আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এগিয়ে দেশের তরুণ নির্মাতারা
২০১৬ সালে সিঙ্গাপুর আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা ছবির লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করে বাংলাদেশের সিনেমা লাইভ ফ্রম ঢাকা। উৎসবে সেরা নির্মাতা ও সেরা পারফরম্যান্সের পুরস্কার আনে ছবিটি। এই ছবির নির্মাতা আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ এবারের কান চলচ্চিত্র উৎসবের আঁ সার্তেঁ রিগা শাখায় তাঁর দ্বিতীয় ছবি রেহানা নিয়ে হাজির হয়েছিলেন। প্রথম কোনো বাংলাদেশি ছবি এই বিভাগে প্রতিযোগিতা করল।
গত কয়েক বছর ভেনিস, লোকার্নো, বুসান, টরন্টো, লন্ডন বিএফআইসহ নামী উৎসবগুলোতে বাড়ছে দেশের তরুণ নির্মাতা ও প্রযোজকদের নিয়মিত অংশগ্রহণ। অনেকেই দেশে লগ্নিকারী না পেয়ে বিদেশি অর্থায়নে দেশি সিনেমা বানানোর দিকে ঝুঁকছেন।
এই নির্মাতাদের মধ্যে আরও আছেন আরিফুর রহমান, রেজওয়ান শাহরিয়ার, বিজন ইমতিয়াজ, মেহেদী হাসান, আরিক আনাম খান, অং রাখাইন, ফজলে রাব্বী মৃধা, নুহাশ হুমায়ূন প্রমুখ। এ ছাড়া মাকসুদ হোসাইন ও তানহা জাফরীনের মতো আরও অনেক তরুণ নির্মাতা আশা জাগাচ্ছেন।
নুহাশ হুমায়ূনের প্রকল্প মুভিং বাংলাদেশ তাইওয়ানের তাইপে ফিল্ম ফান্ড থেকে ৭৬ লাখ টাকা পেয়েছে। এটি এর মধ্যেই টোকিও গ্রান্ট ফাইন্যান্সিং মার্কেট, কান চলচ্চিত্র উৎসবের মার্শে দ্যু ফিল্ম, লোকার্নো চলচ্চিত্র উৎসবের ওপেন ডোর কনসালট্যান্সি এবং ভারতের ফিল্ম বাজারে অংশগ্রহণ করে তহবিল ও সহযোগিতা পেয়েছে। নুহাশ বলেন, ‘প্রথম দিকে ছবিটির গল্প শুনে এর সর্বজনীনতাই কেউ বুঝতে পারেননি। তাঁরা (লগ্নিকারী) তাচ্ছিল্য করে বলেছেন, পাঠাওকেন্দ্রিক গল্প, তাদের কাছে অর্থ আবদার করেন। অনেকে গল্প নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁদের বোঝাতে পারছিলাম না, এটা আমাদের সবার গল্প। পরে আমি লেখায় মনোযোগ দিই। আমার কাছে মনে হয়েছিল গল্প ভালো হলে লগ্নিকারী জুটবে। এখন বিদেশি অর্থে সিনেমাটি শুটিং শুরু করতে যাচ্ছি।’
গুপি বাঘা প্রোডাকশনসের আরিফুর রহমান ও বিজন ইমতিয়াজ দীর্ঘদিন ধরে একসঙ্গে কাজ করেন। ইতিমধ্যে এই জুটি নির্মাতা ও প্রযোজক হিসেবে সুনাম অর্জন করেছেন। তাঁদের শুরুটা মাটির প্রজার দেশে সিনেমার মাধ্যমে। এটি বাংলাদেশের প্রথম সিনেমা হিসেবে বার্লিন ফিল্ম বাজারে জায়গা করে নিয়েছিল। বেশ প্রতিবন্ধকতা পার করে তাঁরা শেষ করেছিলেন সিনেমার শুটিং। তাঁদের প্রযোজিত সিনেমা ভেনিস, সানড্যান্সের মতো চলচ্চিত্র উৎসবে প্রিমিয়ার ও পুরস্কার পাচ্ছে। আরিফুর রহমান বলেন, ‘দেশকে প্রতিনিধিত্ব করা অন্য রকম একটা অনুভূতি। একটা সময় ছিল উৎসবগুলো বাংলাদেশ বললে ভারত মনে করত। কিন্তু সম্প্রতি বাংলাদেশের সিনেমা বড় বড় উৎসবে প্রতিযোগিতা করছে, বিশ্বের বড় সিনেমা প্রেক্ষাগৃহগুলোতে মুক্তি পাচ্ছে। চলচ্চিত্র অঙ্গনে একটা নতুন ওয়েভ আসছে। এটা এখানেই শেষ নয়। পাইপলাইনে আরও অনেক সিনেমা নির্মাতা আসছেন।’
পায়ের তলায় মাটি নেই নামে প্রথম সিনেমা দিয়েই বুসান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে জায়গা করে নেন তরুণ নির্মাতা ফজলে রাব্বী মৃধা। ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল অব ইন্ডিয়াতে প্রতিযোগিতা করে সিনেমাটি। এটি বানাতে গিয়ে নিজের পায়ের তলার মাটিও সরে গিয়েছিল নির্মাতার। এরপরও এগিয়ে যাচ্ছেন তিনি। ফজলে রাব্বী বলেন, ‘সিনেমা নির্মাণ করতে গেলে আশাহত হতে হয়। কারণ, প্রযোজক পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। তরুণদের কেউ প্রযোজনা করতে চান না। আমার প্রকল্পটি আবু শাহেদ ইমন ভাই যুক্ত হওয়ায় হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছিলাম। ইচ্ছে আছে, পরের ছবি দিয়ে বিশ্ব চলচ্চিত্র অঙ্গনে দেশের সিনেমাকে তুলে ধরব।’
মাই বাইসাইকেল সিনেমা দিয়ে আলোচনায় এসেছিলেন নির্মাতা অং রাখাইন। তাঁর দ্বিতীয় সিনেমা দ্য লাস্ট পোস্ট অফিস লোকার্নো, হংকং, মেলবোর্ন চলচ্চিত্র উৎসবে অংশ নেয়। চলচ্চিত্র নিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গিয়ে তাঁর মনে হয়েছে, বাংলাদেশের অনেক সিনেমার কনটেন্ট, কালার, সম্পাদনা, সাউন্ড মোটামুটি ঠিক আছে। কিন্তু উৎসব আয়োজকদের সঙ্গে নির্মাতাদের যোগাযোগ। তিনি বলেন, ‘আমাদের যোগাযোগ কম। তরুণ নির্মাতাদের আরও বেশি আপডেট হতে হবে। আমরা ফর্মালিটিস মেনটেইন করলে দেশের সিনেমা আরও ভালো জায়গায় থাকত।’
এ বছর ভারতের ফিল্ম বাজারের কো-প্রোডাকশন মার্কেটে অংশ নিয়েছেন বাংলাদেশের তরুণ নির্মাতা মাকসুদ হোসাইন ও তানহা জাফরীন। তাঁদের সাফা ও জলছবির তহবিল সংগ্রহের জন্য বিশ্বের বড় প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের কাছে যেতে চান। মাকসুদের থ্রি বিউটিজ নামে স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমা ২০০৬ সালে স্টুডেন্ট একাডেমি পুরস্কার জয় করে। তিনি বলেন, ‘আমি যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করে দেশে ফিরে এসেছিলাম সিনেমা বানাব বলে। টানা প্রায় ১০ বছর বিজ্ঞাপন থেকে বের হতে পারিনি। এখানে বাজার ছোট, তরুণদের জন্য প্রযোজক পাওয়া একটা বড় সমস্যা। ঝুঁকি নিয়েই চিত্রনাট্য প্রস্তুত করেছি। এখন আন্তর্জাতিক বাজারে তাহবিল সংগ্রহের মাধ্যমে সিনেমাটি শেষ করতে চাই।’