যে সিনেমা দেখতে গিয়ে বারবার বিব্রত হবেন আপনি

‘এলএসডি ২’ সিনেমার পোস্টার থেকে। আইএমডিবি

যাপিত জীবনের কিছুই আজকাল আর গোপন থাকে না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যেন মানুষের ভার্চ্যুয়াল দিনলিপি; যেখানে আড়াল বলতে কিছু নেই। বাড়িতে, অফিসে, এমনকি ঘুরতে গিয়েও কে কী করছেন, তার বিস্তারিত প্রদর্শনীর মঞ্চ যেন ফেসবুক বা ইনস্টা ফিড। এমনকি লাইকের লোভে নিজের যৌনজীবনও প্রকাশ্যে আনতে দ্বিধা করেন না অনেকে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই আসক্তি আর ক্যামেরার প্রতি দাসত্ব নিয়ে দিবাকর ব্যানার্জির নতুন ছবি ‘এলএসডি ২’।

গত ১৯ এপ্রিল প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায় সিনেমাটি। বক্স অফিসে সেভাবে ব্যবসা না করলেও মুক্তির পর থেকে সমালোচকদের ভূয়সী প্রশংসা পেয়েছে ‘এলএসডি ২’। গত সপ্তাহে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম জিফাইভে মুক্তির পর থেকে সিনেমাটি আরও বিস্তৃত পরিসরে ছড়িয়ে পড়েছে। সমালোচকেরা তো বটেই, বাংলাদেশের অনেক সাধারণ দর্শকও সিনেমাটির ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।

‘এলএসডি ২’ ছবির প্রচারে নির্মাতা দিবাকর ব্যানার্জি
ভিডিও থেকে

দিবাকর ব্যানার্জি হিন্দি সিনেমার নির্মাতাদের মধ্যে সমীহজাগানিয়া এক নাম। অনেকে তাঁকে এ সময় ভারতের অন্যতম সেরা পরিচালক মনে করেন। দুই দশকের ক্যারিয়ারে মাত্র সাতটি সিনেমা বানিয়েছেন দিবাকার, তাঁর প্রতিটি সিনেমাই দর্শক-সমালোচকদের মধ্যে উসকে দিয়েছে নতুন চিন্তার খোরাক। কখনো তৈরি করেছে প্রবল বিতর্ক।

আরও পড়ুন
‘এলএসডি ২’ সিনেমায় স্বস্তিকা মুখার্জি। এক্স থেকে

‘এলএসডি ২’ ২০১০ সালে মুক্তি পাওয়া পরিচালকের তৃতীয় সিনেমা ‘লাভ সেক্স অউর ধোঁকা’র সিকুয়েল। তবে সিকুয়েল হলেও আগেরটির সঙ্গে এবারের কিস্তির গল্পের তেমন মিল নেই। পরিচালকের ভাষ্যে, নতুন ছবিটির আগেরটির সঙ্গে ‘আধ্যাত্মিক মিল’ রয়েছে।

‘এলএসডি’র প্রথম কিস্তিটি ছিল তিনটি ছোটগল্পের সমন্বয়। সিনেমাটিতে পুঁজিবাদ, ভোগবাদ, জাত-বৈষম্য, অনার কিলিং, এমএমএস স্ক্যান্ডাল, স্ট্রিং অপারেশনসহ নানা বিষয় তুলে এনেছিলেন দিবাকর। তাঁর সিনেমার দর্শকমাত্রই জানেন, প্রতিটি সিনেমাতেই রাজনৈতিক বক্তব্য থাকে, তিনি কথা বলেন সমাজের নানা অন্যায়, আরও সুনির্দিষ্টভাবে বললে আর্থিক দুর্নীতি নিয়ে। ‘এলএসডি ২’–ও এর ব্যতিক্রম নয়। প্রথমটির মতো এবারও তিনি তিনটি আলাদা গল্প বলেছেন। এসব গল্পে তিনি মূলত তুলে ধরেছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসক্ত মানুষের গল্প। সে জন্যই পরিচালক ছবির ট্যাগলাইন দিয়েছেন—লাভ ইন দ্য টাইমস অব ইন্টারনেট।

‘এলএসডি ২’ সিনেমার দৃশ্য। আইএমডিবি

‘এলএসডি ২’-এ রয়েছে তিনটি গল্প—‘লাইক’, ‘শেয়ার’ ও ‘ডাউনলোড’। সিনেমাটিতে অভিনয় করেছেন নবাগত অভিনয়শিল্পীরা, যাঁদের অডিশনের পর কর্মশালার মাধ্যমে বেছে নেওয়া হয়েছে। পরিচিত মুখের মধ্যে আছেন স্বস্তিকা মুখার্জি। আগে দিবাকরের ‘ব্যোমকেশ’-এ কাজ করেছেন এই বাঙালি অভিনেত্রী। পরিচালকের ছবিতে দ্বিতীয়বারের মতো দেখা গেল তাঁকে। এ ছাড়া ছবিতে আছেন পরিতোষ তিওয়ারি, বনিতা রাজপুরহিত, অভিনব সিং, স্বরূপ ঘোষ প্রমুখ। একটি বিশেষ চরিত্রে দেখা গেছে আলোচিত-সমালোচিত তারকা উরফি জাবেদকে। ‘এলএসডি ২’ দিয়েই হিন্দি সিনেমায় অভিষেক হলো তাঁর।

সিনেমা হিসেবে নির্মাণের দিক থেকেও আলাদা ছিল ‘এলএসডি’। ২০১০ সালে যখন সিনেমাটি মুক্তি পায়, ছবিতে হ্যান্ডিক্যাম, সিসিটিভি ফুটেজের ব্যবহার করে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন নির্মাতা। এবারও নিরীক্ষা করেছেন পরিচালক। দিবাকর জানান, সিনেমাটি এমনভাবে তৈরি হয়েছে যে দেখার সময় দর্শকের মনে হবে, তিনি ইনস্টা ফিডে ছবিটি দেখছেন।

‘এলএসডি ২’ সিনেমার দৃশ্য। আইএমডিবি

প্রথম কিস্তি মুক্তির ১৪ বছর পর এসেছে ‘এলএসডি ২’। সিনেমাটিতে এই সময়ে প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের প্রায় সবকিছুই তুলে ধরেছেন নির্মাতা। গল্পগুলোর নাম ‘লাইক’, ‘শেয়ার’ ও ‘ডাউনলোড’ দেখেই তা আন্দাজ করা যায়।

‘এলএসডি ২’ এমন একটি সিনেমা, যা দেখতে দেখতে আপনার নিজেরই অস্বস্তি হবে। কারণ, আমরা প্রাত্যহিক জীবনে যা করি, সেটাই অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে পর্দায় দেখিয়েছেন নির্মাতা। ইউটিউবার, কনটেন্ট ক্রিয়েটর, ব্লগার, ভ্লগার, মিম, রিলস, ফলোয়ার, লাইক, সাবস্ক্রাইব—এখন প্রাত্যহিক জীবনে বহুল চর্চিত শব্দ। জেন–জি তো বটেই, উপমহাদেশের জনসংখ্যার বড় একটি অংশ ইন্টারনেটের আসক্তিতে ডুবে আছে। সপাট থাপ্পড়ের মতো সিনেমায় নির্মাতা তা আমাদের চোখের সামনে হাজির করেছেন।

‘এলএসডি ২’ সিনেমার আরেকটি বড় বৈশিষ্ট্য নানা লিঙ্গের মানুষের উপস্থিতি। সিনেমায় দেখানো হয়েছে ট্রান্সজেন্ডার সম্প্রদায়ের মানুষজনকে। কোথাও তারা আক্রান্ত, কোথাও আবার তাদের ব্যবহার করা হচ্ছে রিয়েলিটি শোয়ে ভোগ্যপণ্যের মতো।

‘এলএসডি ২’ সিনেমার পোস্টার। আইএমডিবি

সিনেমার প্রথম গল্পটির বিষয়বস্তু গত এক দশকে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা রিয়েলিটি শো। যেখানে টিভির শোর মুখোশ খুলে দিয়েছেন নির্মাতারা। ভোটের লোভে দর্শকের সামনে নিজের প্রেমিকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বা নিজের মাকে চড় মারা—রিয়েলিটি শোতে ব্যক্তিগত জীবনের কোনো কিছুই আর ব্যক্তিগত থাকে না। এই প্রথম গল্পটি আদতে তৈরি হয়েছে ‘বিগ বস’-এর আদলে।

আরেকটি গল্প দেখানো হয়েছে, একটি করপোরেট সংস্থার গরিব ট্রান্সজেন্ডার কর্মী কীভাবে আক্রান্ত হন। পরে সংস্থার কর্তারা নিজের গা বাঁচাতে কতটা নিচে নামতে পারেন। শেষ গল্পটি এক টিনএজার অনলাইন গেমার কাম ইউটিউবারকে নিয়ে। যে কিনা ‘ভিউ’ আর ‘ফলোয়ার’ রোগে আক্রান্ত। ভিউর নেশা এতটাই তীব্র যে পরিবারের কাউকেই সে পাত্তা দেয় না, অনায়াসে নিজের প্রেমিকার অন্তরঙ্গ মুহূর্ত ‘অনলাইন’ করে দেয়।

সব মিলিয়ে দিবাকরের ছবিটি আসলে এই সময়ের আয়না, অনেক মানুষের মনের কথাও। যাঁরা এই অন্তর্জালের জালে জড়িয়ে গেছেন, আর বের হতে পারছেন না। সিনেমার প্রতিটি দৃশ্য দেখতে বারবার বিব্রত হবেন আপনি। তাই এ সিনেমা দেখতে দেখতে অস্বস্তি বোধ না করে উপায় কী!

‘এলএসডি ২’ সিনেমার দৃশ্য। আইএমডিবি

সিনেমাটি নির্মাণের আগে দীর্ঘ সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়ে গবেষণা করেছেন দিবাকর। ছবিতে উরফিকে নেওয়া প্রসঙ্গে হিন্দুস্তান টাইমসকে দিবাকর বলেন, ‘উরফির দিকে তাকালেই যে কেউ বুঝতে পারবেন যে সে জানে, সে কী করছে। সে জানে তার টার্গেট অডিয়েন্স কারা। আর উরফি এটা উপভোগ করে। সিনেমা বানানোর আগে অনেক দিন তার ভিডিও দেখেছি। আমার সিনেমার বিষয়বস্তু এমন যে তাকে নিলে বিষয়টা জমে যায়; এ কারণেই উরফিকে নেওয়া হয়েছে।’

পরিচালক জানান, বর্তমান সময়ে মানুষ যে কার্যত ক্যামেরা বা ইন্টারনেটের দাসত্ব বরণ করেছে, সেটাই তিনি সিনেমায় তুলে ধরেছেন। পশ্চিমবঙ্গের দৈনিক সংবাদ প্রতিদিনকে দিবাকর বলেন, ‘আমি আর একতা (প্রযোজক একতা কাপুর) যখন “এলএসডি” তৈরি করি, তখন একটা বিষয় বুঝতে পারি যে ছবিটি একটি নির্দিষ্ট সময়ে ভারতের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ইতিহাসকে তুলে ধরেছিল। ২০১৯-২০ সালের দিকে একতা বলে ছবিটির সিকুয়েল করতে। তত দিনে এক দশকের বেশি সময় কেটে গেছে। নতুন ভারত গড়ে উঠেছে। নতুন এই সময়ে আমরা নেটনির্ভর হয়ে উঠেছি, যা আমাদের জীবনকে ভয়ংকরভাবে প্রভাবিত করছে।’

‘এলএসডি ২’ সিনেমার দৃশ্য। আইএমডিবি

একই সাক্ষাৎকারে এ প্রসঙ্গে নির্মাতা আরও বলেন, ‘এখন কেবল সিনেমায় অভিনয় হয় না। এখন আমরা নিজেদের জীবন অভিনয় করে দেখাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। সবাই দেখছে জেনেই জীবনের সবচেয়ে ব্যক্তিগত মুহূর্তগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তুলে ধরছি। জামাকাপড় পরে রেডি হওয়ার ভিডিও, শেভ করার ভিডিও—সবই খুব সযত্ন ক্যামেরার সামনে তুলে ধরছি এটা জেনেই যে গোটা বিশ্ব দেখছে।’