করোনা সংকট কাটিয়ে সিনেমা মুক্তি ও নির্মাণের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। তবে বাণিজ্যিক ঘরানার সিনেমায় নায়িকা–সংকটে ভুগছে চলচ্চিত্রাঙ্গন। নায়িকা আছেন অনেকে কিন্তু দর্শক গ্রহণযোগ্য নায়িকার সংকট আছে বলে জানিয়েছেন প্রযোজক-পরিচালকেরা। এ কারণেই সিনেমায় দর্শক কমছে, ব্যবসা করতে পারছেন না প্রযোজকেরা।
প্রথম সারির কয়েকজন নায়িকার হাতে এই মুহূর্তে একাধিক নতুন সিনেমা নেই। এ তালিকায় আছেন অপু বিশ্বাস, পরীমনি, মাহিয়া মাহি, বিদ্যা সিনহা মিম, ববি, নুসরাত ফারিয়াসহ অনেকে। শবনম বুবলী, পূজা চেরিদের হাতে সিনেমা থাকলেও প্রেক্ষাগৃহে খুব একটা দর্শক টানতে পারছেন বলা যাবে না। তা ছাড়া চলতি বছরে জাহারা মিতু, নিশাত সালওয়া, স্পর্শিয়া, রাজ রীপাসহ হাফ ডজন নতুন নায়িকার ছবি মুক্তি পেতে যাচ্ছে। এসব ছবির মাধ্যমে পর্দায় অভিষেক হবে তাঁদের। কিন্তু এই নায়িকারাও দর্শক টানতে পারবেন কি না, তা নিয়ে শঙ্কার মধ্যে আছেন পরিচালকেরা।
প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান জাজ মাল্টিমিডিয়ার সিনেমায় অভিনয় করে একাধিক নায়িকার অভিষেক ঘটে ঢালিউডে। শুরুর দিকে দু-একজন জনপ্রিয় হয়ে উঠলেও পরবর্তী সময়ে কেউ কেউ হারিয়ে গেছেন। নায়িকা–সংকটের বিষয়টি ভাবাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটিকেও। এ প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার আবদুল আজিজ বলেন, ‘এখন ছবি নির্মাণ করতে গেলে নায়িকা পাওয়া যাচ্ছে না। যেসব নায়িকা এখন ঢাকার চলচ্চিত্রে কাজ করছেন, তাঁদের নিয়ে খুব একটা এগোনো যাচ্ছে না।’
চলচ্চিত্রে নতুন নায়িকার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু ভালো মানের অভিনেত্রী পাওয়া মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। পরিচালক সমিতির সভাপতি সোহানুর রহমান সোহান বলেন, ‘হলিউড, বলিউড কিংবা টালিউডে নায়ক-নায়িকাকে সম্মানের চোখে দেখা হয়। কিন্তু আমাদের চলচ্চিত্রে এখন সেই পরিবেশ নেই। এ কারণে অনেকেই চলচ্চিত্রে অভিনয়ে আসতে চায় না।’ এমন পরিস্থিতির জন্য চলচ্চিত্রের গুটিকয় মানুষকেও দায়ী করলেন এই পরিচালক। তিনি বলেন, ‘আমাদের ইন্ডাস্ট্রির কিছু মানুষ বিগত দিনগুলোতে এমন সব পরিস্থিতি তৈরি করেছে, যে কারণে অনেকে সিনেমার নায়িকা হতে চায় না। সবাই যাতে এখানে কাজ করতে আগ্রহী হয়, সেই পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে। “নায়িকা” যে একটা সম্মানের ব্যাপার, সেটি বোঝাতে হবে তাঁদের এবং তাঁদের পরিবারকে।’
কথায় কথায় ‘নতুন মুখের সন্ধানে’ প্রতিযোগিতার কথাও উল্লেখ করলেন পরিচালক সোহানুর রহমান সোহান। তিনি বলেন, ‘২০২১ সালের শুরুর দিকে পরিচালক সমিতির সঙ্গে এফডিসি এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় যৌথভাবে “নতুন মুখের সন্ধানে” অনুষ্ঠান করার পরিকল্পনা করে। কাজ অনেক দূর এগোয়ও। বেশ কয়েকবার মন্ত্রণালয়ে মিটিংও হয়েছে। হঠাৎ করোনার প্রকোপ বেড়ে গেলে কার্যক্রম থেমে যায়। আবার নতুন করে কথাবার্তা চলছে।’
‘নতুন মুখের সন্ধানে’ কার্যক্রমের মাধ্যমে শিল্পী–সংকট দূর করা সম্ভব বলে মনে করছেন সোহানুর রহমান সোহান। কারণ, অতীতে এ কার্যক্রম থেকে যাঁরাই এসেছেন, বেশির ভাগ নায়িকাকেই দর্শক গ্রহণ করেছেন। চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন, নব্বইয়ের দশকের পর লম্বা সময় পর্যন্ত শাবনাজ, শাবনূর, মৌসুমী, পপি, পূর্ণিমারা দর্শকের মন জয় করে নেন। সেই সময় নায়কদের পাশাপাশি এই নায়িকাদের নামেও সিনেমা চলত। কিন্তু গত দেড় দশকে সেই অবস্থা আর নেই।
এ প্রসঙ্গে একসময়ের জনপ্রিয় নায়িকা শাবনাজ বলেন, ‘আমার প্রথম ছবি চাঁদনী ছিল নায়িকার নাম দিয়েই। আমি ২২টি ছবিতে অভিনয় করেছি। এর মধ্যে পাঁচ-ছয়টি ছবি ছিল নায়িকার নামে। তারও আগে শাবানা আপা, ববিতা আপাদের নামে সিনেমা চলত। কিন্তু এখন কি সেই ধরনের গল্পে ছবি তৈরি হচ্ছে? আমাদের সময় একেকজন পরিচালক একেকভাবে আমাদের উপস্থাপন করেছেন। এতে দর্শক ভিন্ন কিছু পেয়েছেন। দর্শকও গ্রহণ করেন আমাদের। এখন তা কোথায়?’
শাবনাজ আরও বলেন, ‘এখন ভালো গল্প, ভালো চিত্রনাট্যের অভাব আছে। তা ছাড়া আমাদের সময় যেসব নায়িকা ইন্ডাস্ট্রিতে ভালো করেছেন, পারিশ্রমিকের সঙ্গে সঙ্গে ভালো কাজের তাগিদটাও বেশি ছিল তাঁদের। এখন যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের পারিশ্রমিকের দিকে নজরটা একটু বেশি থাকে।’
তবে নায়িকা–সংকটের কথা মানতে নারাজ পরিচালক মতিন রহমান। এই পরিচালকের মতে, এই নায়িকাদের অভিনয়ের দক্ষতা আছে কিন্তু সুযোগ কম। তিনি বলেন, ‘এই নায়িকাদের সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে পারছেন কয়জন পরিচালক-প্রযোজক? তা ছাড়া তাঁদের কেন্দ্র করে কোনো ছবি তৈরি হচ্ছে কি? হচ্ছে না। অর্থাৎ নারীপ্রধান চরিত্র নেই। তা ছাড়া এখন সিনেমাও কম। ভালো সিনেমা কয়টা হচ্ছে? একসময় শাবানা, ববিতা থেকে শুরু করে শাবনূর, মৌসুমীদের নিয়ে টানা সিনেমা হয়েছে। একের পর এক ছবিতে কাজের কারণে একটা পর্যায়ে তাঁরা জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। পরবর্তীকালে তাঁদের নামেই ছবি চলেছে। দর্শকে হল ভরে গেছে।’ এই পরিচালকের মতে, ‘এখনকার গল্পে কিংবা পর্দায় স্পেস পাচ্ছেন না নায়িকারা। আমি মনে করি, আগের সময়ের মতো এখনকার নায়িকারা সুযোগ পেলে ঠিকই এখনো একেকজন শাবনূর হতেন, মৌসুমী হতেন কিংবা পপি হতেন।’