ওরা ১১ জনের অন্তরালের ১ জন

সিনেমাটি নিয়ে সম্প্রতি কথা বলেন ‘ওরা ১১ জন’ ছবির প্রযোজক মাসুদ পারভেজ, অভিনেতা হিসেবে যিনি সোহেল রানা নামে পরিচিত। এই অভিনেতা জানালেন তাঁর প্রযোজিত ঐতিহাসিক ছবিটির পেছনের ছোট ছোট নানা গল্প।

সিনেমাটি নিয়ে সম্প্রতি কথা বলেন ‘ওরা ১১ জন’ ছবির প্রযোজক মাসুদ পারভেজ, অভিনেতা হিসেবে যিনি সোহেল রানা নামে পরিচিত

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তি পাওয়া প্রথম সিনেমাটিই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। ছবির নাম ‘ওরা ১১ জন’। এ ছবিতে অভিনয় করেছিলেন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা। এমনকি যুদ্ধের দৃশ্য দেখানোর জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল সত্যিকারের গোলাবারুদ। শোনা যায়, রাজাকারদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার দৃশ্য শুটিংয়ের জন্য ধরে আনার কথা ছিল সত্যিকারের কয়েকজন রাজাকারকে। উন্মুক্ত স্থানে রাজাকারদের গুলি করে মৃত্যুদণ্ডের দৃশ্য কি মনে পড়ে?

সিনেমাটি নিয়ে সম্প্রতি কথা বলেন ‘ওরা ১১ জন’ ছবির প্রযোজক মাসুদ পারভেজ, অভিনেতা হিসেবে যিনি সোহেল রানা নামে পরিচিত। এই অভিনেতা জানালেন তাঁর প্রযোজিত ঐতিহাসিক ছবিটির পেছনের ছোট ছোট নানা গল্প।

কালিয়াকৈর সেতুর এক পাশ মুক্তিযুদ্ধের সময় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ‘ওরা ১১ জন’ ছবির শুটিংয়ের জন্য তাই বেছে নেওয়া হয় সেতুর অপর পাশ। সিনেমায় সেতু ধ্বংস করার দৃশ্য দেখাতে স্থাপন করা হয় বিস্ফোরক। যে দৃশ্যটি দর্শক দেখেননি, সেটিই ছিল সবচেয়ে আকর্ষণীয়। সোহেল রানা বলেন, ‘বিস্ফোরণের দমকে নদীর পানি উঠে গেল অনেক ওপরে। বেশ খানিকক্ষণ পর হঠাৎ বৃষ্টি। এক মুহূর্ত পর আমরা আবিষ্কার করলাম, সেগুলো ছিল বিস্ফোরণে ছিটকে ওপরে উঠে যাওয়া নদীর পানি। কিছুক্ষণ পর অনেক মাছ ভেসে উঠল নদীতে। সেগুলোর কান থেকে রক্ত বেরোচ্ছিল। আমরা সেই মাছগুলো রান্না করে খেলাম, কেউ কেউ নিয়ে গেল বাড়িতে।’

খ্যাতিমান পরিচালক মুস্তাফিজ ছবিটি পরিচালনা করতে চেয়েছিলেন বিনা পারিশ্রমিকে। কিন্তু চাষী যুক্ত হচ্ছেন শুনে মুস্তাফিজ বলেছিলেন, ‘সে অনেক দিন ধরে কাজ করছে। সে পারবে।’

কোথা থেকে এল তাজা বিস্ফোরক? সোহেল রানা বললেন, ‘আমার বন্ধু নূরে আলম সিদ্দিকীকে নিয়ে গিয়েছিলাম এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকারের কাছে। ছবি বানাতে অস্ত্র–গোলাবারুদ লাগবে শুনে তিনি তৎকালীন মেজর শওকতকে বলে দিলেন। তাঁর সহযোগিতায় আমরা গোডাউন থেকে বেশ কিছু রাইফেল, স্টেনগান, বিস্ফোরক নিলাম। পাকিস্তান আর্মি ও বাংলাদেশ আর্মির পোশাক কেমন হবে, সেসব দেখভালের জন্য একজন মেজরকে আমাদের সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হয়েছিল।’

দেশ কীভাবে স্বাধীন হলো, চলচ্চিত্রে তার প্রমাণ ধরে রাখবেন সিনেমার মানুষ সোহেল রানা! তাই প্রথম সিনেমাটাই হবে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। লেখা হলো ‘ওরা ১১ জন’ ছবির চিত্রনাট্য। দীর্ঘ ১৪ বছর সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করা চাষী নজরুল ইসলাম এই ছবিতে হলেন পরিচালক। যদিও তখনকার খ্যাতিমান পরিচালক মুস্তাফিজ ছবিটি পরিচালনা করতে চেয়েছিলেন বিনা পারিশ্রমিকে। কিন্তু চাষী যুক্ত হচ্ছেন শুনে মুস্তাফিজ বলেছিলেন, ‘সে অনেক দিন ধরে কাজ করছে। সে পারবে।’

চাষী (পরিচালক) ও পারভেজ (প্রযোজক) দীর্ঘদিনের বন্ধু। একত্রে চুল কাটাতেন, একই রঙের জামা পরতেন। পরিচালক হিসেবে বন্ধুর কাছ থেকে কত টাকা পারিশ্রমিক নিয়েছিলেন চাষী নজরুল ইসলাম? সোহেল রানা বলেন, ‘তার স্ত্রী জ্যোৎস্নার সঙ্গে আমার ভালো সম্পর্ক ছিল। যত দিন ছবির কাজ চলছিল, আমি জ্যোৎস্নাকে প্রতি মাসে কিছু টাকা দিতাম। তাকে বলেছিলাম, চাষীকে বিরক্ত করো না যেন। মন দিয়ে তাকে ছবিটা বানাতে দাও।’

ছবি বানানোর প্রাথমিক বাজেট জোগাড় হলো কীভাবে? সোহেল রানার বাবা আবদুল মালেক ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা। তাঁর পেনশনের টাকার একটা অংশ ছেলের হাতে তুলে দেন মা দেলোয়ারা বেগম। বোন ফেরদৌস আরা বেগমের কাছ থেকেও হাজার দশেক টাকা নিয়েছিলেন প্রযোজক। ছবির শুটিং শুরু করার পর কিছু শটের ছবি নিয়ে ডিস্ট্রিবিউটরের কাছে যেতে হবে ছবি বানানোর খরচ আগাম নেওয়ার জন্য। ইফতেখারুল আলম কিসলু পরামর্শ দিয়ে বললেন, মুক্তিযোদ্ধারা অভিনয়শিল্পী নন। কেবল তাঁরা অভিনয় করলে ছবিটা কোনো পরিবেশক নিতে রাজি হবে না। তাই এতে পরিচিত মুখ যুক্ত করতে হবে। তাই তখনকার তারকাদের এ ছবিতে অভিনয়ের প্রস্তাব দেওয়া হলো। যাকেই বলা হলো, সবাই একবাক্যে রাজি হয়ে গেলেন, এমনকি বিনা পারিশ্রমিকে। সোহেল রানার ভাষায়, ‘তখন কাকে নেব আর কাকে বাদ দেব, বুঝে উঠতে পারছিলাম না।’ ছবিতে নেওয়া হলো রাজ্জাক, শাবানা, নূতন, খলিল, হাসান ইমাম, মিতা, রওশন জামিল, সুমিতা দেবী, মিনারা জামান, এ টি এম শামসুজ্জামানের মতো অভিনয়শিল্পীদের। মুক্তিযোদ্ধা ১১ জন—খসরু, মুরাদ, হেলাল, বেবি, নান্টু, ওলীন, মঞ্জু, আতা, ফিরোজ, আবু, আলতাফরা তো ছিলেনই।

ওরা ১১ জন ছবিতে সুমিতা দেবী ও খসরু

কিছু অংশ শুটিংয়ের পর পরিবেশক স্টারের সঙ্গে চুক্তির পালা। স্টেডিয়ামের কাছে তাদের কার্যালয়ে গেলেন সোহেল রানা। তিনি বলেন, ‘শুরুতে তারা ১০ বছরের জন্য ছবিটা নিতে চেয়েছিল। আমি রাজি হইনি। বলেছি, পাঁচ বছর। তারা কাস্টিং দেখে খুশি হয়, রাজি হয়ে যায়। সাড়ে ৪ লাখ টাকার চুক্তি হয়, সাইনিং মানি ছিল ১০ হাজার। সেটা আমার জন্য তখন অনেক টাকা। বেশ ভালোভাবে জয়দেবপুর আর এফডিসিতে শুটিং করি আমরা। যখন টাকার দরকার হতো, পরিবেশকের কাছ থেকে তুলে আনতাম।’

মুক্তিযুদ্ধের প্রথম ছবি ওরা ১১ জন–এর দৃশ্য
সংগৃহীত

কয়েকজন রাজাকারকে নদীর পাড়ে গুলি করে মারার দৃশ্য দেখানো হবে। তৎকালীন ইকবাল হলে আটকে রাখা হয়েছিল বেশ কয়েকজন রাজাকারকে। দৃশ্যটাকে বাস্তবসম্মত করতে তাঁদের ধরে আনা হবে, শুরুতে পরিকল্পনা ছিল এমনই। কিন্তু চিত্রগ্রাহক আবদুস সামাদ সেটা শুনে ঘাবড়ে গেলেন। এ রকম দৃশ্য ধারণ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। যদিও বিচারকেরা এভাবেই তাদের মৃত্যুদণ্ড দেবেন। সোহেল রানা বলেন, ‘লন্ডনের সিনেমায় কাজ করে আসা সামাদ ভাই রাজি হলেন না। পরে আমিও ভাবলাম, তারা এখনো বিচারক কমিটির রায়ে চূড়ান্ত অভিযুক্ত নয়। তাই আমরা ওই দৃশ্যের ভাবনা বদলে ফেললাম। সরাসরি না দেখিয়ে ভিন্ন ভিন্ন শট নেওয়া হলো। সত্যিকারের গুলি চালানো হলো, পানিতে গুলির দৃশ্য দেখানো হলো, তারপর দেখানো হলো রক্তাক্ত রাজাকাররা পড়ে যাচ্ছে।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছবিটা দেখেছিলেন। মিন্টো রোডের বাসায় ছাত্রলীগের সবাইকে চা খেতে ডেকেছিলেন একবার। সোহেল রানা সেই স্মৃতি স্মরণ করে বলেন, ‘আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে তিনি বলেছিলেন, “ভালোই তো বানাইছিস। এ লাইনেই থেকে যা।” আমি থেকে গেলাম। তবে দুঃখ একটাই। পয়সা খরচ করে তৎকালীন সরকারকে ছবির একটা প্রিন্ট দিয়েছিলাম। সেটা দেখানোর জন্য বিভিন্ন দেশে পাঠানোও হয়েছিল। কেউ কোনো দিন আমাকে একটা লিখিত ধন্যবাদ দেয়নি, একটা টেলিফোনও করেনি। আমার অবশ্য তাতে আফসোস নেই। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে দেশ স্বাধীন করেছি, দেশ পেয়েছি, মাটি পেয়েছি, আত্মপরিচয় পেয়েছি, আমি খুশি।’