চলন্ত ট্রেন, ৪০ ডাকাত আর ২ কমান্ডো নিয়ে ‘কিল’
মুক্তির আগেই ‘কিল’-এর ইংরেজি রিমেকের স্বত্ব কিনে নিয়েছেন ‘জন উইক’ নির্মাতা চাদ স্টাহেলস্কি—এ খবর পড়েই নড়েচড়ে বসেছিলেন সিনেমাপ্রেমীরা। ভারতে ফি বছর নানা ধরনের অ্যাকশন সিনেমা হয়। ‘কিল’-এ এমন কী আছে যা ‘জন উইক’ নির্মাতাকে আগ্রহী করে তুলল? দিন কয়েক আগে সিনেমাটি মুক্তি পেয়েছে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম ডিজনি প্লাস হটস্টারে। এর মধ্যেই ‘কিল’ যদি আপনার দেখা হয়ে থাকে, তাহলে বুঝে যাবেন সিনেমাটিতে ‘কী আছে’। দেখার পর নিশ্চিতভাবেই বলতে বাধ্য হবেন, হিন্দিতে এ ধরনের অ্যাকশন সিনেমা আগে আপনি দেখেননি।
গল্প কী নিয়ে
সিনেমার গল্প ভারতীয় সেনাবাহিনীর কমান্ডো (ন্যাশনাল সিকিউরিটি গার্ড) অফিসার অমিতকে নিয়ে। অমিতের সঙ্গে তুলিকার প্রেম। তবে পরিবার সেটা জানে না। বাবার মতের বিরুদ্ধে না যেতে পারায় অন্য একজনের সঙ্গে বাগ্দান হয় তুলিকার। এরপর সপরিবার ট্রেনে চেপে রওনা হয় দিল্লিতে। তুলিকার কাছে খবর পেয়ে আরেক কমান্ডোকে নিয়ে একই ট্রেনে উঠে পড়ে অমিত। যাত্রা শুরুর কিছুক্ষণ পরই ট্রেনযাত্রা পরিণত হয় দুঃস্বপ্নে।
সেই অর্থে ‘কিল’-এ কোনো গল্প নেই, এককথায় সিনেমাটি প্রতিশোধে মরিয়া এক প্রেমিকের গল্প। তবে সিনেমাটি কখনোই গল্প-প্রধান হতে চায়নি বরং অভিনব অ্যাকশন দিয়ে চমকে দিতে চেয়েছে। এবং এতে যে নির্মাতা নিখিল নাগেশ ভাট সফল হয়েছেন বলাই বাহুল্য।
ট্রেনে ওঠে ৪০ ডাকাত। যাত্রীদের সর্বস্ব লুটে নেওয়াই যাদের পেশা। নৃশংস এই ডাকুরা প্রয়োজনে খুন করতেও দ্বিধা করে না। তুলিকার বাবা বলদেব সিং ঠাকুর প্রভাবশালী ব্যবসায়ী। তাঁকে পেয়ে বড় দাঁও মারার মওকা ডাকুরা ছাড়বে কেন। অবধারিতভাবে ঘটনায় জড়িয়ে পড়ে অমিত। সে কি পারবে প্রেমিকা আর ট্রেনযাত্রীদের চোরদের কাছ থেকে মুক্ত করতে? নাকি চলন্ত ট্রেন পরিণত হবে এক দুঃস্বপ্নের যাত্রায়—এমন গল্প নিয়েই এগিয়ে যায় ‘কিল’।
‘কিল’ কেন আলাদা
সেই অর্থে ‘কিল’-এ কোনো গল্প নেই, এককথায় সিনেমাটি প্রতিশোধে মরিয়া এক প্রেমিকের গল্প। তবে সিনেমাটি কখনোই গল্প-প্রধান হতে চায়নি বরং অভিনব অ্যাকশন দিয়ে চমকে দিতে চেয়েছে। এবং এতে যে নির্মাতা নিখিল নাগেশ ভাট সফল হয়েছেন বলাই বাহুল্য। ‘কিল’-এর প্রধান আকর্ষণ করিডর অ্যাকশন। ট্রেনের দুই পাশের সিটের মাঝের সরু জায়গায় যেভাবে অ্যাকশন দৃশ্যের কোরিওগ্রাফি করা হয়েছে, সেটা ছিল দেখার মতো।
২১ বছর আগে পার্ক চান-উকের ‘ওল্ডবয়’-এর বিখ্যাত করিডর অ্যাকশন দৃশ্যের কথা নিশ্চয় মনে আছে, সহজবোধ্যভাবে ‘কিল’কে সেটারই পরিবর্ধিত সংস্করণ বলা যায়। হালের জনপ্রিয় ‘জন উইক’ ফ্র্যাঞ্চাইজির হ্যান্ড টু হ্যান্ড কমব্যাট, চুরি নিয়ে মারামারি দেখেছেন দর্শক, দেখেছেন কোরীয় সিনেমার নৃশংসতাও; ‘কিল’-এ সবই আছে, যা ভারতীয় সিনেমায় প্রথমবার দেখেছেন দর্শকেরা।
‘কিল’ কার্যত দুইভাবে বিভক্ত—বিরতির আগের ও বিরতির পরে। বিরতির পর থেকে নায়ক যেভাবে ‘বদলে যান’ সেটাও ছিল গল্পের বড় শক্তির জায়গা। প্রথমার্ধে নায়ক ছিলেন ভীত, পরের অংশ তিনিই হয়ে ওঠেন ভীতিজাগানিয়া।
১ ঘণ্টা ৪৭ মিনিটের সিনেমাটি পুরোটাই অ্যাকশনে ভরপুর। অন্য অনেক সিনেমার মতো প্রেম, গান সময় না দিয়ে সরাসরি অ্যাকশনে চলে গেছে ‘কিল’। শুরুর ১৭ মিনিট পর যে ধুন্ধুমার অ্যাকশনের শুরু, সেটা চলে শেষ পর্যন্ত। এই রুদ্ধশ্বাস অ্যাকশন থেকে আর বের হতে পারেন না দর্শকেরা।
তবে অ্যাকশনের সঙ্গে আবেগের দারুণ সমন্বয় করেছেন নির্মাতা। শেষ পর্যন্ত ‘কিল’ যেভাবে দুই কমান্ডো ছাড়াও অন্য যাত্রীদের প্রতিশোধের গল্প হয়ে ওঠে—সেটা দেখে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়বেন দর্শকেরা।
সিনেমায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় রয়েছে ডাকুরা। তবে তাদের কেবল নৃশংস খুনি হিসেবে না দেখিয়ে আবেগের দিকগুলোও দেখিয়েছেন নির্মাতারা। ডাকুদের একে অন্যের প্রতি আবেগ, বাবা-ছেলের সম্পর্কও তুলে ধরেছেন নির্মাতা।
‘কিল’ কার্যত দুইভাবে বিভক্ত—বিরতির আগের ও বিরতির পরে। বিরতির পর থেকে নায়ক যেভাবে ‘বদলে যান’ সেটাও ছিল গল্পের বড় শক্তির জায়গা। প্রথমার্ধে নায়ক ছিলেন ভীত, পরের অংশ তিনিই হয়ে ওঠেন ভীতিজাগানিয়া।
‘কিল’ নিয়ে কেন উচ্ছ্বসিত সমালোচকেরা
গত বছরের সেপ্টেম্বরে টরন্টো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রিমিয়ার হয় ‘কিল’ সিনেমার। উৎসবে সিনেমাটি ‘পিপলস চয়েজ অ্যাওয়ার্ড: মিডনাইট ম্যাডনেস’ বিভাগে প্রথম রানারআপ হয়। তখন দেখেই সিনেমার দিকে চোখ সমালোচকদের। ৫ জুলাই প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায় সিনেমাটি। দেখার পর সমালোচকেরা সিনেমাটি নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন।
রটেন টোমাটোজ-এ ছবিটি ৯০ শতাংশ ইতিবাচক রিভিউ পেয়েছে। মেটাক্রিটিকে স্কোর ১০০-তে ৭৪।
ইন্ডিয়া টুডের সমালোচক জিনিয়া বন্দ্যোপাধ্যায় ছবিটিকে ৫-এ ৪.৫ দিয়েছেন। তিনি সিনেমাটি নিয়ে লিখেছেন, ‘অ্যাকশনপ্রেমী ও অন্য দর্শকের জন্য সিনেমাটি মাস্ট ওয়াচ।’
রেডিফডটকমের সুকন্যা ভার্মা লিখেছেন, ‘এটা কেবল মৃত্যু বা নৃশংসতার গল্প নয়, বরং কীভাবে নৃশংসতা দেখানো হয়েছে সেটাই।’
প্রায় সব সমালোচকই সিনেমাটির অ্যাকশন কোরিওগ্রাফি, নির্মাণ, অমিত চরিত্রে লক্ষ্যর পারফরম্যান্সের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। আলাদাভাবে কৃতিত্ব পেয়েছে সিনেমার সাউন্ড ডিজাইন।
ভারতীয় গণমাধ্যম ছাড়া ভ্যারাইটি, গার্ডিয়ান, দ্য হলিউড রিপোর্টারও ছবিটির ভূয়সী প্রশংসা করেছে। ভ্যারাইটি লিখেছে, ‘ভারতে নির্মিত সবচেয়ে নৃশংস সিনেমা এটি, এমন দুর্ধর্ষ অ্যাকশন আগে দেখা যায়নি।’
দুর্দান্ত নায়ক, খলনায়ক লা-জবাব
লক্ষ্য লালওয়ানির এটিই বড় পর্দায় প্রথম কাজ। অভিষেকেই তিনি সিনেমার প্রধান চরিত্র অমিত হিসেবে দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন। তাঁর অ্যাকশনের তারিফ করেছেন দর্শক-সমালোচকেরা। এক সাক্ষাৎকারে অভিনেতা জানান, ছোটবেলা থেকেই কুস্তির প্রশিক্ষণ ছিল তাঁর; তাই এ ছবির প্রস্তুতি তাঁর জন্য সহজ হয়েছে। তারপরও শুটিংয়ের আগে আট মাসের প্রস্তুতি নিতে হয়েছে তাঁকে। তবে কেবল নায়ক নন, সিনেমার খলনায়কের চরিত্রে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন রাঘব জুয়াল। সিনেমায় সবচেয়ে ভালো অভিনয় সম্ভবত তিনিই করেছেন। তাঁর হাঁটাচলা, কথা বলার মধ্যে ঠান্ডা মাথার এক নৃশংস খুনিকে পাওয়া গেছে। স্বল্পদৈর্ঘ্যের চরিত্র হলেও অমিতের প্রেমিকার চরিত্রে ভালো করেছেন তানিয়া মানিকতলা।