেরিল প্রথম আলো পুরস্কার, ঋষিজ পদকসহ দেশে-বিদেশের অনেক পুরস্কার। জাতীয় চলচ্চিত্রে পেয়েছেন আজীবন সম্মাননা। মহান মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদান রেখেছেন, মাস্টারদা সূর্য সেন, প্রীতিলতা যুদ্ধবীর চট্টলার কন্যা কবরী।
সেই শৈশব থেকেই অত্যন্ত রাজনীতিসচেতন কবরী হয়েছিলেন সংসদ সদস্য। পরবর্তী পর্যায়ে সংসদ সদস্য না হলেও তাঁর প্রতিবাদী ভূমিকা অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই তাঁকে স্মরণীয় করে রাখবে। তিনি সব সময় প্রগতিশীল মানবিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
সেদিনও কুমিল্লার তনু হত্যার প্রতিবাদে তাঁকে সোচ্চার হতে দেখেছি। অসহায় তনুর পরিবারের পাশে থাকার প্রত্যয় ঘোষণা করেছিলেন। বিশেষ করে গেল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ঢাকা উত্তর থেকে মেয়র প্রার্থী হয়েছিলেন এই আপসহীন সাবেক সংসদ। পরবর্তী পর্যায়ে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালেও তাঁর সাহস ও প্রতিবাদের কথা নগরবাসী বহুকাল স্মরণে রাখবে।
তবে গুণী এই অভিনেত্রী যে কারণে দর্শক হৃদয়ে আজও অমিলন, সেটি হচ্ছে তাঁর মিষ্টি হাসি, সেই স্নিগ্ধ হাসির জন্য যিনি সবার কাছে মিষ্টি মেয়ে কবরী নামের খ্যাত। আমি আমার স্মৃতি কাব্যে সেই মিষ্টি মেয়ে কবরীর প্রিয় মুখই তুলে ধরতে চাই।
মিষ্টি মেয়ে কবরীর জন্ম ১৯৫০ সালে চট্টগ্রামের এক সাংস্কৃতিক পরিবারে। তাঁর বাবার স্বপ্ন ছিল মেয়ে ভালো নৃত্য শিল্পী হিসেবে দ্যুতি ছড়াক। সেই কারণেই শৈশব থেকে কবরী উচ্চাঙ্গ নৃত্যচর্চায় নিজেকে পারদর্শী করে তোলেন। মাত্র ১২ বছর বয়সে প্রথম মঞ্চে নৃত্য পরিবেশন করে তাঁর ব্যতিক্রম প্রতিভার পরিচয় দেন। তখন থেকেই কবরী তাঁর প্রতিভাগুণে সবার নজর কাড়েন। মূলত সেই সময় থেকে চলচ্চিত্রে অভিনয়ের প্রস্তাব আসতে থাকে। এত অল্প বয়সে, পড়াশোনার ব্যাঘাত ঘটিয়ে কবরী চলচ্চিত্রে নাম লেখান এটা কখনোই পরিবার মেনে নিতে পারেনি। কিন্তু কবরী স্বপ্ন দেখেছিলেন রুপালি পর্দার তারকা হওয়ার। অবশেষে কবরীর ইচ্ছাশক্তির কাছে সবই হার মানে। চট্টলার সেই সরল-সহজ মেয়েটি ১৯৬৪ সালে মাত্র ১৪ বছর বয়সে জীবনে প্রথম ক্যামেরার সামনে অনায়াসে দাঁড়ালেন।
ছবির নাম ‘সুতরাং’ আর প্রথম নায়ক সুভাষ দাও। আর আমি আমার স্মৃতিকাব্যের সেই মাইলস্টোন ছবি ‘সুতরাং’ আর নায়িকা কবরীর কথা এখানে তুলে ধরছি। তখন ১৯৬৬ সাল, আমি মহকুমা শহর মাদারীপুরে এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছি। মাদারীপুরের প্রেক্ষাগৃহে তখন ‘সুতরাং’ ছবির তুমুল জনপ্রিয়তা। একদিকে পরীক্ষার চিন্তা, অন্যদিকে ছবিটি দেখার ব্যাকুলতা। বাল্যবন্ধু বীর মুক্তিযোদ্ধা আলমগীর আর কবিরাজপুরের রুশো আমাকে ছবিটি দেখার প্রেরণা জোগায়। অবশেষে পরীক্ষার বিরতিতে ছবিটি দেখতে যাই মাদারীপুরের জনপ্রিয় মিলন সিনেমা হলে।
তবে এটাই আমার প্রথম ছবি দেখা নয়। এর আগেও একবার শহর দেখার জন্য, ছবি দেখার জন্য আমার বন্ধুসম চাচাতো ভাই শহীদের সঙ্গে বাড়ি পালিয়ে মাদারীপুর শহরের দুটি সিনেমা হলে দুটি ছবি দেখেছিলাম। আর এবার দেখি মিষ্টি মেয়ে কবরী অভিনীত ‘সুতরাং’ ছবিটি। কবরীকে প্রথম দেখাতেই মুগ্ধ হই। ছবিতে তাঁর অসাধারণ উপস্থিতি, মায়াবী চোখ, মাধুর্যময় কণ্ঠস্বর, চঞ্চলতা, মধুমাখা হাসি, বাঙালি সৌন্দর্যের এক অসাধারণ, স্নিগ্ধ, নিখুঁত, মিশ্রণ আমার কিশোর মনে গভীরভাবে দাগ কাটে, যা আজও অমলিন সেই ক্ল্যাসিক ‘সুতরাং’ ছবির মতোই। এখনো ঘিয়েরাঙা শাড়িতে তাঁকে অপূর্ব দেখায়। মন থেকে কখনোই ভুলতে পারি না প্রথম দেখা ‘সুতরাং’ ছবির স্মৃতি।
সেই ছবি সংলাপ, গান আজও সবার মুখে মুখে। অভিনয় জীবনের সূচনাতে কবরী চিত্রামোদীদের মন হরণ করেন। তাঁর সারল্য সৌন্দর্য, মিষ্টি হাসি বাংলা চলচ্চিত্রের দিগন্ত উন্মোচন করে। তবে কবরীর জনপ্রিয়তার উল্লেখযোগ্য দিক উন্মোচিত হয়েছে নায়ক রাজ্জাকের সঙ্গে জুটির অসামান্য সাফল্যে।
রাজ্জাক-কবরী জুটির গত শতাব্দীর ষাট আর সত্তর দশকে ছিল দারুণ জনপ্রিয়। এ জুটির ‘নীল আকাশের নীচে’ ‘যে আগুনে পুড়ি’ ‘দর্পচূর্ণ’, ‘স্মৃতিটুকু থাক’, ‘রংবাজ’, ‘বেঈমান’, ‘কাঁচকাটা হীরে’সহ অসংখ্য ছবি আছে, যা দর্শক মন গভীরভাবে ছুঁয়েছে। বিশেষ করে ছুঁয়েছে আমার মন। আমার এবং কবরীর জন্ম ১৯৫০ সালে। আমরা সমবয়সী হলেও শিল্পী হিসেবে ছিলেন আমার সিনিয়র। পর্দায় তাঁর ঋজু ব্যক্তিত্ব, সংবেদনশীল মন, মানবিক আচরণ, রাজনৈতিক সচেতনতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, মানুষের জন্য ভালোবাসা আমাকে সব সময়ই মুগ্ধ করেছে। তারুণ্যে তাইতো তুমি ছিলে প্রিয়ার প্রতীক।
কৈশোরে তুমি প্রেমজাগানিয়া নায়িকার মিষ্টিমুখ, হৃদয়জুড়ে স্থান করে নিয়েছ। তাই তো তোমার অভিনীত ‘সাত ভাই চম্পা’, ‘সারেং বৌ’, ‘অরুণ বরুণ কিরণমালা’, ‘মতিমহল’, ‘বিনিময়’, ‘দেবদাস’, ‘সুজন সখী’ তোমাকে দিয়েছে অমরত্ব।
এসব ছবি যেন মিষ্টি মেয়ে কবরীরই গল্প। এ কেবল সুভাস দত্ত, রাজ্জাক, উজ্জ্বল, সোহেল রানা, আলমগীর, ফারুক, জাফর ইকবাল কিংবা বুলবুল আহমেদের গল্প নয়, লক্ষ-কোটি দর্শক হৃদয়ের উৎসারিত ভালোবাসার গল্প। প্রেম জাগানিয়া বাংলার কন্যা তুমি চিত্রবিরহী নাগরিক কবিয়ালের অনাশ্রিত প্রেমের অঞ্জলি তুমি নাও।
এ প্রসঙ্গে আমি তপন বাগচীর কথায় কবরীকে নিয়ে আমার গানের চরণগুলো এখানে তুলে ধরছি।
কী ছায়াছবিতে, দোলাও নিভৃতে
অমন বিনোদ কবরী।
তুমি নানা রূপে, সাজো চুপে চুপে
নন্দিনী কি শর্বরী।
মাতিয়েছ তুমি প্রিয় দেশভূমি
নেচে হেসে অভিনয়ে
দেহের চলনি যেন সুরধ্বনি
ছুটে চলে মৃদু লয়ে
দেখেছো কি কেউ
খেলে কী যে ঢেউ
থাকো নাই হয়ে আবর–ই।
মঞ্চের মেয়ে দেশপানে চেয়ে
আজ হলে জননেত্রী।
সমাজের সেবা করে আর কে-বা
নও শুধু অভিনেত্রী
মানুষের পাশে আছো বিশ্বাসে
জানি তো সকল খবর-ই
তব মধুনামে শহরে বা গ্রামে
খুশিতে সকলে ভাসে
তুমি বেঁচে রবে
সরবে নীরবে
সিনেমার ইতিহাসে
তুমি নটরানি আকুল পরানি সেই মিনা পাল...