আওরঙ্গজেবকে নিয়ে বিতর্ক উসকে দিয়েই কি এত ব্যবসা
চলতি বছর হিন্দি সিনেমার বাজার মন্দা, সেভাবে ব্যবসা করতে পারছিল না কোনোটিই। অন্যদিকে নির্মাতা হিসেবে লক্ষ্মণ উতেকর এক ‘মিমি’ ছাড়া মনে রাখার মতো কিছু করেননি। সে সিনেমাও এসেছিল ওটিটিতে, বক্স অফিসের হিসাব সেখানে ছিল না। হিন্দি সিনেমা আর লক্ষ্মণ উতেকরে ‘উদ্ধার’ করেছে ‘ছাবা’। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি মুক্তির পর থেকে সেই যে বক্স অফিসে ঝড় তুলেছে, ৩৫ দিনেও সেটা কমার লক্ষণ নেই। তবে মুক্তির পর বক্স অফিসে ব্যবসার সঙ্গে প্রবল বিতর্কও উসকে দিয়েছে ‘ছাবা’। এই সিনেমায় মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবকে খলনায়ক হিসেবে দেখানো হয়েছে, যা নিয়ে মহারাষ্ট্রে রীতিমতো হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে সংঘর্ষ বেধে গেছে। আওরঙ্গজেবকে নিয়ে বিতর্ক উসকে দিয়েই কি এত ব্যবসা করল সিনেমাটি?
বক্স অফিসে ঝড়
ভারতীয় গণমাধ্যম কইমইডটকম নিয়মিত মুক্তি পাওয়া হিন্দি সিনেমার বক্স অফিসের আয় প্রকাশ করে। গণমাধ্যমটির দেওয়া তথ্যমতে, মুক্তির ৩৫ দিনে কেবল ভারতের বক্স অফিসেই ৫৭১ কোটি ৪০ লাখ রুপি আয় করেছে ‘ছাবা’।
সারা দুনিয়ার বক্স অফিসের নিরিখে এই আয় ৭৯২ কোটি ১৫ লাখ রুপি। সব ঠিক থাকলে আজই সিনেমাটির ৮০০ কোটি আয়ের ক্লাবে ঢুকে পড়ার কথা। সেটা হলে ‘ছাবা’ হবে ৮০০ কোটি রুপির বেশি ব্যবসা করা নবম হিন্দি সিনেমা।
কী আছে ‘ছাবা’য়
‘ছাবা’ সিনেমা মারাঠা সম্রাট শিবাজি মহারাজের ছেলে সাম্ভাজিকে ঘিরে। আর সাম্ভাজি মহারাজের চরিত্রে অভিনয় করে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন ভিকি কৌশল। খুব বেশি বাজেটের সিনেমায় কখনো ভিকিকে আগে দেখা যায়নি। এদিক থেকে বলা যায়, লক্ষ্মণ উতেকর একপ্রকার বাজি ধরেছেন ভিকির ওপর। আর সে বাজি মাত করে দিয়েছেন ভিকি। বেশির ভাগ সমালোচকের মত, সিনেমার নির্মাণ নিয়ে অনেক খুঁত ধরার অবকাশ থাকলেও ভিকি একদম নিখুঁত।
বলা যায়, তাঁর অভিনয় দেখার জন্য এ সিনেমা দেখা সার্থক! ‘ছাবা’ গল্প শুরু হয় মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের দরবার থেকে। শিবাজি মহারাজ ছিলেন তুমুল প্রতাপশালী রাজা এবং আওরঙ্গজেবের সবচেয়ে বড় শত্রু। কারণ, শিবাজি মহারাজকে পরাজিত করার পরও মারাঠা সাম্রাজ্য দখল করার ইচ্ছা পূর্ণ হয়নি আওরঙ্গজেবের। তবে শিবাজির মৃত্যুর খবর পাওয়ামাত্র মোগল দরবার হয়ে ওঠে আনন্দে উদ্বেল।
পথের কাঁটা দূর হয়েছে ভেবে উৎসবে মেতে ওঠে তারা। আর তখনই হাজির হন ছত্রপতি সাম্ভাজি মহারাজ। কিছুসংখ্যক সৈন্য নিয়ে হুট করেই মোগলদের সম্পদশালী শহর বোরহানপুরে আক্রমণ করেন। গুঁড়িয়ে দেন সাজানো নগর। লুট করেন সব সম্পদ। এ আক্রমণের মাধ্যমে সরাসরি মোগল শাসনকে চ্যালেঞ্জ করে বসেন সাম্ভাজি। এ আক্রমণ স্তম্ভিত করে দেয় মোগলদের। মারাঠাদের গুঁড়িয়ে দিতে সম্রাট আওরঙ্গজেব বিশাল বাহিনী নিয়ে যাত্রা করেন। অন্যদিকে মারাঠা সাম্রাজ্যের ভেতরই দানা বাঁধতে থাকে ষড়যন্ত্র। নিজের পরিবারের ভেতর থেকেই সাম্ভাজিকে সরাতে উঠেপড়ে লাগেন অনেকে। একদিকে মোগল সেনা, অন্যদিকে পারিবারিক বিদ্রোহ—এ দুটি কি সামাল দিতে পারেন সাম্ভাজি? কী হয়েছিল তাঁর পরিণতি? ‘ছাবা’তে এ কাহিনিই দেখানো হয়।
কেন এই বিতর্ক
মারাঠি শব্দ ‘ছাবা’ অর্থ সিংহশাবক। মহারাজা সম্ভাজির চরিত্রে ভিকি কৌশল ভূয়সী প্রশংসা পাচ্ছেন কিন্তু সম্ভবত তার চেয়েও বেশি আলোচনা হচ্ছে ছবিতে আওরঙ্গজেবের ভূমিকায় অভিনয় করা অক্ষয় খান্নাকে নিয়ে। অনেক সমালোচক লিখেছেন, ছবিতে সম্ভাজিকে নির্যাতনের দৃশ্যগুলো এতটাই ভয়াবহ ও জীবন্ত ছিল যে হলের ভেতরে বহু বাচ্চা ছেলেমেয়ে ভয়ে কেঁদেই ফেলেছে। ভারতীয় গণমাধ্যম ইন্ডিয়া টুডেতে আরুশি জৈন লিখেছেন, ‘একজন নিষ্ঠুর স্বৈরাচারী ও একই সঙ্গে দক্ষ শাসকের ভূমিকায় আওরঙ্গজেবের এমন শিরদাঁড়ায় ঠান্ডা স্রোত বইয়ে দেওয়া, অথচ সংযত চিত্রায়ণ আমরা আগে দেখিনি।’
এর আগে ১৯৮৮ সালে শ্যাম বেনেগাল যখন জওহরলাল নেহরুর আত্মজীবনীর ভিত্তিতে দূরদর্শনের জন্য ‘ভারত এক খোঁজ’ নামে টিভি সিরিয়াল বানিয়েছিলেন, সেখানে আওরঙ্গজেবের ভূমিকায় ছিলেন প্রয়াত অভিনেতা ওম পুরী। ‘ছাবা’ সিনেমায় একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে আছেন আশুতোষ রানা, তিনি নিজেও বছর চারেক আগে ‘ছত্রশাল’ ওয়েব সিরিজে আওরঙ্গজেবের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। তবে সমালোচকেরা একমত, পর্দায় অক্ষয়ের চেয়ে ভালো আওরঙ্গজেব আর কেউই হতে পারেননি। অক্ষয় অভিনীত চরিত্রটিতে তেমন সংলাপ ছিল না কিন্তু নিজের অভিব্যক্তি দিয়েই যে নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিয়েছেন অভিনেতা চমকে দেওয়ার মতো। মহারাষ্ট্রে আওরঙ্গজেবকে নিয়ে পুরোনো বিতর্ক যে সিনেমা মুক্তির পর আরও বাড়বে, সেটা তাই অনুমিতই ছিল।
সিনেমা মুক্তির আগে অনেকে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন মহারাজ সম্ভাজির উত্তরসূরিদের পক্ষ থেকে আপত্তি আসতে পারে। কিন্তু নির্মাতা লক্ষ্মণ উতেকর সে সুযোগ রাখেননি। মুক্তির আগেই সম্ভাজির পরিবারের উত্তরসূরিদের জন্য বিশেষ প্রদর্শনীর আয়োজন করেন, যেখানে তাঁদের আপত্তি মেনে সিনেমায় কিছু কাটছাঁট করা হয়।
সবাই চুপ
‘ছাবা’ মুক্তির যেমন ব্যবসা করছে, তেমনই উসকে দিয়েছে প্রবল বিতর্ক। তবে সিনেমাটি মুক্তির পর হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে সংঘর্ষ, আওরঙ্গজেবের করব সরানো নিয়ে আন্দোলন হয়ে গেলেও এসব থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখেছেন নির্মাতারা। এখন পর্যন্ত নির্মাতা লক্ষ্মণ উতেকর, অভিনয়শিল্পী ভিকি কৌশল বা অক্ষয় খান্না মুখ খোলেননি।